হাইটেক পার্ক : অসীম সম্ভাবনার হাতছানি
- ড. মো. নাছিম আখতার
বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। আর তাই প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরই রয়েছে অস্বাভাবিক চাপ। একটা সম্পদই আমাদের পর্যাপ্ত, আর সেটা হলো মানব সম্পদ। সুতরাং এই মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটিয়ে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেশ হবে সত্যিকার অর্থেই সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল। দক্ষ মানব সম্পদ কাজে লাগানোর জন্য দরকার কর্মক্ষেত্র। কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতেও বর্তমানে দেশ এগিয়ে চলছে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প, বস্ত্রশিল্প, চামড়া শিল্প, ওষুধ শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, হিমায়িত খাদ্য ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প সবই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি শিল্পেরই কিছু বর্জ্য বা দূষণ আছে। আমাদের চামড়া শিল্প এবং ডাইং শিল্পের কারণে দেশের সুস্বাদু পানির জলাধারগুলো যারপরনাই দূষিত হচ্ছে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে হয়তো নদীমাতৃক দেশ হয়েও একসময় আমাদের সুপেয় পানি এবং মাছের অভাব মোকাবিলা করতে হবে। এমনকি পানি দূষণের কারণে অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হতে পারি আমরা।
এরকম একটি প্রেক্ষাপটে দেশে হাইটেক পার্ক স্থাপনের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া হাইটেক পার্কের উত্পাদিত পণ্য হবে সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার। আশাকরি, এই শিল্প থেকে নদী দূষণের মতো কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে না। জীবনের স্পন্দনের মূল উপাদান পানি থাকবে সুরক্ষিত। তাই হাইটেক পার্ক আমাদের জন্য হবে আর্শীবাদ। ভারতের ব্যাঙ্গালোরের আইটি কোম্পানিগুলো ভারতের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। হাইটেক নগরী ঘোষণা করার কারণে এক ব্যাঙ্গালোরেই হচ্ছে ভারতের মোট আইটি বিশেষজ্ঞদের ৩৫ শতাংশের কর্মসংস্থান। ধনী দেশগুলোর নাগরিকেরা এ ধরনের একঘেয়ে এবং বুদ্ধি খাটানোর চাকরি করে জীবনের তথাকথিত উপভোগ্য সময় নষ্ট করবে না। তাই তাদেরকে প্রোগ্রামের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর নির্ভর করতেই হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমানে আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে এশিয়ান আইটি বিশেষজ্ঞরাই সংখ্যায় বেশি। আরো একটি উত্স থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় যে, ২০১৭ সালে ভারতের সফটওয়্যার ডেভেলপারদের সংখ্যা আমেরিকার সফটওয়্যার ডেভেলপারদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
সরকার আইসিটি শিল্পের বিকাশে হাইটেক ও সফটওয়্যার পার্ক এবং বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার গড়ে তুলছে। কালিয়াকৈর, যশোর, সিলেট, রাজশাহী, নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে এসব পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণের কাজ চলছে। আইটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দেশীয় আইসিটি শিল্পের প্রসারে এসব পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ হলো ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলার ও আইটি পেশাজীবীদের সংখ্যা ২০ লাখে উন্নীত করা এবং জিডিপিতে আইসিটি খাতের অবদান ৫ শতাংশ নিশ্চিত করা। অবকাঠামো উন্নয়ন ও আইটি শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দেশের ১২টি স্থানে—যথাক্রমে গোপালগঞ্জ সদর, ময়মনসিংহ সদর, জামালপুর সদর, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, চট্টগ্রাম বন্দর, কক্সবাজারের রামু, রংপুর সদর, নাটোরের সিংড়া, সিলেট কোম্পানীগঞ্জ, কুমিল্লা সদর, খুলনার কুয়েটে একই ডিজাইনে আইটি পার্ক নির্মাণের লক্ষ্যে ‘১২ আইটি পার্ক স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
হাইটেক পার্কগুলোতে থাকবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যে বিনিয়োগের ব্যবস্থা। আমাদের সন্তানরা যথেষ্ট মেধাবী। এদেরকে যেকোনো বিষয় শেখালে তারা অতি দ্রুত শিখে যায়। ভালো প্রোগ্রামার তৈরির জন্য দরকার গণিত বিষয়ে খুব ভালো জ্ঞান। এই জ্ঞান সৃষ্টির জন্য আমাদের উচিত কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ ১ থেকে ১০-এর মধ্যে স্থান পাওয়া দেশগুলোর অঙ্ক শেখার পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং ঐ অংক শিখন পদ্ধতি আমাদের দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে চালু করা। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করলে আগামী দশ বছরের মধ্যেই এর সুফল পেতে পারি। আমরা বিশ্বমানের প্রোগ্রামার তৈরিতে সমর্থ হবো। গত ৯ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে ‘দিগ্বিজয়ী জাতি গঠনে একান্ত ভাবনা’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটিতে আইটি সেক্টরের উন্নয়নের জন্যে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিলাম। সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল যদি আমাদের পরামর্শ আমলে নেন আইটি খাতের সাফল্য আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পাবে। নিজেদের প্রয়োজনেই অন্যান্য দেশ তখন আমাদের দক্ষ জনশক্তিকে স্বাগত জানাবে এবং সাদরে গ্রহণ করবে।
যেকোনো শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদান হলো জনশক্তি আর সহনীয় অনুকূল আবহাওয়া। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে আমাদের জুড়ি নেই। আমাদের আছে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু আর আছে জনসম্পদ। একে দক্ষ করে গড়ে তোলা আপনার আমার সবার দায়িত্ব। বরফ আচ্ছাদিত ও মরুময় দেশগুলোতে মানব-সহনীয় শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে যে খরচ তা আমাদের দেশে প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাই আমাদের দেশে যেকোনো শিল্প গড়ে তোলা অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক। এই শিল্প গড়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এই দুটির সংস্কার সাধনে আমরা পারি শ্রমঘন শিল্প ও জ্ঞানভিত্তিক শিল্পের জন্য কর্মবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ বাংলাদেশের মানুষকে করবে উদ্দীপ্ত, কর্মমুখর এবং গড়বে স্বনির্ভর বাংলাদেশ।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান (কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়