মাছ বদলে দেবে বাংলাদেশকে
- ড. হারুন রশীদ
‘মাছ চাষে গড়ব দেশ বদলে দেবো বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে কিছুদিন আগে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হয়েছে। মৎস্য সপ্তাহের স্লোগানটি তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু মাছ চাষ করতে হলে তো জল বা জলাশয়ের দরকার। জলই যদি না থাকে, তাহলে মাছ থাকবে কেমন করে? জলের আধার হচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল। দেশের নদ-নদীগুলো দখল-দূষণে হারিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। দেশে এখন মাছ উৎপাদনে একটি বিপ্লব ঘটলেও তা হয়েছে নিছক বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা অনেকটা কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’র মতো। কারণ বাণিজ্যিকভাবে অনেকে লাভবান হলেও সেই মাছে বাঙালির রসনা তৃপ্ত হয় না। দ্বিতীয়ত, মাছের উৎপাদন বেড়েছে বটে, কিন্তু তাতে পুষ্টি চাহিদা মিটছে না। এজন্য দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। প্রাকৃতিকভাবেই যেন দেশি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত মাছে-ভাতে বাঙালিকে প্রাকৃতিক মাছের অতুলনীয় স্বাদ ফিরিয়ে দিতে হলে দেশের নদী-নালা-খাল-বিলগুলো বঁচাতে হবে সবার আগে।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে ৫৪ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ প্রায় বিলুপ্ত, ২৮ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। এর প্রধান কারণ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল-নদী-নালা শূন্য। খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব। আর যেসব নদী অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোয় দূষণের মাত্রা এত বেশি, মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গীন। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের পর বুড়িগঙ্গা তার রূপ ফিরে পাচ্ছে, এটা আশার কথা। একইভাবে অন্য নদ-নদীগুলোকেও দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক নদীর নাম হালদা। চট্টগ্রামের ব্যতিক্রমী এই নদীতেই পূর্ণিমা-অমাবস্যার একটি বিশেষ সময়ে মাছ ডিম ছাড়ে। বহুসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয় এই নদীকে কেন্দ্র করেই। নদীর পানিও ভূ-উপরিস্থ জলের আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শহরে এই নদী থেকেই পানি শোধন করে তা পানের জন্য সরবরাহ করা হয়। অথচ দখল-দূষণে এই নদীও মৃতপ্রায়। হালদা দখল করে হচ্ছে ইটভাটা, বসতবাড়ি। এটা এক আত্মঘাতী প্রবণতা। যেখান থেকে শত শত মণ মাছের ডিম উৎপাদন হয়, সেখানে এখন এক মণ ডিম পাওয়াও দুষ্কর। এর ফলে মাছের অভাব যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি নদীতীরবর্তী বহুসংখ্যক মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এটা মনে রাখা দরকার, হালদা নদী বাঁচলেই প্রাকৃতিক মাছের বিশাল এক ভাণ্ডার রক্ষা পাবে। হালদা একটি বিশেষ ধরনের নদী; একে রক্ষা করতে হবে যে কোনো মূল্যে। সুন্দরবন যেমন অনন্য, আমাদের দেশকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরছে এর রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে, তেমনি হালদাও। একটি সুন্দরবন যেমন কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তেমনি হালদাও। এই বিশিষ্টতার মূল্য দিতে জানতে হবে।
কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল ও জলাশয়গুলোয় গিয়ে পড়ে এবং মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। বর্তমানে মৎস্যচাষিরা এমন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন, যেগুলো অতি অল্প সময়ে দ্রুত বর্ধনশীল। শুধু বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক এসব মাছ চাষের কারণে এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছ চাষ করার ব্যাপারে অনীহার কারণেও আমরা হারিয়ে ফেলছি দেশীয় জাতের নানা মাছ। চাষের মাছে কোনো স্বাদ নেই। অথচ ছোট-বড় নানা জাতের দেশি মাছের স্বাদ, সে তো অতুলনীয়!
এছাড়া প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা ও জাটকা নিধনের কারণে রূপালি ইলিশও বিলুপ্তির পথে। ইলিশ রক্ষার বিষয়ে নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায় নানা সময়ে। ইলিশের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতিপূর্বে ‘আন্তঃসীমান্ত সংলাপ’ও হয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, ভারতের কার্যকর সহযোগিতা ছাড়া ইলিশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সম্ভব নয়। কারণ বাংলদেশ ও ভারতের বেশকিছু অভিন্ন নদী রয়েছে। পদ্মাসহ বেশকিছু নদী ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। দু’-একটি নদীর উজানে বাঁধ দেয়ায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাধারণত স্রোতস্বিনী নদীতে ইলিশ বেশি থাকে। আর নদীতে সে াত তো দূরের কথা, যদি পর্যাপ্ত পানি না থাকে, তবে ইলিশ বাঁচবে কিভাবে? ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের পদ্মাসহ কয়েকটি নদীর শীর্ণদশা। বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ইলিশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ শুরু হলে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এই বর্ষা মৌসুমে বাজারে ইলিশের ছড়াছড়ি থাকার কথা থাকলেও সে তুলনায় নেই। কেউ কি কখনও ভেবেছিল, ইলিশের এমন দুর্দিন আসবে? আর তা হবেই না বা কেন! যে পদ্মা নদী ছিল ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র, সেই নদীই এখন মৃতপ্রায়।
এখানে-ওখানে বড় বড় চর পড়ে একদার প্রমত্তা পদ্মার মৃত্যুপ্রায় ঘনিয়ে এসেছে। শুধু বর্ষাকালের তিন-চার মাস ছাড়া সারা বছর নদীতে পানি থাকে না বললেই চলে। দেশের অন্য নদীগুলোরও একই অবস্থা। তাহলে আমাদের প্রিয় মাছ ইলিশ কোথায় যাবে? কোথায় অবাধে তার বংশবৃদ্ধি হবে, যেখানে ছোট জাটকা সহজেই বেড়ে একটি উপাদেয় ইলিশে পরিণত হবে? আসলে গত প্রায় দু’যুগ ধরে যেন ইলিশের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ইলিশ একদিন বিলুপ্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই ইলিশবান্ধব একটি প্রতিবেশ তৈরির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শুধু মৎস্যসম্পদ বিলুপ্ত হওয়াই নয়, নদী দখল-দূষণের বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। বিশেষ করে শিল্প-কারখানার আশপাশের এলাকার কৃষকরা এ নিয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত তরল বিষাক্ত বর্জ্য স্থানীয় খালবিলে মিশে পানি দূষণ তো করছেই, ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকাসহ আবাদী জমিতেও। ফলে শুধু নদী-নালার পানিই দূষিত হচ্ছে না, দূষিত পানি আশপাশের মাটিতে মিশে সেখানকার জনজীবনকে করে তুলছে মারাত্মক বিপর্যস্ত। বিষাক্ত পানির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে আর্সেনিক, পচা জৈব উপাদান, দ্রবীভূত ও অদ্রবীভূত লবণ, সোডা ও ক্ষতিকারক ক্রোমিয়াম; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব পদার্থ আবাদি জমিতে মিশে মারাত্মক দূষণের ফলে ধানের ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলদ গাছেরও ফলন হ্রাস পেয়েছে। গাছগাছালি জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়েছে। উৎপাদিত ফসলের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। গবাদিপশুর ঘাস পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট এলকার লোকজন। কিন্তু এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। নদী দূষণ নিয়ে এত কথা, এত লেখালেখি, পরিবেশ সংগঠনগুলোর আন্দোলন, এমনকি খোদ হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও তা বন্ধ হচ্ছে না। ঢাকার আশপাশে চার নদীর দূষণ বন্ধে এ পর্যন্ত কম পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কিন্তু দূষণ অব্যাহত আছে। বুড়িগঙ্গায় যাতে কেউ বর্জ্য ফেলতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। বর্জ্য ফেলা রোধে নদীর দুই পাড়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি বা ভ্যানের মাধ্যমে নদীতীরে ময়লা ফেলাও বন্ধ করতে হবে।
নদী দূষণ এখন শুধু নদীর পানিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, তা আশপাশের জনপদকেও করে তুলছে মারাত্মক দূষিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্য গিয়ে নদীর পানি দূষণ করছে। দূষিত পানিতে আশপাশের রাস্তাঘাট ও আবাদী জমি এমন কালো রঙ ধারণ করেছে, তা খালি চোখেই পরিষ্কার বোঝা যায়। এছাড়া মাটি পচে গিয়ে মারাত্মক দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো রয়েছেই, জমিতে ফসলও ফলছে না। দ্রুত এর একটা বিহিত করা দরকার। অভিযোগ রয়েছে, নদী ও আবাদী জমি দূষণের সঙ্গে জড়িত অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অধিদফতরের কোনো ছাড়পত্র নেই। বছরের পর বছর কোনো ইটিপি ছাড়াই সেগুলো চলছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে হবে, যাতে অপরিশোধিত বর্জ্য কোনো অবস্থাতেই তারা ফেলতে না পারে। এজন্য পরিবেশ অধিদফতরকে সক্রিয় হতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চালাতে হবে।
হারানো নদী পুনরুদ্ধার, নদীর নাব্য বৃদ্ধি, নদীদূষণ রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মৎস্যচাষিদের দেশীয় মাছ চাষের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে- এটাই দেখতে চায় দেশের মানুষ।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট