উচ্চশিক্ষার ব্যয় বাড়ানো উচিত কি ?
- ওমর শরীফ পল্লব
সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার ব্যয় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হবে, এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দেশের সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এনজিওদের সঙ্গে রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রাক-বাজেট তিনি এ কথা বলেন। কিন্তু কেন এ ব্যয় বৃদ্ধি? উচ্চশিক্ষা যদি একটি নির্দিষ্ট আয়ের লোকজনের হাতেই থাকে, অন্যরা সে সুযোগ না পায় তাহলে কি হবে দেশের চিত্র, ভেবেছেন কি?
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা
উচ্চশিক্ষায় বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রাইভেট কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে এসেছে। প্রথমে ব্যয়বহুল এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ সন্দেহ অনেকটাই দূর হয়েছে। তবে তারা শুধু সহজে পড়ানো যায় এবং বাজারে কাটতি রয়েছে এমন কয়েকটি হাতে গোনা বিষয়েই পাঠদান করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়গুলো তারা পড়ায় না। পাশাপাশি তারা একটি ভয়ঙ্কর বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছে—শিক্ষার উচ্চ ব্যয়। যে পরিবারের একজন সদস্য সরকারি কিংবা কম ব্যয়ের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চান্স পায় না তারা স্বভাবতই ঋণ করে হলেও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীকে জমিজমাও বিক্রি করতে হয়। আর এ বিষয়টিকেই যেন স্বাভাবিক বলে মনে করছেন অনেক নীতিনির্ধারক। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, প্রাইভেটে এত খরচে পড়তে পারলে কেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এত কম খরচে পড়ার সুযোগ থাকবে। ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই যেন মাপকাঠি হিসেবে ধরা হচ্ছে।
সক্ষমতার প্রশ্ন
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কি ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সামর্থ রয়েছে? এ বিষয়ে পরিসংখ্যানের সহায়তা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বাংলাদেশের শতকরা ৮০টি পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে।
সর্বশেষ সরকারি হিসাবে দেখা যায়, আয়ের দিক থেকে নিম্ন স্তরের ৭০ শতাংশ মানুষের হাতে মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ৩৭ শতাংশ রয়েছে। উল্টোদিকে আয়ের দিক থেকে ওপরের স্তরের ২০ শতাংশ মানুষের হাতে ৪২ শতাংশ, ৫ শতাংশের হাতে ২৫ শতাংশ জাতীয় আয়। অবশ্য এই হিসাবে কালো টাকা ধরা হয়নি। জনসংখ্যার অতি সামান্য একটি অংশ, যারা অবৈধভাবে আয় করে কিংবা কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, তাদের এ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে তা সাধারণ মানুষের শিক্ষার ভরসাস্থল হিসেবেই কাজ করা উচিত। যে পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে, সে পরিবারের মেধাবী সন্তানের পড়ার সুযোগ করে দেওয়াই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
যদি উচ্চশিক্ষা শুধু ধনীদেরই জোটে…
ধনী যে পরিবারের সন্তান সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাবে না, তাদের জন্য ব্যয়বহুল বেসরকারি শিক্ষার ব্যবস্থা তো রয়েছেই। কিন্তু সেটাকে যদি সব মানুষের শিক্ষার জন্য মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয় তাহলে ৮০ শতাংশ পরিবারকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা হবে। এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে দেখা যাবে শুধু ধনীদের সন্তানেরাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ধনীদের সন্তানরাই শুধু উচ্চশিক্ষিত হয়ে উঠবে। দেশের আপামর জনসাধারণ তথা কৃষক, সাধারণ চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কামার, কুমার, তাতি, জেলে ইত্যাদি পেশাজীবীদের সন্তানেরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। এমনিতেই তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ অত্যন্ত কম। এরপর সে সুযোগটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে শিক্ষিতদের একটি বিশেষ শ্রেণী তৈরি হবে। আর উচ্চবিত্তের সন্তানেরা উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় ক্রমে সরকারি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, ব্যাংক-বীমা ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সব সেই বিশেষ শ্রেণীর হাতে আরো বেশিমাত্রায় কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। আপামর জনসাধারণের সঙ্গে শিক্ষিত সেই বিশেষ শ্রেণীটির বিশাল ব্যবধান তৈরি হবে।
বিদেশের সঙ্গে তুলনা
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বেশি। আর তাই উচ্চশিক্ষার ব্যয় নিয়ে যে কোনো আলোচনায় অনেকেই বিদেশের সঙ্গে তুলনা করছেন। যদি ইংল্যান্ডের কথা বলা হয় তাহলে আংশিক নয় বরং পুরো বিষয়টিই বলা উচিত। তাদের শিক্ষার ব্যয় যেমন বেশি তেমন সে ব্যয় যেন মেটানো যায় সেজন্য আয়ও বেশি। একজন শিক্ষার্থী পার্ট টাইম জব করেই শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করতে পারে।
আপনি যদি একটি যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার খরচ বিষয়ে ওয়েবসাইটে ক্লিক করেন তাহলে দেখতে পাবেন সেখানে কয়েক ধরনের ফি দেওয়া থাকে। একটি মধ্যম মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ার খরচ স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড। অবশ্য একই কোর্স পড়ার খরচ বিদেশিদের জন্য আরও পাঁচ-ছয় হাজার পাউন্ড বেশি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার খরচের একটি বড় অংশ দিয়ে দেয় সরকার (বিদেশীদের দেয় না)।
যুক্তরাজ্যের মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার পাউন্ডের বেশি। তার পরেও তাদের উচ্চশিক্ষার ব্যয় সে তুলনায় বেশি নয়। উপরন্তু শিক্ষার্থীরা ঋণ নিয়েও শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করতে পারে। প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাইটে শিক্ষার ব্যয় বিষয়ে তথ্য দেওয়া থাকে, সেখানেই থাকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে তথ্য। খুব সহজেই এ ঋণ নেওয়া যায়। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে এ ঋণ শোধ করার সুযোগ থাকে। উদাহরণস্বরূপ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটটি দেখুন- ইন্টারন্যাশনাল এমবিএ। এখানে কোর্স ফি ৯,৯০০ পাউন্ড হলেও ১০,২৮০ পাউন্ড শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা করা আছে। এছাড়া কোর্স ফির অতিরিক্ত কোনো অর্থই প্রয়োজন হয় না। এমনকি বইপত্রও সব দেওয়া হয় এ টাকাতেই। ফলে শিক্ষা ব্যয় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে না শিক্ষার্থীদের।
কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের ঋণের ব্যবস্থা নেই। ফলে শিক্ষার ব্যয় প্রত্যেকের বাবা-মায়ের টাকা কিংবা নিজেদের প্রাইভেট পড়ানো ও এ ধরনের ছোটখাট কাজের মাধ্যমে জোগাড় করতে হয়। যার ফলে শিক্ষার ব্যয় সামান্য বৃদ্ধিও একজন শিক্ষার্থীর নিকট বহন করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠবে।
নির্মম বাস্তবতা
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে ব্যয়, তা বহন করাই বহু শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ভর্তির সময় বহু বিশ্ববিদ্যালয়ই বেশ কয়েক হাজার টাকা ভর্তি ফি নেয়। যা এখনই একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপর রয়েছে নিয়মিত বেতন, সেশন ফি ইত্যাদি। দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা একজন শিক্ষার্থী যদি হলে থাকার সুযোগ পায় তাহলে কিছুটা কম খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে মেসে বা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হলে তার জন্যও বাড়তি খরচ বহন করতে হয়। ঢাকা বা বড় কোনো শহরে থাকা ও খাওয়ার খরচও কম নয়। এছাড়া যাতায়াতের জন্যও বড় অংকের খরচ করতে হয়। কাগজপত্র, বই কেনা ও ফটোকপির খরচও কম নয়। হঠাৎ করে চাকরি কিংবা কাজের সুযোগও মেলে না। এসব খরচ বহন করতে না পেরে শিক্ষাজীবন শেষ করতে না পারা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়।
এ নির্মম বাস্তবতার মাঝে একজন শিক্ষার্থীর ওপর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা আরও না চাপিয়ে বর্তমান শিক্ষার ব্যয়কেই বরং আরও কমিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। অন্যথায় উচ্চশিক্ষা শুধু একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতেই থাকবে। দেশের সাধারণ জনগণের সঙ্গে সে বিশেষ ‘উচ্চশিক্ষিত’ শ্রেণীর প্রকট বৈষম্য তৈরি হবে, যা মোটেই সুখকর হবে না।