প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোটার যন্ত্রণা
- সিরাজী এম আর মোস্তাক
১৯ মে, ২০১৭ তারিখে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী চাকুরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছিল। সকালে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ওঠে। আর সরাসরি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে বিকালের পরীক্ষার ঠিক আগ-মুহূর্তে পরীক্ষা বাতিল করা হয়। বলা হয়, পরীক্ষার তারিখ পরে জানানো হবে।
সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার রয়েছে। তারা নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। পাঁচ-দশটি খালি পদের বিপরীতে লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী আবেদন করছেন। আমাদের দেশে নিয়োগ পরীক্ষাগুলো অধিকাংশই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। তাই প্রায় সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার বেকার ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা তথা পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ঢাকায় যাতায়াতে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগে। একটি দরিদ্র পরিবারের একজন বেকারের পক্ষে এ টাকা জোগাড় করা যে কতটা কষ্টকর, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারে। এ কষ্টের টাকায় বেকাররা সারারাত গাড়িতে আসে এবং পরীক্ষা দিয়ে আবার রাত জেগে গাড়িতে বাড়ি ফেরে। অতি কষ্টের টাকায় বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত তারা শুধু পাউরুটি-কলা বা বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে কোনোমতে দিন-রাত কাটিয়ে দেয়। এত কষ্টে ঢাকায় এসে যখন শোনে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল তখন তাদের কেমন লাগে? শাসকেরা কখনো কি এ বিষয়টি ভাবেন? এ বেকাররা বিলবোর্ডে যখন দেখে, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে অথচ তাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই, তখন কেমন লাগে?
এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধা কোটার কারণে বেকাররা চরম ক্ষুব্ধ, তার ওপর প্রশ্নপত্র ফাঁসের যন্ত্রণা যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রতি এতটা গুরুত্ব দিয়েছে যে, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকার বিগত ৪০ বছরের মুক্তিযোদ্ধা কোটা-ঘাটতি পূরণ করেছে। যেমন ধরুন, কোনো প্রতিষ্ঠানে ১৯৭৫ সাল থেকে এযাবত্ ৫০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাতে শতকরা ত্রিশভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা হিসেবে ১৫০ জন নিয়োগের কথা। বিভিন্ন সরকারের গাফিলতি বা বিশেষ কারণে হয়ত ১০০ জন নিয়োগ পেয়েছে। অর্থাত্ ৫০টি কোটাপদ ঘাটতি হয়েছে। একইভাবে, বর্তমানে উক্ত প্রতিষ্ঠানে ৭০টি পদ খালি হয়েছে। এর ত্রিশভাগ কোটায় ২১টি এবং আগের ঘাটতিপদ ৫০টি মিলে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাতেই হয়েছে। এভাবে বিসিএস, ব্যাংক-বীমা, সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালন হয়েছে। এতে যা হবার তাই হয়েছে। একসঙ্গে বিশাল সংখ্যক খালি পদে শুধু দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা এককভাবে নিয়োগ পেয়েছে। আর কোটা বহির্ভূত ছাব্বিশ লাখ বেকার যথেষ্ট যোগ্যতা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছে। এ বঞ্চিতদের কষ্ট দেখার বা বোঝার কেউ নেই।
বাংলাদেশে ১৬ কোটি নাগরিকের মধ্যে মাত্র দুই লাখ পরিবার কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পায়, তা কারো বোধগম্য নয়। যে দেশে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হন, সে দেশে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে তালিকাভুক্ত হয়? তা হলে কি মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনকারী ত্রিশ লাখ বীর সেনা মুক্তিযোদ্ধা নয়? পৃথিবীর কোথাও শহীদেরা যোদ্ধা তালিকার বাইরে নয়। যোদ্ধা ও শহীদের সংখ্যাগত এত ব্যবধান কোথাও নেই। শুধু বাংলাদেশেই ত্রিশ লাখ শহীদকে বঞ্চিত করে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এভাবে মেধাবী যুবসমাজকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তারা বেকারত্বের যন্ত্রণা ভোগ করছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের যন্ত্রণা এতে অসহনীয় মাত্রা যোগ করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মুক্তিযোদ্ধা কোটার এ যন্ত্রণা শাসক গোষ্ঠীর জন্য বুমেরাং হতে পারে।
তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীল মহলের কাছে আরজি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্য ও বঞ্চনা, আর মানতে পারছি না। দয়া করে বেকার যুবসমাজের যন্ত্রণা একটু দেখুন। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী পাপিষ্ঠদেরকে দেশদ্রোহী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী ঘোষণা করুন। তাদেরকে শক্ত হাতে দমন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোটা বৈষম্যের শিকার যুবসমাজের দিকে সুনজর দিন।
লেখক :শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা