শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতার দুর্দিন
- সাইমুম রেজা তালুকদার
গত এক যুগে বিশ্বজুড়ে অনেক রকম অধিকারের ওপর খড়্গ নেমেছ, শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা তার অন্যতম। আসুন, দুনিয়াটা ঘুরে আসি। সম্প্রতি তুরস্কে ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়েছে জঙ্গি হামলা। ভারতে ছাত্রনেতা কানাইয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা এবং এ-সংক্রান্ত বিতর্ক তো ছিলই, উপরন্তু এসেছে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ইত্যাদি এসবের উদাহরণ। বাংলাদেশেও শিক্ষকদের কথা বলার পরিসর কমে আসছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ, (ডিসেম্বর, ২০১৬-তে প্রকাশিত টিএইবির রিপোর্ট অনুযায়ী), ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের খবরদারি, প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেমে থেমে চলছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত খবরের শিরোনাম হচ্ছে।
যদিও উপরিউক্ত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট, কারণ ও উৎস এক নয়, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই একটি মিল দেখা যায়, সেটি হলো, ক্ষমতাধরদের দ্বারা মুক্তচিন্তকদের নিশ্চুপ করার প্রয়াস। ‘একাডেমিয়া’-কে (সমষ্টিগতভাবে জ্ঞানসাধকবৃন্দ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ে গঠিত ‘শিক্ষাঙ্গন’) মনে করা হয় সমাজের বিবেক, যারা তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজকে সহনশীল, বহুত্ববাদী, শান্তিপূর্ণ এবং প্রগতিশীল রাখায় কাজ করে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে একাডেমিয়া জনগণকেও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে, যা অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ও ক্ষমতালিপ্সু শক্তিকে রুখতে সাহায্য করে। এ কারণে যেকোনো ক্ষমতার পালাবদলে দখলদার শক্তির অন্যতম লক্ষ্য থাকে একাডেমিয়াকে বিনষ্ট অথবা কবজা করা। এর একটি মর্মান্তিক উদাহরণ হলো ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসরদের কর্তৃক বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা।
আজও সারা বিশ্বে সেই একই ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ‘স্কলারস অ্যাট রিস্ক’ নামক নিউইয়র্কভিত্তিক শিক্ষা অধিকার রক্ষা সংগঠন তাদের একাডেমিক ফ্রিডম মনিটরিং প্রজেক্টের অংশ হিসেবে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। রিপোর্টে তারা বলেছে, মে ২০১৫ থেকে অক্টোবর ২০১৬ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১৫৮ জন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অবৈধ আটক, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, বহিষ্কারাদেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের মতো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন।
তাহলে স্বাধীন একাডেমিয়া বলতে কী বোঝায়? এটা কী শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিশেষায়িত জ্ঞানের ও গবেষণার পরিধির মধ্যে থেকে কথা বলার স্বাধীনতা, নাকি তাঁদের বিশেষায়িত জ্ঞানের গণ্ডির বাইরে গিয়েও সমাজের বিভিন্ন ত্রুটি ও বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা? সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনকার শিক্ষামূলক কার্যক্রমের স্বাধীনতাও কি একাডেমিয়ার স্বাধীনতার অন্তর্গত? এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা নেই। কিন্তু তারপরও আমরা বিভিন্ন দেশের চলমান প্রথা থেকে একটু ধারণা নিতে পারি। এই যেমন আমেরিকায় একাডেমিক স্বাধীনতা বলতে তিনটি আঙ্গিক বোঝায়—১. ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে, ২. প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে এবং ৩. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহের আলোকে।
আমেরিকার সংবিধানের ফার্স্ট এমেন্ডমেন্টের (বাক্স্বাধীনতা) আলোকে একাডেমিক স্বাধীনতা একটি সাংবিধানিক স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃত। কেয়িশিয়ান বনাম বোর্ড অব রিজেন্টস মামলায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট মতামত দিয়েছে যে একাডেমিক স্বাধীনতা শ্রেণিকক্ষের স্বকীয়তার যবনিকাপাত ঘটায়, এমন আইনকে সহ্য করে না। এর অর্থ হলো শ্রেণিকক্ষে যেকোনো ধরনের বিরোধপূর্ণ, সময় ও স্রোতের বিপরীত, অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ও বিতর্কের স্বাধীনতাই একাডেমিক স্বাধীনতা। সুইজি বনাম নিউ হ্যাম্পশায়ার মামলায় আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতাকে একাডেমিক স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকার করেছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচলনে দুর্নীতি দমন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। সবশেষে একাডেমিক স্বাধীনতাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহের আলোকে ‘শিক্ষা লাভের অধিকার’ নামক মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আমেরিকায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কারণ, জাতিসংঘ ঘোষিত ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক সনদের’ আলোকে চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার মৌলিক অধিকার এবং জাতিসংঘ-ঘোষিত ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক সনদের’ আলোকে ‘শিক্ষা লাভের অধিকার’ মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।
উপরন্তু, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক কমিটির ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘শিক্ষা লাভের অধিকার’-এর ওপর করা জেনারেল কমেন্টস নম্বর ১৩ অনুসারে এটা বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার অধিকার তখনই উপভোগ করা যায়, যখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়’। জাতিসংঘের কমিটি আরও বলেছে, ‘কমিটির অভিজ্ঞতানুযায়ী উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ যেকোনো রাজনৈতিক ও অন্যান্য চাপের কাছে বিশেষভাবে ভুক্তভোগী’। এই রিপোর্টের আকর্ষণীয় দিক হলো এটা ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক সনদ’-এর দ্বারা জাতিসংঘ চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করেছে, এবং একই সঙ্গে ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক সনদ’-এ স্বীকৃত ‘শিক্ষা অধিকার’ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আবশ্যকতা তুলে ধরেছে।
অতএব, ‘শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা’ হলো শিক্ষা লাভের স্বাধীনতার অন্যতম পূর্বশর্ত। তাই সময় এসেছে বাংলাদেশেও শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার। আশা করি, শিক্ষার অধিকারকে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) না রেখে তৃতীয় ভাগে (মৌলিক অধিকার) একটি আলাদা অনুচ্ছেদ হিসেবে স্থানান্তরিত করে/জায়গা দিয়ে এবং সেই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতাকে এতে অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের আইনপ্রণেতারা একটি নতুন সংবিধান সংশোধনী আনবেন, সেই দিনের প্রত্যাশায়।
সাইমুম রেজা তালুকদার: ঢাকা জজকোর্টের একজন অ্যাডভোকেট এবং বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আইন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে অধ্যয়নরত।