সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কেন এত অনাগ্রহ
- শরীফ এনামুল কবির
শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত প্রায় তিন যুগ। চোখের সামনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে শিক্ষা ব্যবস্থার নানা পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছি। পেশাগত ক্ষেত্রে আমাকেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির ক্ষেত্রে আগে প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। আমি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরেই পরীক্ষা পদ্ধতি পাল্টে এমসিকিউ পদ্ধতি প্রবর্তন করি। লিখিত পরীক্ষার পর ম্যানুয়ালি খাতা নিরীক্ষণে সময় লাগত দুই বা তিন মাস। আমি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিনের পরীক্ষার ফল রাতে ঘোষণার উদ্যোগ নেই। এর পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পদ্ধতিই চলছে।
আজ লিখছি ভিন্ন একটা পরিপ্রেক্ষিতে। কিছুদিন আগের কথা। আমার পরিচিত এক ভদ্রমহিলা বলছিলেন তার ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কথা। স্বামী চাকরির প্রয়োজনে দেশের বাইরে। দুই ছেলেও দেশের বাইরে ব্যস্ত পড়াশোনা ও চাকরি নিয়ে। এখন এক মেয়ে, সে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক। তার মেধা দিয়ে হয়তো সে ঢাকারই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে পারে। তবুও মেয়ের ইচ্ছা রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু বিপত্তি মা, কারণ তার আপত্তি আছে তাতে। সংসারে একা মা মেয়ের নিত্যদিনের পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেই ব্যস্ত। সংসারও সামলাতে হয়। এখন কীভাবে আসন্ন ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য মেয়েকে নিয়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়াবেন। বিপত্তির শেষ এখানেই নয়, গত কয়েকটি ভর্তি পরীক্ষায় দেখা গেছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা একই দিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া সম্ভব হয় না। ভদ্রমহিলা স্বাবলম্বী, পরীক্ষার ফরম কিনতে মেয়ের জন্য টাকা খরচ করতে হয়তো তার সমস্যা হবে না। তবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের মা-বাবাকে গুনতে হবে মোটা অংকের অর্থ। পাশাপাশি যাতায়াত বিড়ম্বনা, ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকা-খাওয়ার সমস্যা তো রয়েছেই।
ফল প্রকাশের আগে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যে উদ্বেগ ছিল, এখন যেন তা আরো বেড়েছে। কারণ এবার শুরু পছন্দমতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির লড়াই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে পরিমাণ আসন রয়েছে তাতে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে শতকরা ১৬ ভাগের এক ভাগ ভর্তি হতে পারবে। বাকিদের পড়তে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে। এছাড়া এত দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পর পর দুবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ ধরে এবার জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার বিধান কার্যকর হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে আরো।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এইচএসসির পরের স্তর উচ্চশিক্ষা নামে অভিহিত। বর্তমানে পাসের হার আর সর্বোচ্চ রেজাল্ট জিপিএ ৫-ধারীর সংখ্যা অনেক, এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে উচ্চশিক্ষা নামক বহু কাঙ্ক্ষিত এ স্তরে নিজেদের স্থান করে নিতে মরিয়া শিক্ষার্থীরা; তার চেয়েও বেশি পেরেশানি তাদের অভিভাবকদের। এ উপলক্ষে এইচএসসি পরীক্ষার আগে বা পরে থেকেই চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। পত্রিকার পাতায় বড় বড় বিজ্ঞাপনে বিশাল ছাড় দিয়ে পরীক্ষা শুরুর আগেই নিজের আসন বুকিংয়ের বিজ্ঞাপন দেয় কোচিং সেন্টারগুলো। শিক্ষার্থীরা পারে তো এইসএসসি পরীক্ষার মধ্যেই কোচিংয়ের ক্লাস শুরু করে দেয়! কোনোমতে পরীক্ষা শেষ করেই শিক্ষার্থীরা ছুটে কোচিংপানে। সারা দেশের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী রাজধানী বা বড় শহরগুলোয় ভিড় করে কোচিংয়ের জন্য। এর পর শুরু হয় ঘোড়ার আরেকটা রেস। সাধারণত অক্টোবর থেকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। এর মানে এ সময় থেকেই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার রেস। এ সময়ে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের খোঁজ নিলে দেখা যাবে— আজ কেউ রাজশাহীতে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে, রাত পোহালেই হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জগন্নাথের পরীক্ষা। বিকালের শিফটের পরীক্ষা শেষ করে রাতের বাস বা ট্রেনে চেপে বসা ঢাকার উদ্দেশে। সারা রাতের নির্ঘুম বা আধা ঘুমের জার্নি শেষ করে সকালে আবার পরীক্ষার সিটে বসা। পরীক্ষার্থীর সঙ্গে মা-বাবা বা অভিভাবকদের ছোটাছুটি অথবা দুশ্চিন্তার ভোগান্তি।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বলতে বোঝায়— একই পদ্ধতির পরীক্ষায় মূলত একই প্রশ্নপত্রে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ। একই স্থানে বসে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীর জন্য কম হয়রানিমূলক একটি ব্যবস্থা। শিক্ষার্থী যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিবন্ধন করতে পারবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে সুবিধামতো একটি স্থান বেছে নিতে পারবে। অর্থাত্ কেউ চাইলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) বসেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা সিলেটে বসেই যবিপ্রবিতে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে। কে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন করেছে, সেই হিসাবে আলাদা আলাদা মেধাতালিকা করা হবে। ফলাফল যাচাই ও ফল নির্ধারণ করা হবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদের মানদণ্ড অনুযায়ী। এর মাধ্যমে যেমন শিক্ষার্থীরা পাবে সুবিধাজনকভাবে কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়াই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ, একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের নিয়মনীতি ও ফলাফল নির্ধারণের পদ্ধতির কোনো রকম পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না। এ পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে সবচেয়ে বড় লাভ হবে ছাত্রছাত্রীদের। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে, যার অর্থ সারা দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতে হয়। এ বছর তাদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। সেই উত্তরবঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের কষ্ট করে সিলেট আসতে হবে না। তারা কাছাকাছি যশোর ক্যাম্পাসেই পরীক্ষা দিতে পারবে। ঠিক সে রকম সিলেট এলাকার কোনো ছাত্রছাত্রী যদি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাকে আর কষ্ট করে যশোর যেতে হবে না, তারা সিলেটে বসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিভাগের জন্য বিবেচিত হতে পারবে।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৮ লাখ ১ হাজার ৭১১ জন। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। জিপিএ ৪ থেকে ৫-এর নিচে পেয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ২৮৭ জন। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২। এর মধ্যে ৩৭টির শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। জাতীয় ও উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে আসন আছে ৪৭ হাজার ৬৩৬টি। এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগেরই প্রথম টার্গেট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ, টেক্সটাইল কলেজ ও মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হওয়া। কিন্তু এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। ফলে এবার উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানের ৫২ হাজার আসন নিয়েই কাড়াকাড়ি হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ইউজিসি সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সেমিস্টারের হিসাব ধরে চলতি শিক্ষাবর্ষে উচ্চশিক্ষায় মোট আসন সংখ্যা ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪৩টি।
সর্বশেষ তথ্যমতে, সরকারি ৩০ মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে আসন ৩ হাজার ২১২টি, বেসরকারি ৬৪টি মেডিকেল কলেজে আসন প্রায় ৬ হাজার। সরকারি নয়টি ডেন্টাল কলেজে আসন ৫৬৭টি, বেসরকারি ১৪টি ডেন্টাল কলেজে আসন ৮৯০টি। সরকারি ছয় টেক্সটাইল কলেজে আসন ৪৮০টি, সরকারি একটি মেরিন একাডেমিতে আসন ৩০০টি, বেসরকারি ১৭টি মেরিন একাডেমিতে আসন ১ হাজার ৩৬০। এছাড়া দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিস্টারে আসন রয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোয় আসন সংখ্যা ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৩০টি এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ৭৭৭টি।
ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অদ্ভুত এক পদ্ধতি অনুসরণ করছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কয়েক বছর আগেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষা ছিল। কোথাওবা এমসিকিউ। আবার এগুলোর মধ্যেও আছে নানা যোগ-বিয়োগের হিসাবনিকাশ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিটভিত্তিক পরীক্ষা, আবার ইউনিটেও রয়েছে বিভাগভিত্তিক পরীক্ষা। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মেধা স্কোরের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার নম্বর যোগ করা হয় আবার কোথাও হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমের মূল্যেরও রয়েছে রকমফের। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ২০০ থেকে ৫০০ বা তারও বেশি টাকা পর্যন্ত ফরমের মূল্য রাখা হয়। ঢাকা, জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একবারই ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেয়। সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় আইনকানুনের সঙ্গে এ সময় শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের পরিচিত হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কী জিনিস—এই প্রথমবার টের পায় তারা।
মজার ব্যাপার আরো আছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে এসে শিক্ষার্থী পায় দর্শন, ফোকলোর বা নাটক ও নাট্যতত্ত্বের মতো বিষয়। সারা জীবন যে ছেলেটি রসায়নে পড়ার স্বপ্ন দেখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি তার ভাগ্যে ইসলামের ইতিহাসের মতো বিষয় জুটে, তাহলে তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে! দুই বছর লেগে যায় তার স্বপ্নভঙ্গের ঘোর কেটে ধাতস্থ হতে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। তবে এর কোনো সমাধান হচ্ছে না। মূলত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনাগ্রহেই আটকে আছে এ পদ্ধতি। গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আলোচনার টেবিল গরম হয়েছে টকশোতে। এমনকি সমন্বিত ভর্তির ব্যাপারে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আগ্রহ প্রকাশ করলেও উপাচার্যরা একমত হতে পারেননি। ফলে অন্য বছরের মতো এবারো ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের দৌড়ঝাঁপ করতে হবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এমনকি একই জেলায় পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে একাধিকবার যেতে হবে শিক্ষার্থীদের।
কয়েক বছর ধরেই সমন্বিত পদ্ধতিতে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমেছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও হওয়া উচিত। তবে সমন্বিত না হয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে তিন ভাগে ভাগ করে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের এখন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদাভাবে ফরম কিনতে হয়। এতে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় অংকের আয় হয়। যদিও ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে তা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তা করে না। আবার সমন্বিত ভর্তিতে এই আয়ে ছেদ পড়বে। এছাড়া ভর্তি বাণিজ্য আর কোচিং-গাইড বাণিজ্যের জন্যই অনেকে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে এ ধরনের ব্যবসায় বড় ধস নামবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে সব মিলিয়ে ছয় থেকে আট মাস লেগে যায়। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে ক্লাস শুরু করতে লেগে যায় আরো মাস দুয়েক। অর্থাৎ ভর্তি প্রক্রিয়ায় বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় শিক্ষার্থীরা খুইয়ে ফেলছে। কিন্তু একটি বা দুটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা যেত। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এ সময়গুলো লেখাপড়ায় ব্যয় করতে পারত। এ পদ্ধতির সুবিধা অনেক। এর মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা দূর করা যাবে। একটি মাত্র রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমেই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকায় এবং দূরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণের প্রয়োজন না থাকায় এতে অভিভাবকদের আর্থিক চাপও কমবে। সেই সঙ্গে এটি কোচিং বাণিজ্য দূর করতে সহায়ক হবে। কোচিং বাণিজ্য দূর করতে প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভর্তি পরীক্ষা শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া দরকার। আবার একটাই ভর্তি পরীক্ষা হলে কিন্তু পরীক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি বাড়ছে না; বরং সিটের সংখ্যা অনেক বাড়ছে। একজন পরীক্ষার্থী এখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র কয়েকশ সিটের জন্য পরীক্ষা দেয়। প্রায় সেই পরিমাণ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যখন সে বেশিসংখ্যক সিটের জন্য পরীক্ষা দেবে, তখন তার ওপর মানসিক চাপ কম পড়বে। আবার ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে ক্লাস শুরু করতে করতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্চ-এপ্রিল মাস লেগে যায়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে অনেক আগে ক্লাস শুরু করা যাবে। এতে সেশনজট কমবে। ‘একাডেমিক ক্যালেন্ডার’ অনেক বেশি এগিয়ে যাবে।
সার্বিকভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম প্রশ্ন হয়। নিজস্ব বাছাই পদ্ধতির মাধ্যমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করে। আর সব শিক্ষার্থী যে এক-দেড় ঘণ্টার মাত্র একটা পরীক্ষায় নিজের সেরাটা দিতে পারবে, তা তো না। সমন্বিত পরীক্ষা হলে একজন শিক্ষার্থী আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাবে না। ‘সমন্বিত সিস্টেমে’ ভর্তি পরীক্ষা হলে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে।
ভর্তি পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘র্যাংক’ বা ক্রম তৈরি হবে কীভাবে? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রম থাকলেও সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিষয়ের মান সমান নয়। যেমন—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বা নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ অন্য কোথাও নেই। যারা এসব বিষয়ে পড়তে চায়, ভালো রেজাল্ট করলে তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় কীভাবে নির্বাচিত হবে? সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিষয় থাকে না। ফলে শিক্ষার্থীরা পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমতো বিষয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার সমন্বিত একটা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি যুগোপযোগী পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে।
গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এতে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের। বলা হচ্ছে, নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় শিক্ষকরা এ বিষয়ে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। কোথাও বাস্তবতার নিরিখে পর্যালোচনাও করা হচ্ছে না। চ্যালেঞ্জগুলোও উপেক্ষা করা হচ্ছে একতরফা দায় চাপিয়ে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশনার পর যদি শিক্ষকরা এক্ষেত্রে কার্যকর আগ্রহ দেখাতে পারতেন, তবে হয়তো সমালোচনার পথটি রুদ্ধ হয়ে যেত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। শিক্ষকরা পরম মমতায় দক্ষ ও মেধাবী নেতৃত্ব তৈরি করেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় কিছু প্রতিবন্ধক রয়েছে। সারা দেশের সব শিক্ষক মিলে একবার একত্রিত হই সেই সমস্যা সমাধানের জন্য। আগামীর নেতৃত্ব তৈরির পথটি একটু মসৃণ করতে, গ্রামের দরিদ্র মেধাবী একটি শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার পথকে প্রশস্ত করতে কেন আমরা নিজেদের আলস্য দূর করতে পারি না? জাতীয় প্রয়োজনে একটি বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানকল্পে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শিক্ষকসমাজেরই সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে কেন আমাদের এত অনাগ্রহ?
লেখক: সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়