ভর্তি পরীক্ষায় সমন্বয়হীনতা
- মো. সহিদুজ্জামান
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু আছে তাতে দেখা যায়, ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভর্তি পরীক্ষার তারিখ একই দিনে হলে তাঁদের অনেকেই বিপাকে পড়েন। এ ছাড়া কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরপর থাকায় অধিক দূরত্বের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থী এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে পছন্দের বিষয়টিতে ভর্তি হতে পারেন না; এমন বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হন, যা তিনি পড়তে চাননি। এর ফলে তিনি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাঁর যোগ্যতা সাপেক্ষে সব ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। অন্যথায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি ফরমের দাম ও বিষয়ভিত্তিক ভর্তি ফির মধ্যে অসামঞ্জস্য থাকায় বিপাকে পড়েন অনেক অভিভাবক। বিভাগ অনুযায়ী আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে পুরো টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেও দেখা যায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে, যেখানে আবেদনকারী সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে অনেক পরিবারের অভিভাবককে একাধিক সন্তানের ব্যয় বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অধিকন্তু এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই হয়তো-বা ভর্তিযুদ্ধে অংশই নিতে পারবেন না। খারাপ যোগাযোগব্যবস্থা ও সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন করে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক বিষয়টি রাষ্ট্রপতি অনুধাবন করে ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের আহ্বান করেন। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ১৩ অক্টোবর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ‘ক’ ইউনিটের (বিজ্ঞান বিভাগ) ও একই দিন বিকেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ‘এ’ ইউনিটের (বিজ্ঞান) পরীক্ষা এবং পরদিন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকার এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচিতে সমন্বয় দেখা গেলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তেমন কোনো সমন্বয় লক্ষ করা যায় না। বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীকে ২০ অক্টোবর খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে পরদিন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) পরীক্ষা দিতে হলে প্রায় ৪০৩ কিলোমিটার রাস্তা ভ্রমণ করতে হবে। এর পরদিন ২২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান ইউনিটের পরীক্ষা হলে ওই শিক্ষার্থীকে আরও ৫২৫ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) পরীক্ষা দিতে চাইলে আবার চট্টগ্রামে আসতে ৫১৩ কিলোমিটার এবং পরদিন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চাইলে আরও ৪৬৮ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। অথচ ঢাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষার পর চট্টগ্রামে অবস্থিত চুয়েট ও চবিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে সর্বোচ্চ ২৬০ কিলোমিটার পেরোতে হতো।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে ১৫ দিনের মধ্যে ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ২ হাজার ৩৬০ কিলোমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২৯৫ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। নভেম্বরের ৩ থেকে ১১ তারিখের মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমরকৃবি), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ভর্তি পরীক্ষা পরপর অনুষ্ঠিত হবে। এতে ৯ দিনে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে বিজ্ঞানের একজন পরীক্ষার্থীকে প্রায় ১ হাজার ৩৬৪ কিলোমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রায় প্রতিদিন ২২৭ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। এরপর ১৭ থেকে ৩০ নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনসহ মোট ১৬ দিনে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে একই সময়ে অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি) ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি); ১৮ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ও কুবি; ২৪-২৫ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এবং ২৬-৩০ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাটেবি) ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে নভেম্বর মাসের অনেক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গড়ে প্রায় ২৫০ দশমিক ৫ কিমি পথ ভ্রমণ করতে হবে। ডিসেম্বর মাসে ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় গড়ে ২৪৯ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। ঢাকায় অবস্থিত বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীর সময় বা দূরত্ব বিবেচনা করে প্রায় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অনেকটাই অসম্ভব হবে। এ ছাড়া কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরপর থাকায় অধিক দূরত্বের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে প্রায় ৩ মাসে পরীক্ষার মাঝে মাত্র চারবার বাড়ি ফেরাসহ প্রায় ৬ হাজার ৮২২ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১ দশমিক ৭০ টাকা হারে ৬ হাজার ৮২২ কিলোমিটারের ভাড়া দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার ৬০০ টাকা এবং একজন শিক্ষার্থী যদি সর্বোচ্চ ২৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেন তাহলে খাওয়া–থাকাসহ কমপক্ষে আরও প্রায় ৪৫ হাজার টাকা খরচ হবে। এই গাণিতিক হিসাবের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক কিছু খরচ যেমন রিকশা বা অটোভাড়াসহ মোট খরচ হতে পারে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা।
কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত পরীক্ষাপদ্ধতি অতি দ্রুত চালু করতে দেরি হলে অন্ততপক্ষে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকেরা সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় রুটিন এমনভাবে করতে পারেন, যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ভোগান্তির শিকার না হন এবং একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁর পছন্দের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সব বিষয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব বিবেচনা করে কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পাশাপাশি করা যেতে পারে এবং বেশি দূরত্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি চীন, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার চাকরির পরীক্ষা, মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও বিষয়টি নিয়ে অনেক কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন, তবে দেশের যোগাযোগ, অধিক শিক্ষার্থী ও আর্থসামাজিক দিকগুলো বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনভাবে পরীক্ষা নেওয়ার অধিকার আছে। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে একযোগে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিষয়ভিত্তিক গ্রুপে ভাগ করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা একসঙ্গে করা যেতে পারে। একইভাবে প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা সম্পাদন করা যেতে পারে। মানবিক ও বাণিজ্য শাখার বিষয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাও একইভাবে করা যেতে পারে।
এ ছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমের দাম ও বিষয়ভিত্তিক ভর্তি ফির মধ্যে সামঞ্জস্য নিয়ে আসা উচিত। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এখানে সমাজের আলোকিত মানুষেরা জ্ঞান বিতরণ করেন। তাঁদের বুদ্ধি, বিবেক ও বিচক্ষণতার কাছে এসব শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ভর্তি পরীক্ষায় ভোগান্তি ও জটিলতা কাটিয়ে অতি দ্রুত সহজ ও অধিকতর কার্যকরী সমাধান আশা করেন।
ড. মো. সহিদুজ্জামান: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।