পরীক্ষার ফলাফল নির্মাণ বা রেজাল্ট ইঞ্জিনিয়ারিং
- রাখাল রাহা
এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাশের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে সরকার যা বলেছে, যেমন উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা ইত্যাদি, তার মধ্যে কিছু সত্য আছে। পাশাপাশি যে কারণটা বলেনি তা হচ্ছে ২৮ পেলে ৩৩ করাসহ আরো যে কিছু নির্দেশনা অতীতে ছিল তা এবারে থামানো হয়েছে। সরকারের উচ্চারিত-অনুচ্চারিত এই কারণগুলোর বাইরে যে সত্য আমাদের জানা দরকার তা হচ্ছে এই কারণগুলো এখন কেন সৃষ্টি হলো, কেন কারণগুলো আগে বোঝা গেল না, বা সবসময়ই বিপর্যয়ের পরে কেন কারণগুলো ধরা পড়ে। কারণ সৃষ্টির পেছনের এসব কারণ বোঝার জন্য আমাদের একটু অতীতে গিয়ে কিছু বিষয় আলোচনা করতে হবে।
খেয়াল করি এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার ১৯৯০, ৯১, ৯২ ও ৯৪ সালে ছিল যথাক্রমে ৩১, ৬৪, ৬১ ও ৭১ শতাংশ প্রায়। পাশের হারের এই উলম্ফনের কারণ শনাক্ত করা হলো যে, গণিত ছাড়া সব বিষয়ে মাত্র ৫০০টি করে এমসিকিউ নির্বাচন করে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নব্যাংক ছাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ এতে যে-কেউ ৫০০টি এমসিকিউ মনে রাখতে পারলেই বা নকল করে ৫০ নাম্বার পেয়ে যাচ্ছে। আর ৩৩ নম্বর পেলেই যেহেতু পাশ তাই লিখিত পরীক্ষায় কিছু না লিখলেও গণিতে পাশ করলেই এসএসসি পাশ করা সম্ভব হচ্ছে।
এই কারণ উদঘাটনের পর প্রশ্নব্যাংক তুলে দেওয়া হলো, কিন্তু এমসিকিউ থেকে গেল। কিন্তু যে-কারণে প্রশ্নব্যাংক তৈরীর সময়ে সরকার ও তার আমলা-কর্তারা এই ‘জটিল’ বিষয়টি বুঝতে পারলেন না তা হলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে-তোলা হাইস্কুলে শিক্ষার্থী-সংখ্যা বাড়াতে হবে, না হলে বেতনবৃদ্ধি ও এমপিও-ভুক্তির চাপ সামলানো যাবে না। পাশের হার বাড়লে আপনিই শিক্ষার্থী বাড়বে, আর এভাবে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে-তোলা কলেজে শিক্ষার্থীর যোগান দেওয়াও সম্ভব হবে। জানা যাচ্ছে ১৯৯০ সালে হাইস্কুলে শিক্ষক-প্রতি গড়ে শিক্ষার্থী-সংখ্যা ছিল ২৪, আর ২০০০ সালে এটা হয় ৪৪।
আবার আমরা দেখি ২০০৩, ৬, ৮, ১২ ও ১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার ছিল যথাক্রমে ৩৫, ৫৯, ৭০, ৮৬ ও ৮৮ শতাংশ প্রায়। এসময়ে এই হার বৃদ্ধি মূলত প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষাকক্ষ পরিদর্শনে শৈথিল্য এবং উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে করা হয়েছে। এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার কমে হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। এর কারণ শনাক্ত করা হয়েছে যে, শিক্ষকদের সঠিকভাবে খাতা দেখার একটু ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ট্রেনিং এতো পরে কেন তার কারণ বেসরকারী কলেজে শিক্ষার্থী-যোগান, যেটা না-হলে বেতনবৃদ্ধি বা এমপিও-ভুক্তির চাপ বেড়ে যেতো। জানা যায় অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত এসব কলেজে ২০০৮ সালে শিক্ষক-প্রতি শিক্ষার্থী-সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫, আর এখন এটা প্রায় ২৫। পাশাপাশি সরকারী কলেজের সংখ্যা যেহেতু ৩০০ থেকে বাড়িয়ে প্রায় ৬০০-তে উন্নীত করা হচ্ছে ফলে কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর যোগান দেওয়ার তাগিদটা কমে যাচ্ছে।
একইভাবে এইচএসসি পরীক্ষার পাশের হারও যদি দেখি তাহলে দেখবো ২০০১, ৫, ৮, ১৪ ও ১৬ সালে এটা ছিল যথাক্রমে ২৮, ৫৯, ৭৪, ৭৮ ও ৭৪ শতাংশ প্রায়। এই হার বৃদ্ধিও মূলত প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষাকক্ষ পরিদর্শনে শৈথিল্য এবং উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে করা হয়েছে। এবার এইচএসসি-তে পাশের হার একটু কমে হয়েছে ৬৮ শতাংশ। এটারও কিছু ইতিবাচক কারণ এসএসসি-র মতোই শনাক্ত করা হয়েছে। একইভাবে এগুলো আগে শনাক্ত করতে না পারার কারণ হচ্ছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর যোগান নিশ্চিত করা। এখন যেহেতু অনেকগুলো কলেজ সরকারী হয়ে যাচ্ছে এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ব্যবসানুকূলে এসে গেছে সে-কারণে পাশের হার কমতে পারে। জানা যায় ২০০১ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-প্রতি গড়ে শিক্ষার্থী-সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ এবং ২০০৮ সালেই এটা হয়েছে ৪৫।
এসব কারণেই ধারণা করা যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক’বছর আগের বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। আগে তিনি যেখানে বলেছেন, “ছেলেমেয়েরা ফেল করবে কেন? তাদের ফেল করার কোনো সুযোগ নেই।”, বা প্রশ্ন তুলেছেন “শিক্ষার মানের মাত্রাটি কি? কোনোকিছুই রাতারাতিই পরিবর্তন সম্ভব নয়।”, সেখানে আজ বলছেন “পাশের হার বিবেচ্য নয়, মানুষ হওয়াটাই মুখ্য।” আর এসব বিষয়ে নানা সময়ে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী যা বলেছেন তা জাতির সাথে উৎকট রসিকতাতুল্য।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আশির দশকের প্রায় শুরু থেকে বিজ্ঞান বই ল্যাবরেটরি ও মাঠে গিয়ে হাতেকলমে শেখার উপযোগী করে নির্মাণ করা হলো। এর ফলাফল দেখা গেল ১৯৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪ ও ৯৫, এ পাঁচ বছরেই নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর ক্রমহ্রাসমান হার হয়েছে যথাক্রমে ৪২, ৩৬, ৩০, ৩০, ২৭ শতাংশ। এর কারণ এ ধরণের পাঠ্যবই ব্যবহারের সুবিধাযুক্ত স্কুলের সংখ্যা খুবই কম। কারণ শনাক্ত হলো এবং নব্বই দশকে আবার নতুনভাবে বই লেখা হলো। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আর বিজ্ঞানে ফেরেনি। তাহলে এমন বই কেন করা হয়েছিল? করা হয়েছিল প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে ফেলতে, আর উন্নত দেশের বিজ্ঞান ইত্যাদির দোহাই দিয়ে ব্যবস্থার সাথে বেখাপ্পা একটা কিছু ঢোকানোর প্রকল্পের মাধ্যমে ফায়দা লুটতে।
এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। এই সেদিনও শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা ৬টা বইয়ে শেষ করিয়ে মাধ্যমিকে যেতেই যে তাদের পিঠে ১৪ খানা বই চাপিয়ে দেওয়া হলো, এখন কারণ শনাক্ত করা হচ্ছে ভার বেশী হয়ে গেছে, কমাতে হবে।
আসলে আমাদের শাসকশ্রেণী ও তার সাথে যুক্ত আমলা-কর্তাদের সন্তানেরা এই শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে না। তাই তাদের মাথায় যা আসে এবং শিক্ষা বিষয়ে দুনিয়ায় যা কিছু দেখেন তাতেই ‘গুইসাপ গুইসাপ’ করে চিল্লিয়ে ওঠেন! তারা দেখতে চান না কোন কাঠামোর মধ্যে দুনিয়ার মানুষ কি দিচ্ছে, আর আমরা কোথায় কি দিতে চাচ্ছি। তারা কখনোই বুঝবেন না যে সর্বপ্লাবী অসৎ ও অদক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটা অগ্রবর্তী উদ্যোগও বাড়তি পতনের কারণ হতে পারে। কারণ এটা বুঝলে তাদের ফায়দা নেই। তাই তারা কখনো এই অসৎ ও অদক্ষ ব্যবস্থার কার্যকর উন্নয়ন করে না। উল্টো প্রতিনিয়ত চালু ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দোষ দেয় ব্যবস্থার। এরপর নতুন ব্যবস্থার প্রকল্প সাজায় এবং সেটা ব্যর্থ হলে তার কারণ খুঁজে আবার নতুন প্রকল্প ফাঁদে। এটাই তাদের উন্নয়ন। আর এহেন উন্নয়নের জন্য এদেশে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না।
কিন্তু আমরা যদি মনে করি এই দেশ আমার, এই দেশেই আমাদের সন্তানেরা থাকবে, তবে ওদের মুখের দিকে চেয়ে নতুনভাবে ভাবা ছাড়া উদ্ধার নেই।
রাখাল রাহ: আহ্বায়ক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির)
sompadona@gmail.com

 
	                
	                	
	            
 
	                       			                       	 
	                       			                       	 
	                       			                       	 
	                       			                       	