অদম্য তরুণদের অনন্য উদ্যোগ
- ড. ইয়াসমীন আরা লেখা
কবি কামিনী রায় তাঁর ‘সুখ’ কবিতায় লিখেছেন ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে…।’ ছোটবেলা থেকে এমনটি আমরা সবাই শিখলেও বাস্তবে তার প্রভাব খুব একটা দেখা যায় না। সবাই যদি অসাধারণ এই বাণীটি মেনে চলতেন তাহলে সমাজের চেহারাটাই অন্যরকম হতো। মানুষে মানুষে বিভেদ, সমাজে শ্রেণিবৈষম্য থাকত না। এত সংকট, সমস্যা ও জটিলতায় পড়তে হতো না সমাজের মানুষগুলোকে।
তবে কেউ কেউ যে মানুষের জন্য ভাবেন না, তা কিন্তু নয়। কিছু মানুষ এখনো পরের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন বলেই সমাজে ভারসাম্য রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কিছু মানুষ পরের জন্য স্বার্থহীনভাবে কাজ করে চলেছেন। তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে পরোপকারকে আপন ধর্ম মনে করে সমাজে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি রাজশাহী ও দিনাজপুরে এমন দৃষ্টান্ত দেখা গেল।
সংবাদপত্রের বদৌলতে জানা গেছে, রাজশাহীতে শিক্ষাবঞ্চিত ও ঝরেপড়া শিশুদের জন্য ‘আলোর পথে বিদ্যা নিকেতন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে। প্রতিষ্ঠানটি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠমুখী করার ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলও পাওয়া যাচ্ছে কমবেশি। আগে যেখানে অভিজাত এলাকার ধনী শিশুদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করত পাশে থাকা বস্তির শিশুরা, এখন তারা নিজেদের মাঝেই স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করতে পারছে। উদ্যমী কয়েকজন যুবক মিলে নগরীর ছোট বনগ্রাম পশ্চিমপাড়ার কৌইটা পুকুরে ২০১০ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করানো হতো। ২০১৫ সাল থেকে ৩ কাঠা জায়গা লিজ নিয়ে টিনের কয়েকটি ঘর তুলে শিশুদের পাঠদান করানো হচ্ছে। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আবু জাফর। সহযোগী হিসেবে আছে তারই কয়েকজন বন্ধু। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিকশিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব এ উপলব্ধি থেকে এ স্কুলের প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে ওই স্কুলে ১৫০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। শুধু শিশুরা নয়, ৮ থেকে ১০ জন শিশুর অভিভাবকও সেখানে লেখাপড়া করেন।
বস্তির প্রতিটি ঘর থেকে ঝরেপড়া শিশুদের পরম মমতায় নিয়ে এসে স্কুলটিতে লেখাপড়া করানো হয়। শিশুদের সঙ্গে ইচ্ছুক অভিভাবকরাও যোগ দিচ্ছেন। স্কুলটিতে রয়েছেন ৪ জন শিক্ষক। নামমাত্র সম্মানী নিয়ে তারা নিরলসভাবে শিশুদের পাঠদান করে যাচ্ছেন। উদ্যোক্তারা তাদের বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে স্কুলটি পরিচালনা করছেন।
সাধারণত আশেপাশে থাকা বস্তিগুলোর যেসব শিশু স্কুলমুখী নয় তাদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে স্কুলে নিয়ে আসা হয়। তারা বিনা বেতনে লেখাপড়া করে। শিক্ষার পাশাপাশি চিকিত্সার ক্ষেত্রেও স্কুল পরিচালনা কমিটির নজর রয়েছে। এখানে ভর্তি হওয়া শিশু ও তাদের পরিবারকে বিনামূল্যে চিকিত্সা সেবা দিতে এগিয়ে এসেছেন এমজি আজম নামে এক হোমিও চিকিত্সক। সপ্তাহে দুই দিন তিনি স্কুলে এসে বিনামূল্যে শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন ও প্রয়োজনীয় চিকিত্সাসেবা প্রদান করেন। তবে স্কুলটিতে টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা ও বিদ্যুত্ সঙ্কট রয়েছে। অনেক সময় অর্থের অভাবে শিক্ষার্থীদের খাতা, কলম ও বই দিতে অসুবিধা হয়। শিক্ষকদের নিয়মিত সম্মানী দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও উদ্যোক্তারা শিশুদের শিক্ষা প্রক্রিয়া থামিয়ে রাখেননি। আগামী বছর থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
অপর প্রতিষ্ঠানটি দিনাজপুরের। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘মজার ইস্কুল।’ শিক্ষা প্রক্রিয়া থেকে ঝরেপড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে আলো ছড়াতে শিশুবান্ধব এ ‘মজার ইস্কুল’। স্কুলের মধ্যে গড়ে তোলা এ স্কুলের শিক্ষক হলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ শিক্ষার্থী। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামগুলোতে অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশু বাস করে। অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা এসব শিশু শিশুশ্রমে ঝুঁকছে। তারা লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহী হলেও বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্য ও পারিবারিক সহযোগিতার অভাবে। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ শিক্ষার্থীকে। তারা আশপাশের এলাকায় ঘুরে শিক্ষানুরাগী ঝরেপড়া কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খুঁজে বের করে। তারা মানুষের জন্য কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্কুলটি গড়ে তুলেছে।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাশে স্কুলটির অবস্থান। স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় না কিংবা দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিশুশ্রমে ঝুঁকছে এমন পরিবারের শিশুরা ‘মজার ইস্কুল’-এর ছাত্র। নিয়মিত স্কুলের কার্যক্রম শেষে বিকালে শুরু হয় ‘মজার ইস্কুল’-এর কার্যক্রম।
‘নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়া, মজার ছলে শেখাবো মোরা’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর ‘মজার ইস্কুল’-এর যাত্রা শুরু। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থী এ উদ্যোগে শামিল হন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম ব্যাচের ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী ‘মজার ইস্কুল’-এ সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস নেন। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চলে এ ক্লাস। ‘মজার ইস্কুল’-এর শিক্ষকদের মমতায় মুগ্ধ শিশুরা প্রতিদিন ছুটে আসে লেখাপড়া করতে।
স্কুলে আসা সব শিশুকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ও নাস্তা দেওয়া হয়। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মানসিক পরিশুদ্ধতার জন্য সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা এবং খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া হয়। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার চিত্রাঙ্কন, নাটক, গান, মানসিক স্বাস্থ্য, ভালো ব্যবহার তথা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যা যা প্রয়োজন সব বিষয়েই আলোকপাত করা হয়। মাসে একবার মিনা কার্টুন দেখানো হয়। স্কুলে নিয়মিত আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ১২০ জন। এ স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া প্রায় ২০ জনের মতো শিক্ষার্থী অনিয়মিতভাবে ক্লাস করতে আসে। মজার স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের ভর্তির ব্যবস্থাও করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কর্নাই, নন্দাপাড়া, হাজীপাড়া, শুভ্রা, মহাবলীপুর গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই এ মজার ইস্কুলের শিক্ষার্থী। এ স্কুল পরিচালনায় যাবতীয় খরচ শিক্ষকরা নিজেরাই বহন করেন। বন্ধু-বান্ধব ও সতীর্থদের অনেকেই স্কুলটির সঙ্গে মানসিক ও আর্থিকভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন, যা উদ্যোগ গ্রহণকারীদের আশ্বস্ত করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিকেও শক্তিশালী করছে।
রাজশাহী ও দিনাজপুরের এই উদ্যমী তরুণদের মতো আমরাও যদি সমাজের জন্য কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে এখন থেকে কাজ শুরু করি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনেক উপকৃত হবে। সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যদি সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হই, তাহলে বাংলাদেশ নিরক্ষরমুক্ত হতে সময় লাগবে না। আমাদের মধ্যে অনেকের সামর্থ্য থাকলেও সমাজে পিছিয়ে পড়াদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এখন সময় এসেছে এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সমাজ বিনির্মাণের। দারিদ্র্যের কষাঘাতে যে শিশুটি লেখাপড়া করতে পারে না তার প্রতি আমাদের সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বও কম নয়। কেননা, প্রতিটি সামর্থ্যবান মানুষেরই দায়িত্ব আছে তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু অপরের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার। তাই, সমাজে বিত্তশালী ও সামর্থ্যবান সবার প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে শিক্ষার আলো জ্বালাতে এগিয়ে আসুন। আমরা যদি সবাই মিলে পরিপূর্ণ শিক্ষিত একটি জাতি গড়ে তুলতে পারি তাহলেই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এমন বাংলাদেশ গড়তে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের দায়িত্বও কম নয়। আর সাফল্য এলে আমরা ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে…’ উক্তিটির সার্থকতা প্রমাণ করে দেশ গঠনে আমরা আমাদের ভূমিকা নিয়ে গর্ব করতে সক্ষম হব।
লেখক: উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি