ব্যবসা বাড়াতে হলে…
- অজয় দাশগুপ্ত
আশির দশকে এইচএম এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ‘এক্সপোর্ট লেড গ্রোথ’ বহুল আলোচিত তত্ত্ব ছিল। তখন তৈরি পোশাক রফতানির ইস্যুটি সামনে এসেছিল। বিশ্বে পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তারা পূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বাইরে আমদানির উৎস খুঁজছে। ওইসব দেশ তখন রফতানি বাণিজ্যে সফলতার মাধ্যমে সচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ তখন অর্থনীতিতে তাদের তুলনায় ঢের পিছিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশকে তাদের দেশে নামমাত্র শুল্কে কিংবা বিনা শুল্কে পণ্য রফতানির সুবিধা দিতে চেয়েছে এবং বাংলাদেশের কিছু উদ্যোক্তা সেটা গ্রহণ করতে এগিয়ে গেছে। এইচএম এরশাদের সামরিক সরকার সে সময় শুল্ক ও কর নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে রফতানি বাড়াতে পলিসি সাপোর্ট দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখা পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের পোশাক শিল্পের বিকাশে গোড়ার দিকে বড় ধরনের ভূমিকা রাখেন। তিনি পোশাক উৎপাদন ও রফতানির কলাকৌশল জানার জন্য এক দল শিক্ষিত তরুণকে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়েছেন। তারা ফিরে এসে এ শিল্পকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে পোশাক রফতানি থেকে আয় করতে চায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। মাত্র চার বছরে বর্তমানের ৩০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন মোটেই সহজ নয়। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পোশাকসহ সব খাত মিলিয়ে আমাদের রফতানি আয়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবতা আর স্বপ্নে যে অনেক ব্যবধান! পোশাকের বাইরে আরও অনেক খাতের পণ্য চাই রফতানি আয় বাড়াতে। কীভাবে তা সম্ভব?
কয়েক দিন আগে থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম। থাই এয়ারওয়েজ ঢাকা-ব্যাংকক ফ্লাইট বাড়িয়েছে। প্রতিদিন দুটি সুপরিসর বিমান ঢাকা থেকে ব্যাংকক যায়, দুটি আসে। বাংলাদেশ থেকে পর্যটকরা যায় সে দেশে। আবার অন্য দেশে যাওয়ার জন্য ব্যাংকককে ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। থাই এয়ারওয়েজ তাদের ফ্লাইটের সময়সূচি নির্ধারণে যাত্রীদের সুবিধার দিকটি বিবেচনায় রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতকারীদের বেশিরভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, এটা তাদের জানা। তাই খাবারের আয়োজনে ‘হালাল খাবার’ স্থান পেয়েছে। ব্যাংককে থাই এয়ারওয়েজের বিমানযাত্রীদের যে রান্নার বিশাল আয়োজন, সেখানেই হালাল খাবার তৈরি হয়। এ জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা। প্রতিদিন থাই এয়ারওয়েজ সাত থেকে আট হাজার প্যাকেট এ ধরনের খাবার তৈরি করে, যার একটি অংশ অন্য বিমান কোম্পানির যাত্রীদের জন্যও সরবরাহ করা হয়।
ব্যবসা বলে কথা! প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, থাইল্যান্ডের ৯৩ শতাংশের বেশি নাগরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মুসলিম মাত্র ৫ শতাংশ।
ভারতে এখন বিজেপির শাসন চলছে। এ দলটি হিন্দুত্ববাদের আদর্শের জয়গান গায়। মুসলিমবিদ্বেষী সুর অনেক নেতার কণ্ঠে। সম্প্রতি সে দেশেরই এক যুবকের সঙ্গে দেখা, যিনি ‘হালাল ইন্ডিয়া’ নামে একটি সংস্থায় কাজ করেন। তিনি বলেন, খাদ্য কিংবা ওষুধ ইসলামী শরিয়াসম্মতভাবে তৈরি কি-না- সে বিষয়ে এ সংস্থা সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। কেন এটা করেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারতের অনেক পণ্য মুুসলিম বিশ্বে রফতানি হয়। আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায় বসবাসকারী অনেক মুসলিমও হালাল পণ্য পছন্দ করে। এ বাজার অনেক বড়। তাই ভারতের রফতানিকারকদের উৎসাহিত করা হয় এ বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনে। একইভাবে ইহুদি সম্প্রদায়ের চাহিদামতো পণ্য উৎপাদনের জন্যও ভারতে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ব্যবসা বাড়াতে তা সহায়ক হয়।
ব্যবসা বাড়াতে কত ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, সেটা দেখেছি আরও অনেক স্থানে। ব্যাংককের ভেজথানি নামে একটি হাসপাতালে। সেখানের একটি কক্ষের বাইরে লেখা- ভিসা সেকশন। বিভিন্ন দেশের রোগীরা সেখানে চিকিৎসার জন্য যায় ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে। অথচ অপারেশন কিংবা জটিল কোনো রোগের চিকিৎসার জন্য বেশি দিন থাকতে হয়। এ জন্য ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই এ কাজটি করে দেয়। এ জন্য অবশ্যই অর্থ দিতে হয়। কিন্তু ভিন্ন ভাষাভাষীর দেশে এমন সহায়তা পেলে কিছু অর্থ ব্যয়ে দোষ কী? ওই হাসপাতালেই দেখা গেল একটি কক্ষের সামনে লেখা- নামাজের স্থান। পাশেই একটি ভবন রোগীর সঙ্গে আসা ব্যক্তিদের জন্য। সেখানে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। হাসপাতালে মিডিয়া সেকশনে কাজ করেন বাংলাদেশের মেয়ে নাদিয়া। তাকে জিজ্ঞেস করি- অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করেই কোনো রোগী ব্যাংককে গেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে ক’দিন অপেক্ষা করতে হয়? উত্তর মেলে- ক’দিন নয়, দু’চার ঘণ্টার মধ্যেই এ ব্যবস্থা করা হয়। গুরুতর অসুস্থ রোগীরা তো এমন সুবিধাই চায়।
বাংলাদেশে গত সাড়ে চার দশকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। উদ্যোক্তা, শ্রমজীবী নারী-পুরুষ ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের অক্লান্ত শ্রম-মেধার কারণে অর্থনৈতিক উন্নতি এখন দৃশ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে আমরা এগিয়েছি। আবার অনেকে দুঃখ করে বলেন, ষাটের দশকে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ অর্থনীতিতে ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কাতারে; বিশ্বে পেছনের সারিতে। এখন তারা অনেক এগিয়ে গেছে। আর বাংলাদেশ কেবল সম্প্রতি উন্নয়নের সিঁড়িতে ওঠার জন্য পা ফেলতে শুরু করেছে। সন্দেহ নেই, কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে পরনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। উন্নত বিশ্ব ও বিশ্বব্যাংক-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ মঞ্জুর না হলে আমাদের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব হতো না। অথচ এখন আমরা নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য।
আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটছে। প্রায় পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী নিয়ে অবশ্যই বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। স্বাস্থ্যসেবার প্রসার ঘটছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে বিপুলভাবে।
কিন্তু এত অর্জনের পরও অনেকের মনেই প্রশ্ন- যতটা অর্জন হতে পারত, ততটা কি হচ্ছে? এর উত্তর সহজ- আমরা পারছি না। কেন পারছি না- এ প্রশ্নের উত্তরে দুর্নীতির কথা বলা হয় সর্বাগ্রে। এটাও বলা হয়- প্রশাসন যথেষ্ট দক্ষ নয়। অন্যদিকে, রাজনীতির স্বার্থের কাছে প্রায়শ অর্থনীতির স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হয়। এ জন্য বিশেষভাবে দায়ী করা হয় রাজনীতিবিদদের। আশার কথা, আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটার পাশাপাশি অর্থনীতির স্বার্থকে বেশি বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। তবে এখনও যে অনেক পথ চলার বাকি এবং সে পথে স্বচ্ছন্দে চলতে হলে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের উন্নয়নের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এখন কানেকটিভিটি বিশেষভাবে আলোচনায়। বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও একটু দূরের দেশ চীনের সঙ্গে কানেকটিভিটি বাড়াতে চাইছে। নেপাল ও ভুটান রয়েছে এ তালিকায়। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডও হতে পারে বড় গন্তব্যের দেশ। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর বিপুল সুযোগ তৈরি হবে।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ওইসব দেশের রাজনীতিতে অনেক অনিয়ম ছিল। এখনও রয়েছে। নিষ্ঠুর সামরিক শাসন সহ্য করতে হয়েছে তাদের জনগণকে। শাসকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রায়শ। বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ শাসকদের আনুকূল্য পেয়ে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি করে। ওইসব দেশ সম্পর্কে আরও অভিযোগ- যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক-রাজনৈতিক স্বার্থে নিজেদের ব্যবহৃত হতে দেওয়া। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল। তবে এটাও ভুললে চলবে না, এই সুযোগে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ নিজেদের অর্থনীতি গুছিয়ে নিয়েছে। একই সঙ্গে ভিয়েতনামের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়েছে। যুদ্ধকালীন তিক্ততা ভুলে ভিয়েতনামও এখন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ভিয়েতনামের অনেক পণ্য যায় মার্কিন মুল্লুকে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মালিকরা একটি বিষয়ে উদ্বিগ্ন_ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে।
থাইল্যান্ডের পাতায়া পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের কক্সবাজারের তুলনায় সেখানকার সমুদ্রসৈকত একেবারেই সাদামাটা। কক্সবাজারের সৈকত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৈকত হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজারের কাছেই আছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সম্প্রতি চালু হয়েছে ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ। ছুটির দিনগুলোতে কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় প্রচুর পর্যটক যায়। তবে পর্যটক আকর্ষণে কেবল বড় সৈকত থাকলেই হয় না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকতে হয়। পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ থাকতে হয়। নঙনুস বোটানিক্যাল গার্ডেনের কথাই বলি। পর্যটকরা মনোমুগ্ধকর এ বাগানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াতে পারেন। কাছেই একটি মিলনায়তনে রয়েছে চমৎকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। এ অনুষ্ঠান দেখেই কেউ যেতে পারে এক দল হাতির নানাবিধ কাণ্ড দেখতে। হাতিকে কলা খাওয়াবেন- সে জন্য গড়ে উঠেছে কলার বড় ব্যবসা। হাতিকে কলার কাঁদি তুলে দিতেই সে সঙ্গোপনে তা পাচার করে দেয় ব্যবসায়ীদের কাছে। হাতির শুঁড়ের সঙ্গে ঝুলে ছবি তুলবেন, সে জন্য দিতে হয় আমাদের মুদ্রায় ২৫০ টাকা। অনুষ্ঠান চলাকালে হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দেয় দর্শকদের দিকে। তাতে মেলে অঢেল বাথ (থাই মুদ্রা)। আমি মজা করে বলি- এ যে হাতি দিয়ে চাঁদাবাজি। কিন্তু দর্শকরা, বিশেষ করে শিশুরা এটা খেলা হিসেবেই গ্রহণ করে।
থাইল্যান্ডের সর্বত্র খাবারের দোকান। কেনাকাটার জন্যও সুখ্যাতি আছে। বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণের অন্যতম গন্তব্য এ দেশটি। চিকিৎসার জন্যও অনেকে এ দেশটিকে বেছে নেয়। থাই এয়ারওয়েজ এ বিষয়টি উপলব্ধি করে। এ কারণে বেড়েছে তাদের ফ্লাইট সংখ্যা। আকাশে থাকা অবস্থাতেও যাতে কেউ হালাল খাবার চাইলে সমস্যায় না পড়ে, সে বিষয়টির প্রতি তারা নজর রেখেছে। ব্যবসা বাড়াতে কত কিছুর প্রতিই না নজর দিতে হয়!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক