প্রস্তাবিত বাজেট শিক্ষার কতটা অনুকূলে
- মাছুম বিল্লাহ
একটি সংসার কিংবা একটি প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য যেমন একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও একটি সুষ্ঠু বাজেট প্রয়োজন, তার চেয়েও বড় অর্থে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন আরো সুষ্ঠু একটি বাজেট। আমাদের মতো দেশে বাজেট তৈরি করা একটি দুরূহ ব্যাপার এবং এর বাস্তবায়ন করা তো নিয়মিত একটি কঠিন কাজ।
তার ওপর দেশ দুর্নীতিতে কানায় কানায় ভর্তি। সাধারণ মানুষের কাছে বাজেটের যে অভিজ্ঞতা, তা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম কয়েক ধাপ বৃদ্ধি পাওয়া এবং জীবনকে গত এক বছরের চেয়ে আরো কঠিন অবস্থায় দেখতে পাওয়া। আমাদের দেশে এমন কোনো ঘটনা কখনো ঘটেনি যে বাজেট হয়েছে মানুষ গত এক বছর যেসব বিষয় নিয়ে অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে ছিল, বাজেট ঘোষণার পর তার দাম কমে গিয়ে জনজীবনে স্বস্তি এসেছে। দ্বিতীয় আর একটি বিষয় হচ্ছে, বাজেট যত জনকল্যাণবিরোধীই হোক না কেন, সরকারি দল তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে আর বিরোধী দল বাজেটের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ে। ভাবখানা এমন যে তারা বাজেট করলে তা স্বর্গ থেকে আসত এবং তাতে কোনো খুঁত থাকত না। তারা যে যা-ই বলুক না কেন, ভোগান্তিতে পড়ে জনগণই। জনগণকেই সব কিছু সহ্য করতে হয়। দেশের গণতন্ত্র তথা জনকল্যাণ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ছোট একটি চাকরি যা হওয়া উচিত ছিল একজন প্রার্থীর যোগ্যতার বলে, যোগ্যতার কোনো প্রশ্ন তো নেই। এখন কে কত টাকা দিতে পারবে এবং এই টাকার পরিমাণ ১০ লাখে পৌঁছেছে।
দেশের এক খাতের বাজেটের সঙ্গে অন্য খাতের মিল থাকতে হয়, তা-ও নেই আমাদের বাজেটে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৪৯ হাজার ১০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ ১৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা, যা এডিপির ৯.৭২ শতাংশ। গত বাজেটে উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা, যা এডিপির ১০.৫২ শতাংশ। শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করার কথা বলে আসছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষা পরিকল্পনা ও বাজেটের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে, যা হবে বৈষম্যহীন ও মতাদর্শ, অঞ্চল ও জেন্ডার নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রকৃত উন্নয়ন ও কল্যাণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়ক। এমন বাজেট কী আমরা শিক্ষা খাতে কখনো পেয়েছি? আগামী অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২.৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২২ হাজার ২২ কোটি টাকা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২.৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে তা ২.৯ শতাংশ। যদিও শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪.৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করেছে ইউনেসকো। ইউনেসকো, আইএলও, গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশন যেসব জরিপ ও গবেষণা চালিয়েছে ও সুপারিশ দিয়েছে তা শিক্ষায় অর্থ বরাদ্দ, অর্থ বরাদ্দের বিকল্প উৎস সন্ধান, বরাদ্দ সদ্ব্যবহার, সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। টাইম টু গেট ইট বাইট লেসনস ফ্রম ইএক ও অ্যান্ড দি এমডিজি যার এডুকেশন ২০১৬-৩০ শিরোনামে জিসিই যে হ্যান্ডবুক প্রকাশ করেছে তা পাঁচটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশের উল্লেখ আছে।
দিনবদলের সনদ ও রূপরেখা ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্য সামনে রেখে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অনবরত বাড়ানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১২০টি বেসরকারি মাধ্যমিক ও ২৮৫টি বেসরকারি কলেজ সরকারীকরণের কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে। সার্বিক শিক্ষা খাতের মানোন্নয়নে অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ চলমান কার্যক্রম আমরা অব্যাহত রাখব। পাশাপাশি মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষার প্রসার ও উত্কর্ষ সাধনে পাঁচ বছরমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ১৮.২ বিলিয়ন ডলার।’ কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার সঠিক কোনো নির্দেশনা কিন্তু বাজেটে নেই। ২০১২ সাল থেকে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়ে আসছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। একই হারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়; কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামে তা থেকেই যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে রাস্তা বন্ধ করে দিতে পারে, গাড়ি ভাঙতে পারে, শিক্ষকদের আটকে রাখতে পারে। তাই সরকার তাদের কাছে নতিস্বীকার করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বাতিল করে দিয়েছে। আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকার ভ্যাট নেবে কেন?
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কোমলমতি বাচ্চাদের ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। কারণ সরকার ভালোভাবেই জানে বাচ্চাদের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলে তারা আন্দোলনও করতে পারবে না আর এখানকার অভিভাবকরাও সেভাবে একতাবদ্ধ নয় কোনো সংগঠনের মাধ্যমে। অতএব এদের ওপর চাপাও ভ্যাট; অর্থাৎ পরোক্ষ কর। কোন যুক্তিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভ্যাট দিতে যাবে তার কোনো সঠিক উত্তর নেই। ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যালয়গুলো সরকারে এমপিওভুক্ত নয়, তারা সরকারের কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা পায় না। বাংলা মাধ্যমের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়, কোচিং করতে হয়, প্রভাবশালী লোক ধরতে হয়। এগুলো করা তো অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তো সেই অনেক দিন থেকেই। সেদিক থেকে ইংলিশ মিডিয়ামের মান অনেকটাই ভালো, ভর্তি প্রক্রিয়াও সহজ। এমনিতেই ইংলিশ মিডিয়ামে বেতন, বইপুস্তকসহ সব কিছুর খরচ বেশি, তার ওপর আবার ভ্যাট।
উচ্চবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরা তাঁদের বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে থাকেন বলেই কি জরিমানাস্বরূপ তাঁদের বাচ্চাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতে হবে? তাঁরা যদি ধনী, ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতি হয়েই থাকেন, তাহলে তারা তো রাষ্ট্রকে আলাদা ট্যাক্স দিচ্ছেন। তাঁদের বাচ্চাদের ওপর আবার ট্যাক্স কেন? সরকার যদি প্রকৃত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কিংবা ধনিক শ্রেণির কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতে না পারে সেটি তো রাষ্ট্রীয় ও কর বিভাগের দুর্বলতা। সেই দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থীদের ভিকটিম করা হবে কেন? দেশে শিক্ষা বোর্ডের আওতাভুক্ত ১৫৯টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রায় ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। এ ছাড়া রয়েছে ৮০ হাজার কিংবা তারও বেশি কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো না কোনো বিদেশি শিক্ষা উপকরণ ব্যবহৃত হয়। জুলাই থেকে ওসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের খরচ বাড়ছে। সরকার যে বিনা মূল্যে বই বিতরণ করছে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সেই বই কি সব শিক্ষার্থীর দরকার আছে? একদিকে বিনা মূল্যে বই বিতরণ করছে অন্যদিকে আর একদল শিক্ষার্থীর কাছ থেকে গলা টিপে টাকা নিচ্ছে। এই টাকা কোথায় ব্যয় হবে? একই দেশে এ রকম ’দ্বিমুখী নীতি’ কেন? শিক্ষা ক্ষেত্রে লাগামহীন দুর্নীতি কমানোর কোনো নির্দেশনা বা উদ্যোগ এই বাজেটে নেই।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক
সূত্র: কালের কণ্ঠ