শিক্ষা বনাম শিক্ষাঙ্গন
- হোসনে আরা বেগম
শিক্ষার মধ্যে থাকবে আনন্দ আর শিক্ষাঙ্গনে থাকবে শৃঙ্খলা। শিক্ষা এবং শিক্ষাঙ্গন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নামি-দামি প্রতিষ্ঠান হলেই যে সেখানে ভালো ফল পাওয়া যাবে, এমন কথা নেই। দেখতে হবে, শিক্ষকরা কতটুকু নিবেদিতপ্রাণ। একসময় শিক্ষকতা পেশায় আসতেন ত্যাগী, নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের আনন্দের ভেতর দিয়ে পড়াশুনা করানো যায়। তাদের ধ্যান-ধারণাই ছিল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দানে। সে শিক্ষাদান ছিল নিখাঁদ। সমাজে তখন তাদের সম্মান ছিল সুউচ্চে। শিক্ষকতা পেশায় আজ আর আগের মতো ত্যাগী মানুষের দেখা পাওয়া ভার। আগে যারা পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বা শিক্ষকতা করাই যাদের ব্রত ছিল, তারাই এ পেশায় আসতেন। বর্তমানে তা আর তেমন নেই। তার কারণ হচ্ছে, বর্তমানে শিক্ষকতা পেশাটাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়নি। যার ফলে সত্যিকার অর্থে মেধাবী, প্রতিভাবান তরুণরা আজ শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। তারা আর্থিক লোভনীয় পেশার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন। অন্য পেশার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে যখন স্বল্প মেধার তরুণরা এ পেশায় আসছেন, তখন তারা অতিরিক্ত রোজগারের জন্যে কেউ করছেন টিউশনি, কেউবা করছেন সাইড বিজনেস।
তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মাঝে আগের শিক্ষকদের সেই কমিটমেন্ট আর পাওয়া যায় না। শুধু কি তাই? কতিপয় শিক্ষক নামধারী ব্যবসায়ী জ্ঞান বিতরণের নামে অর্থ উপার্জনকে মুখ্য বলে মনে করেন। তাদেরকে শিক্ষক পদবাচ্যে ফেলা যায় না। তারা শ্রেণিতে পড়া বোঝাতে চান না। অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে প্রাইভেট পড়ার জন্যে শিক্ষার্থীদের একরকম বাধ্য করেন। ওরা বুঝতে চান না, এতে শিক্ষকদের কতটুকু সামাজিক মর্যাদা কমে যাচ্ছে। এমনিতেই আজ আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, এখন আর কেউ কাউকে মানুষ বলে গণ্য করতে চায় না। শিক্ষকদের যদি এমন হাল হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কি তাদের মানতে চাইবে? এখন শিক্ষার্থীরা আর আগের মতো সাদামাটা জীবন-যাপন করে না। তাদের জীবন-যন্ত্রণা এখন এত বেশি যে, এরা মানুষকে মানুষ বলেই মানতে চায় না। ফলে, আজ আর আগের দিনের সেই নির্মল শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নেই বললেই চলে। তবে এ কথা ঠিক, আজো সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের অভাব নেই। আর এসব শিক্ষকের প্রতি আজো শিক্ষার্থীদের একইরকম নির্মল শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।
স্রোতের একটা অমোঘ শক্তি আছে—যেদিকে ছোটে, সবকিছু নিয়েই ছোটে। তবে দক্ষ মাঝি তার অদম্য শক্তিতে স্রোতের বিপরীতে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে পারেন। সুধীজনেরা মনে করেন, বর্তমানে গড্ডলিকা প্রবাহের মতো শিক্ষার্থীরা বিপথগামী হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে এদের বিপথগামী হতে দেওয়া যাবে না। দক্ষ মাঝির মতো দক্ষ শিক্ষকই পারেন এসব বিপথগামী শিক্ষার্থীকে সঠিক পথের দিশা দিতে। শিক্ষক যদি তার আত্মশক্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের আমাদের সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করেন এবং কোন্টা ভালো, কোন্টা মন্দ তা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে পারেন, তাহলে ওরা বিপথগামী হবে না। শ্রেণিকক্ষে শুধু পাঠ্যবই পড়িয়ে পরীক্ষা পাসের বা বেশি নম্বর পাওয়ার চিন্তা করলে শিক্ষার্থীরা হাবুডুবু খাবে। শিক্ষার প্রকৃত আনন্দ থেকেও ওরা বঞ্চিত হবে।
অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে ভালো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের খোঁজে হন্যে হয়ে ছোটেন। এখন প্রশ্ন হলো—ভালো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বা মন্দ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা কী বুঝি? চাকচিক্যপূর্ণ ইট-কাঠের বিশাল প্রতিষ্ঠান হলেই যে সেটা ভালো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হবে, এমন কথা নেই। অপরদিকে জরা-জীর্ণ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হলেই যে সেটা মন্দ প্রতিষ্ঠান হবে এমন কথাও নেই।
প্রত্যেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক নিয়োগের কিছু ধারাবাহিক নিয়ম আছে। শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। কপালগুণে একই মেধা বা একই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক কেউ নামি-দামি প্রতিষ্ঠানে, কেউবা অজ্ঞাত, অখ্যাত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে নামি-দামি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অপেক্ষাকৃত কম মেধার শিক্ষার্থীরা মনে দুঃখ নিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছে। সব নামি-দামি প্রতিষ্ঠানেই যে একই রকম পড়াশুনা হয়, তা-ও সবসময় ঠিক নয়।
একটি সুন্দর শিক্ষাঙ্গন আজকের দিনে আমাদের স্বপ্ন-সাধনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য যে-কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানই এই স্বপ্নসাধ মেটাতে পারে। এটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যেও শৃঙ্খলাবোধ থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খলভাবে পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে পড়াশুনা যদি ঠিকমতো করে, তাহলে একটা সুন্দর শিক্ষাঙ্গন গড়া সম্ভব। শিক্ষার্থীদের দিয়ে কিছু গঠনমূলক কাজ অবশ্যই করাতে হবে। ওদের বিভিন্ন হাউসে ভাগ করে দিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব জাগিয়ে তুলতে হবে। এ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব জাগানোর জন্যে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্লাবে যেমন, কোরানিক ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, আবৃত্তি ক্লাব, নৃত্য ক্লাব, গানের ক্লাব ইত্যাদি ভাগে ভাগ করে চর্চা করালেও তাদের মধ্যে গঠনমূলক কাজ করার অনুপ্রেরণা জাগবে। এছাড়া বিভিন্ন দিবস, বাত্সরিক খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক ইত্যাদি উদযাপনের মধ্যদিয়েও শিক্ষার্থীরা আনন্দ উপভোগ করবে। এভাবে যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানই আনন্দের ভেতর দিয়ে গঠনমূলক কাজে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারবে, সে প্রতিষ্ঠানই হবে শিক্ষার্থী ভর্তির উপযুক্ত স্থান।
লেখক :প্রাক্তন উপদেষ্টা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্ স্কুল এন্ড কলেজ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ