অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা
- মো. মশিউর রহমান
টেকসই উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জোরেশোরে বলা হচ্ছে। প্রতিটি মুদ্রানীতিতেই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিয়ে বক্তব্য থাকে। বিশেষ করে এসএমই ঋণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিও। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। উল্লেখ্য, এই হার ১০ শতাংশের বেশি নয়। এখন অবশ্য বাণিজ্যিক ঋণও ১০ থেকে ১৩ শতাংশে পাওয়া যায়। এত কিছুর পরও বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েট বেকারের হার ৪৭ শতাংশ (ডেইলি স্টার, ৪ মার্চ ২০১৫); যদিও সর্বোপরি বেকারের হার ৫ শতাংশের কম।
অনেকেই আশার বাণী শোনান যে বাংলাদেশে যুবকরাই পরিবর্তন আনবে। কারণ বাংলাদেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। এটি একটি বড় আশার বাণী যে মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার বেশির ভাগই যুবক, যারা পরিশ্রমী আর ঝুঁকি নিতে পারে। আমিও এই আশাবাদীদের পক্ষে। প্রশ্ন হলো, তাহলে হচ্ছে না কেন? অথবা প্রয়োজনের তুলনায় ধীরগতিতে হচ্ছে কেন? কারণ একটাই—আর তা হলো দক্ষতার অভাব। এই একটি কারণ থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে সমস্যায় আছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনসংখ্যা, যাদের ৪৭ শতাংশই বেকার। তার মানে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কর্ম উপযোগী জনসংখ্যা তৈরি করতে পারছে ৫৩ শতাংশ। তাদের মধ্যেও অনেকেই আবার স্বল্প বেতনের যন্ত্রণায় ভোগে; যদিও ২০০৭ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের বেশি। জিডিপিতে যেহেতু অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যায় না, তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণের বিন্যাসের কথা বলা হচ্ছে। এখানে ঋণের বিন্যাস বলতে বোঝানো হচ্ছে যে ঋণ শুধু ধনীরা নয়, দরিদ্ররাও পাবে। ঋণ পাওয়া দরিদ্রেরও অধিকার।
প্রশ্ন হলো, ঋণ নিয়ে দরিদ্ররা কী করবে? কারণ তাকে তো নির্দিষ্ট সময় পর সুদসহ ঋণ ফেরত দিতে হবে। নিশ্চয়ই তাকে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসা কি সবাই করতে পারে? অবশ্যই না। ব্যবসা করতে হলে উদ্যোক্তা হতে হয়। উদ্যোক্তা হলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন, ঝুঁকি নিতে পারেন এবং অর্থের ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করতে পারেন। উদ্যোক্তা সামাজিক উন্নয়নেও দানের মাধ্যমে এবং পরামর্শ দিয়ে ভূমিকা রাখেন। কারণ সামাজিক উন্নয়ন ব্যবসায় উন্নয়নেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য আমাদের কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের চেয়ে ব্যবসানির্ভর বাংলাদেশে পরিণত হতে হবে। ব্যবসায়ের কিছু মৌলিক নীতি আছে, তা সবাইকে মেনে চলতে হবে, যেমন—তুলনামূলক মানসম্মত পণ্য বা সেবা, প্রতিযোগিতামূলক দাম, দ্রুততম সময়ে সরবরাহ এবং মানবতার কল্যাণ। মানবতার অকল্যাণ হয় এমন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকা যায় না। এ জন্য সরকারসহ সাধারণ সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে উদ্যোক্তা তৈরিতে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি প্রতিবছর একজন করে উদ্যোক্তা তৈরি করে বাংলাদেশে, তাহলে প্রতিবছর লক্ষাধিক উদ্যোক্তা তৈরি হবে, যারা পরবর্তী সময়ে বেকার সমস্যা সমাধানে কাজ করবে। সমাজে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশও তৈরি করতে হবে। এ জন্য আমাদের নিজের সম্পর্কে ও দেশের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
আমরা যে এখনো ব্যবসায়ী হতে পারিনি তার অসংখ্য প্রমাণ আছে, যেমন—আমাদের দেশে অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা চিকেন ফ্রাই বিক্রি করেন। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের দেশের মুরগি, অর্থ ও জনবল ব্যবহার করা হচ্ছে, অথচ বিদেশি নাম ব্যবহার করা হয়। কারণ একটাই, আমরা নিজেরা ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জন করতে পারিনি। একইভাবে আমাদের গার্মেন্ট খাতে প্রচুর বিদেশি কাজ করেন, এ জন্য যে তাঁরা অনেক দক্ষ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের দেশে কিছু চেইন শপ আছে, যারা চাল-ডাল, মাছ-তরকারি থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে থাকে। তাদের বেশির ভাগ পণ্যই দেশীয় এবং যাঁরা কাজ করেন ও অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তাঁরাও দেশীয়। অথচ ব্যবসা চলে বিদেশি কম্পানির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং তাদের দেওয়া নাম অনুসারে। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ আছে যে আমরা আমাদের নিজেদের বাজারই ধরতে পারছি না দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে।
তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য ঋণের বিন্যাস যেমন জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি উদ্যোক্তা উন্নয়ন। উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের এক নতুন পরিচয় দিতে পারি, আর তা হলো ব্যবসায়ী বাংলাদেশ; যারা শুধু দেশের ভেতরেই নয়, দেশের বাইরেও ব্যবসা করবে।
লেখক : ব্যাংকার