কেন শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমন বাড়ছে ?
- আবদুল মান্নান
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শিক্ষার্থীদের গমন বেড়েছে। এক বছরেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশের বেশি। সংবাদটি দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালে মোট ৩৩ হাজার ১৩৯ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২ জন। এই দুই বছরের হিসাব মিলালে দেখা যাবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ৩৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার সন্ধানে গিয়েছে।
বাস্তব চিত্রটা এর চেয়ে ভিন্ন। প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি আগমন ঘটে মালয়েশিয়া (৬৫৩৪ জন) তারপর যুক্তরাষ্ট্রে (৫৪৪১ জন)। খোঁজ নিয়ে জানা যায় শুধুমাত্র মালয়েশিয়াতে বর্তমানে ১৫ হাজার বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করছে যেখানে প্রতিবছর গড়ে শিক্ষার্থী পিছু ২৪ হাজার মার্কিন ডলার দিতে হয়। ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরাতে পর্যন্ত ২০১৫ সালে ৬৪৪ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছে। আর এই সব দেশেও সার্টিফিকেট বাণিজ্যের দোকান আছে যেমন আছে যুক্তরাষ্ট্রে অথবা যুক্তরাজ্যে; যার ফলে অনেকে অর্থ ব্যয় করেও প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এমন কী ভারতেও অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা স্টাডি সেন্টার খুলেছে যেখানে সে সব দেশের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের দেশ থেকেও সেখানে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে।
এই সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে নিয়মিত শিক্ষামেলার আয়োজন করে (Education Fair), দোকান বসায় এবং বেশ চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করে, তারা বলে কাগজপত্র নিয়ে আসো, ভর্তি হও, ভিসার জন্য কাগজপত্র নিয়ে যাও এবং সময় মতো আমাদের দেশে চলে আসো। বাকি কাজ আমাদের, শুধু তোমাদের অর্থ ঢালতে হবে। এই মাসে ঢাকায় ভারতের এমন একটা মেলা হওয়ার কথা আছে। এর আগে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রেরও এমন মেলা বসেছিল। যুক্তরাজ্যতো এমন মেলা নিয়মিত বসায়। আর যারা মেলা বসায় না তারা এদেশে শিক্ষার্থী পাকড়াও করার জন্য বেশ কিছু এজেন্ট নিয়োগ করে। এসব এজেন্টরা শুধুমাত্র এজেন্ট হওয়ার মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখে না তারা বেশ চুটিয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্যও করে। টাকা দিলে এইসব এজেন্ট হতে মাস্টার্স, পিএইচডি’র সার্টিফিকেট ঘরেও পৌঁছে যায়। এইসব ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে অনেকে চাকরি করছেন এবং বেশ বহাল তবিয়তে আছেন। এই ডিগ্রি দেখিয়ে তারা নিয়মিত প্রমোশন সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেয়। যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা যে সবাই ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা যদিও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে তবে এটাও ঠিক আর একটি বড় সংখ্যা আছে যারা শুধু টাকার বিনিময়ে একটি বিদেশি মোহরওয়ালা সার্টিফিকেট কিনতে যায়। আবার একদল আছে যারা বিদেশে গিয়ে স্রেফ প্রতারিত হয়। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং বিরাট পরিমাণের অর্থ গচ্চা দিয়ে দেশে ফিরে আসে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে যারা বিদেশে যাচ্ছে তাদের পেছনে অভিভাবকরা যে অর্থ দিচ্ছেন তার একটা বিরাট অংশ কালো টাকা। একবার এক মাঝারি স্তরের সরকারি কর্মকতা আমাকে যখন বললেন তার দুই সন্তানকে তিনি কানাডায় পড়াচ্ছেন আমি অবাকই হয়েছিলাম। এই যে এত সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে যাচ্ছে তাদের পেছনে বাংলাদেশের একটি বিরাট পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রাও চলে যাচ্ছে। কালো টাকার মালিকরা শুধু তাদের কালো টাকা সুইস ব্যাংক বা পানামায় গচ্ছিত রাখেন না। তারা বিদেশে সেকেন্ড হোম কেনেন, কানাডায় ‘বেগম পাড়া’ তৈরি করেন, ছুটিতে বিনোদনের জন্য সপরিবারে বিলেত আমেরিকায় উড়ে যান। ছেলে বা মেয়ের বিয়ের বাজার করতে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ছুটেন এবং ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য নিয়মিত হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠান।
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া দোষের কিছু নয় তবে সেই যাওয়ার মধ্যে কিছু যৌক্তিক কারণতো থাকতে হবে। যেমন একজন শিক্ষার্থী যদি পরমাণু বিজ্ঞানে গবেষণা অথবা জ্বালানি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চায় তাকেতো বিদেশে যেতেই হবে। প্রতিবছর অনেক ছাত্র বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি অথবা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তা নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। তারা সেখানে উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা আর গবেষণা করছে। কেউ কেউ দেশে ফিরে আসছে অথবা ওই দেশে থেকে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের এই যুগে কেউ অন্যদেশে বৈধভাবে থাকতে চাইলে তা বন্ধ করারও কোনও উপায় নেই। আবার যে সব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অথবা গবেষক অন্য দেশে তাদের পেশায় যশ খ্যাতি অর্জন করে তা নিয়ে আমরা গর্বিতও হই। তবে যাদের কথা এখানে আলোচনা হচ্ছে না, তারা সকলে সেই শ্রেণির শিক্ষার্থী নয়। এখানে আলোচনা হচ্ছে তাদের কথা যারা হয় অভিভাবকের কালো টাকা আছে বলে তার জোরে একটি বিদেশি ডিগ্রির জন্য অন্য দেশে যাচ্ছে অথবা তাদের জন্য দেশে ভালোমানের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি বলে তারা বিদেশে ছুটছে। অনেকের অভিভাকরা এর জন্য ধার দেনাও করছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় দেড়শত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের অর্থে চলে এবং এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিনা খরচায় পড়ালেখা করা যায়। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো মানের শিক্ষক পাওয়া যায় না আবার পাওয়া গেলেও রাজনৈতিক চাপে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। এখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা অনেক ভালো তবে তার ব্যবহার সঠিকভাবে প্রায় সময় হয় না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চাপ অনেক বেশি। গেলো বছর একটি আসনের জন্য গড়ে ৩৯ জন ছাত্র ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদ ছাড়া অন্যান্য অনুষদে দুপুরের পর ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় না বললেই চলে। সুযোগ সুবিধা বিবেচনা করে এই সব অনুষদে একটি দ্বিতীয় শিফট পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন হবে বেশ কিছু নতুন শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকতা নিয়োগ, অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতো অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা আর পর্যাপ্ত পরিমাণের অর্থ বরাদ্দ। এ রকম ব্যবস্থা অনেক দেশেই চালু আছে। বাংলাদেশেও এর সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বেশ আগে একটি হিসাব নিকাশ করেছিল তবে তা বেশি দূর এগোয়নি ।
উচ্চশিক্ষার কথা আসলেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতেই হয়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। এটি যে একটি ভালো উদ্যোগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে যাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ভালো মানের শিক্ষা দেয় বলা যায়। আর এক তৃতীয়াংশ ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে। আর বাকিগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যবসা করা, সার্টিফিকেট বাণিজ্য করা। এদের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরী কমিশন কোনও ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ নিলে এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা সঙ্গে সঙ্গে আদালতে গিয়ে একটি স্টে (Stay) অর্ডার নিয়ে তাদের অবৈধ কার্যকলাপ পরিচালনা চালু রাখে এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সর্বনাশ করে। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় তার অন্যতম উদাহরণ। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চরম অনিয়মের কারণে সরকার বন্ধ করে দেয়। তারা যথারীতি আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং সেই মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় ২০১৬ সালে। এর মধ্যে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী প্রতারিত হয়ে বর্তমানে চরম বিপাকে আছে। এখানে শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকরা তাদের দায় এড়াতে পারেন না। মঞ্জুরী কমিশন নিয়মিত জনস্বার্থে বিজ্ঞাপন দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করে ভর্তির সময় যেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা মঞ্জুরী কমিশনের ওয়েবসাইট দেখে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়। যারা কমিশনের এই বিজ্ঞাপন অগ্রাহ্য করে তারা প্রতারিত হয়।
২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার খোলার সুযোগ রাখা হয়েছিল। কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় সে মতে আবেদনও করেছিল। কিন্তু এই পর্যন্ত কাউকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বুঝে শুনে নির্বাচিত কিছুকে অনুমোদন দিলে হয়তো শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও কমতো। সরকার হয়তো মনে করে থাকতে পারে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে আসতে সুযোগ করে দিলে দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে। তবে বর্তমানে যে হারে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার নামে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে আর তাতে যে পরিমাণে দেশের টাকা বাইরে পাচার হচ্ছে তা তো বন্ধ করার ক্ষমতা কারও তেমন একটা আছে বলে মনে হয় না। একই সঙ্গে যারা চলে যাচ্ছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশে ফিরছে না। টাকাও যাচ্ছে মেধাও পাচার হচ্ছে। এই সব বিষয় নিয়ে নীতি নির্ধারকদের এখনই চিন্তা করতে হবে। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নয়ন করতে পারলে, এক শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে তা বন্ধ হলে এবং নির্বাচিত কিছু বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিলে উচ্চশিক্ষার খোঁজে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বিদেশে পাচার কিছুটা হলেও বন্ধ হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করতে হবে।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক