প্রযুক্তি দ্রুত বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবনধারা
- কিশওয়ার ইমদাদ
ইন্ডিগো কানাডার একটি নাম করা বইয়ের দোকান। এ দোকানের ক্যাফেতে বসে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল একজন বিখ্যাত বিপণনবিদের সঙ্গে। আলাপের বিষয় ছিল বাজারে পণ্যের চাহিদা কেন ওঠানামা করে। তিনি আমাকে নব্বইয়ের দশকের একটি মজার ঘটনা বললেন। নর্থ আমেরিকার একটি নাম করা কসমেটিকস কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট লক্ষ করল যে, তাদের টপ সেলিং ব্র্যান্ড গ্লসি লিপস্টিকের বিক্রয় নাটকীয়ভাবে পড়ে গেল। অন্যদিকে স্কিন কেয়ার প্রডাক্টের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল। কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা ভাবলেন, হয়তো গ্লসি লিপস্টিকের ফেডটা চলে যাচ্ছে এবং নতুন কোনো ফ্যাশন ট্রেন্ড আসছে।
শুরু হলো এ নিয়ে বিপণন গবেষণা। ক্রেতাদের পছন্দ, ফ্যাশন ট্রেন্ড, বহু সংস্কৃতির প্রভাব, ক্রয়ক্ষমতা ইত্যাদি বহু বিষয়ের সমীক্ষা আর পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণা করলেন বাঘা বাঘা বিপণনবিদরা। অথচ গ্লসি লিপস্টিকের বিক্রয় পড়ে যাওয়ার এবং স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঠিক কোনো কারণ চিহ্নিত করা গেল না।
অবশেষে একটি তথ্য বের হয়ে এল যে, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের প্রজন্ম যাদেরকে বেবিবুমার বলা হয়, তারা নর্থ আমেরিকার ক্রেতাসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এই বেবিবুমার প্রজন্মের বয়স নব্বইয়ের দশকে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই করছে। এই বয়সের সচ্ছল নারীরা গ্লসি লিপস্টিক ছেড়ে ত্বকের যত্নের প্রতি বেশি মনোযোগী। এমনকি পুরুষরাও বয়স ধরে রাখার জন্য ত্বক পরিচর্যার দিকে ঝুঁকছে। এই মিসিং লিংকটা চিহ্নিত করেছিলেন একজন বুদ্ধিমান বিপণন বিশ্লেষক, যা অন্যদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বা ধারণার বাইরে ছিল। পণ্যের চাহিদা নির্ণীত হয় কোন ক্রেতাগোষ্ঠী মার্কেট ডমিনেট করছে এবং তাদের বয়সের ওপর, যেটি একটি মেজর ফ্যাক্টর।
এছাড়াও আমরা দেখেছি, প্রযুক্তির পরিবর্তন কীভাবে বাজার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৭ সালে বাজারে এল অ্যাপলের যুগান্তকারী আবিষ্কার আইফোন। পাশাপাশি অ্যান্ড্রয়েড প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যামস্যাং কোম্পানি বাজারে নিয়ে এল স্মার্টফোন স্যামস্যাং গ্যালাক্সি। আইফোন ও স্যামস্যাং দ্রুত মোবাইল ফোনের বাজার দখল করে নিল। চাপের মুখে পড়ে গেল নকিয়া, মটোরোলা, সনি ও ব্ল্যাকবেরি। ল্যাপটপ থেকে ইন্টারনেট সুবিধা চলে এল স্মার্টফোনে। হাতের মুঠোয় খুলে গেল বিশ্বের দরজা। স্মার্টফোন এসে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যুক্ত করে প্রভাবিত করল সারা বিশ্বের জনসাধারণকে।
আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, কীভাবে প্রযুক্তি প্রভাবিত করেছে পণ্যবাজার এবং বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনধারা। এ বিপ্লব বা বদলের পেছনে কি শুধুই প্রযুক্তি না অন্য কিছু? পাঠক, আসুন রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রাখি।
ষাট এবং সত্তরের দশকের তরুণ-তরুণীদের কাছে গান বা নাটক শোনার জন্য রেডিও ছিল জনপ্রিয় মাধ্যম। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে গান সংগ্রহ হতো রেকর্ডে এবং শোনার মাধ্যম ছিল গ্রামোফোন। রেকর্ডের পর সত্তরের দশকে এল ক্যাসেট। আশির দশকে এল ভিডিও টেপ। নব্বইয়ের দশকে এল সিডি এবং ডিভিডি। আর এখন সবকিছুই চলে এল সফটমিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট অথবা ল্যাপটপে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল। গত দশকে সেই দর্শকের মনোযোগ ভাগ হয়েছে শতাধিক টিভি চ্যানেলে। বিশাল হোম থিয়েটারের আগমনের ফলে সিনেমা হলগুলো হারিয়েছে মধ্যবিত্ত দর্শক। হাতে গোনা কিছু ব্লকবাস্টার সিনেমা ছাড়া সিনেপ্লেক্সের ব্যবসা মন্দার সম্মুখীন।
আশির দশক পর্যন্ত ছিল ল্যান্ডলাইন ফোনের যুগ। মনে পড়ে একটি ল্যান্ডফোন লাইনের সংযোগ পাওয়ার জন্য টিঅ্যান্ডটি অফিসে ধর্ণা দিতে হতো। টিঅ্যান্ডটির ফোন সংযোগ পাওয়া ছিল একটি কঠিন বিষয়। ক্ষমতাধর সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে তদবির, লাইনম্যানকে উেকাচ প্রদান করার পর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে তার পর সংযোগ মিলত। তখন পরিচিতজন অফিসের টেবিলে বা বাসায় না থাকলে তার হদিস পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য বিষয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সেলফোনের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে এল ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন মোবাইল ফোন ছাড়া নিজেকে রীতিমতো অসহায় মনে হয়। আর ল্যান্ডফোন সেটে জমেছে ধুলো।
নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেট প্রযুক্তি এসে খুলে দিল বিশ্বের জানালা। কিন্ডেল এনেছে কাগজের বইয়ের ইলেকট্রনিক রূপান্তর। এক দশক আগেও সাবওয়ে ট্রেনে বা বাসে যাত্রীদের হাতে থাকত বই কিংবা পত্রপত্রিকা। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্যাবলেট, আইপড, কিন্ডেলসহ যাবতীয় ইলেকট্রনিক গ্যাজেট। সম্প্রতি উবার এসে দখল করে নিয়েছে প্রাইভেট ট্যাক্সির বাজার। এয়ার বিএনবি ভাগ বসিয়েছে হোটেল ও পর্যটন ব্যবসায়। যাত্রীদের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিমান বা এয়ারলাইনসগুলো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ভিডিও, মিউজিক, সিনেমার পর এখন যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট এবং উড়ালী দূরালাপনী।
প্রযুক্তি দ্রুত বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনধারা। কিন্তু সেসঙ্গে লুফে নিচ্ছে অনেক পেশা, বাণিজ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতি। যেমন— যাত্রা বা সার্কাস শিল্পীরা এখন বিরল সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। বিলীন হয়েছে আশির দশকে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা ভিডিওর দোকান। ই-মেইলের আগমনের ফলে মানুষ এখন চিঠি লেখা প্রায় ভুলেই গেছে। এখন প্রেমপত্র এবং চিরকুটের জায়গা দখল করে নিয়েছে এসএমএস। লংডিসটেন্স টেলিফোন কলের বদলে তরুণ-তরুণীরা এখন ব্যবহার করে ভাইবার, ট্যাংগো বা স্কাইপ। ইউটিউবের আগমনের ফলে সিডি ব্যবসা প্রায় বন্ধের উপক্রম।
চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এখন সার্জনরা অপারেশনের কাজে রোবট ব্যবহার করছেন। স্টেমসেল গবেষণা হয়তো আমূল বদলে দেবে চিকিৎসা পদ্ধতি। সম্প্রতি মানবদেহে কৃত্রিম কিডনি এবং হূদপিণ্ড সংযোজন ইঙ্গিত দেয় যে, আশির দশকের টিভি সিরিজের চরিত্র বায়োনিকম্যানের বাস্তবরূপ আসন্ন।
উনবিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার ছিল ফটোগ্রাফি, বিদ্যুত্, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, স্টিম ইঞ্জিনের রেলগাড়ি ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর অবাক করা আবিষ্কার হলো রেডিও, টেলিভিশন, অটোমোবাইল, উড়োজাহাজ, সাবমেরিন, রকেট, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি। আর একবিংশ শতাব্দীতে কিছু উদ্ভাবন মানুষের জীবনধারা আমূল বদলে দিতে পারে; যেমন— রোবটিকস, জেনেটিক প্রকৌশল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো প্রযুক্তি, হাইড্রোজেন জ্বালানি শক্তি ইত্যাদি।
মানুষের সৃষ্টিশীলতা একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের জীবনধারা কতটা বদলে দেবে, তা অনুমান করা গেলেও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। হয়তো এয়ারপোর্টে রোবটরা ঘোরাঘুরি করবে। যাত্রীদের চোখের মণির দিকে তাকিয়ে বলে দেবে কার কোন দেশী পাসপোর্ট। কিংবা কার কোন দেশের ভিসা এবং টিকিট। হয়তো কাগজের টিকিট বা বোর্ডিং পাস বলে আর কিছু থাকবে না। বিমানের পাইলট এবং কেবিন ক্রুরা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট। এয়ারপোর্টে নেমেই পাওয়া যাবে চালকবিহীন ট্যাক্সি।
কে জানে সেদিনের প্রজন্ম হয়তো ডেকে নিয়ে আসবে সঙ্গীহীনতার মানবীয় কোনো সংকট!
লেখক: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা