মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক 

সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবার কীভাবে ধ্বংস হতে পারে তার একটি বড় উদাহরণ আমার পরিবার। বাবাকে হারিয়েছি মাত্র ৪ বছর বয়সে। এর পর নিজের চোখেই পরিবারকে ভেঙে পড়তে দেখেছি। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও পরিবারের ব্যবসার কাজে প্রচুর সময় দিতে হতো। আমি ব্যবসায়িক কাজে একটু বেশি সময় দিলেই দেখতাম ব্যবসা ভালো চলত। তখন আত্মবিশ্বাস জন্মে, আমার দ্বারা যে কোনো বিষয়েই সফলতা অর্জন করা সম্ভব।

জন্মের পর থেকেই পরিবারকে এত সমস্যায় জর্জরিত দেখেছি যে, সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হওয়া সত্ত্বেও সব সময় পরিবারকে নিয়ে ভাবতে হতো। ফলে একজন সাধারণ ছাত্রের মতো পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও স্কুল-কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জন করি। কোনো কোচিং-প্রাইভেট পড়ার সুযোগ ছিল না। পুরো ছাত্রজীবনে মাত্র ৫ মাসের মতো প্রাইভেট পড়েছিলাম। পড়াশোনার বিষয়গুলো নিজেই সমাধান করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিংও করিনি। ছোট থেকেই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল। এ ছাড়াও বড় ভাই নিয়মিত ম্যাগাজিন ও সাধারণ জ্ঞানের বই কিনত। সেগুলোও পড়তাম।

আমার প্রাথমিক ও কলেজ জীবন কেটেছে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এইচএসসি পরীক্ষার কয়েক মাস আগে আমাদের একটি জমির মামলায় প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি ডিক্রি জারি হয়। এতে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক কিছুই উচ্ছেদ হয়। অনেকেই ভেবেছিল, আমার পড়াশোনা শেষ। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও নিজেকে সামলে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। কিন্তু আইনে চান্স না হওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর স্যারের অনুপ্রেরণায় রাবির আইন বিভাগে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষটি অসুস্থতার মধ্য দিয়েই যায়। ফলে দীর্ঘ সময় বাসাতেই কাটাতে হয়। এর পর বাকি ৪ বছরে সর্বসাকল্যে বাসায় ২০ দিনও থাকা হয়নি। একবার তো টানা ১৬ মাস পর বাসায় গিয়েছিলাম। বছরের ৭ মাস নিজের ক্লাস ও টিউশনি করার কারণে সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত রুমের বাইরে থাকি। এত কিছুর পরও পারিবারিক সমস্যাগুলো নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখে সর্বদা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি। বন্ধুরা প্রায়ই বলে, ‘তুই সব সময় হাসি-খুশি থাকিস কীভাবে? তোর কি কোনো খারাপ লাগা নেই?’ নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই আমি বেশি পছন্দ করি। অনেকের সঙ্গে মেশার সুবাদে অন্যের বিষয়ে জানার পরও নিজের ব্যাপারে কখনও কাউকে বলিনি। আমার এলএলবির রেজাল্টের পর শ্রদ্ধেয় এক শিক্ষক তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন_ ‘এই পাগলাটি এতটাই পড়াশোনায় বিভোর থাকে যে, ওর কোনো ফেসবুক আইডিও নেই।’ মজার ব্যাপার হলো, আমার একটি আইডি আছে কিন্তু কেউ তা জানে না।

বিভাগের প্রায় সবাই আমাকে বইপোকা আর অসামাজিক বলে। কারণ অনেক সময় আমি ঈদেও বাসায় যাই না। পাশাপাশি আমার বিভাগের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া হয়নি। এটা একদিকে যেমন ভালো, আবার খারাপও লাগে_ কেউ আমাকে কখনও বুঝলই না, কেন আমি এত লুকিয়ে চলি।

আমার জীবনে আইন-আদালতের জটিলতার মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পেছনে মূল কারণ আমার মা। তাকে প্রায় ১২ বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ও অবহেলিত হতে দেখেছি। এখন বিভাগের কাজে যখন বিভিন্ন আদালতে যাই তখন মায়ের কথা মনে পড়ে। নিজের মায়ের কষ্ট হয়তো ঘোচাতে পারিনি, কিন্তু এমন হাজারো মায়ের কষ্ট যেন ঘোচাতে পারি এবং আইন-আদালত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিরাজমান ধারণাকে যেন একটু হলেও বদলে দিতে পারি, সেই জায়গা থেকেই আইন পেশায় যাওয়ার চিন্তা।

আজ পর্যন্ত টিকে থাকার মূলমন্ত্র আত্মমর্যাদা, লক্ষ্য, আত্মবিশ্বাস এবং পরিশ্রম। তাই সবাইকে বলব, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখতে দেখতে এগিয়ে যান। কারণ মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment