ক্লাস ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুনছে গ্রামের কলেজে
- অজয় দাশগুপ্ত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ছিলেন চীনের পিয়েনজিনের একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে তিনি যুক্ত হলেন নেদারল্যান্ডস থেকে পরিচালিত একটি ভিডিও কনফারেন্সে। বিষয়বস্তু- সন্ত্রাসবাদ। এ কনফারেন্সে আরও যুক্ত হলেন ঘানা, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা ও জর্ডানের প্রতিনিধিরা। আলোচনা চলল দেড় ঘণ্টা। সুপারিশমালাও তৈরি হলো। রেস্তোরাঁর কর্মীরা অধ্যাপক ইমতিয়াজকে নিরিবিলি স্থানে বসার ব্যবস্থা করে দিলেন।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতি কেন চালু হচ্ছে না—এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল অধ্যাপক ইমতিয়াজের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেনোসাইড স্টাডিজে ইতিমধ্যেই এর চর্চা শুরু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে দেশে দেশে যারা গবেষণা করেন, তাদের কয়েকজন নিয়মিত এখানে ক্লাস নিচ্ছেন। তাদের কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার অব এক্সেলেন্সে অবস্থিত ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে হাজির থাকেন না। কেউ ক্লাস নেন আমেরিকা থেকে, কেউবা ভারত কিংবা কম্বোডিয়া থেকে। এক বা দুই ঘণ্টার একটি ক্লাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমানে আসার কী প্রয়োজন, যেখানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিই তাকে প্রায় ‘শারীরিকভাবে’ শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির রাখতে পারছে?
অধ্যাপক ইমতিয়াজ শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে ক্রিয়েটিভ ডিপ্লোম্যাসি বিষয়ে একটি কোর্স পরিচালনা করেছেন। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ভারত, লাওস, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রয়েছে এ কোর্সের ছাত্রছাত্রী। তাদের প্রায় কেউই কলম্বোর ক্লাসরুমে হাজির থাকেন না। শিক্ষকরাও সবাই কলম্বোতে নেই। তারা কেউ বাংলাদেশে, কেউ ভারতে, কেউবা নেপালে। শ্রীলংকাতেও রয়েছেন কেউ কেউ। এ কোর্সের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়ম পারফর্মিং ডিপ্লোম্যাসি বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সময় বিভিম্ন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু ছিল ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল শিক্ষার জন্য প্রধান প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ। স্বাধীনতার পর উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের চাপ বেড়ে যায়। নতুন নতুন কলেজ স্থাপিত হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন বাড়ানো হয়। কিন্তু তারপরও ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি। আবদুল মতিন চৌধুরী উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ জন শিক্ষক সিনেট সদস্য। রেজিস্ট্রার গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি হিসেবে আছেন আরও ২৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি। সিনেটের এক অধিবেশনে আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির সমস্যা নিয়ে আলোচনা উত্থাপন করি। আমার প্রস্তাব ছিল- বরিশাল বিএম কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, খুলনা বিএল কলেজ, ঢাকার জগম্নাথ ও ঢাকা কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ এবং এ ধরনের ১০-১২টি কলেজে কয়েকটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হোক। মূল সমস্যা মানসম্পম্ন শিক্ষক। কলেজগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষকের মান ঢাকা বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমার প্রস্তাব ছিল- এক. যেসব কলেজে অনার্স চালু হবে, সেখানের সংশ্নিষ্ট শিক্ষকদের ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্ফ্মের ছুটির সময়ে দুই মাস প্রশিক্ষণ প্রদান। দুই. সংশ্নিষ্ট কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শীতকালে ১৫ দিন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস নেবেন। বিজ্ঞান বিষয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করাবেন।
আমার প্রস্তাব ছিল মাত্র ১০-১২টি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা। এখন বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে সাতশ’ কলেজে এ ধরনের কোর্স চালু আছে। এই সম্প্রসারণ ইতিবাচক। তাতে ‘বিকাশের সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ’ তো কম নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুনর রশীদ জানালেন, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তিনি শিক্ষক স্বল্পতার কথা স্বীকার করে বলেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে দেশের বিভিম্ন কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু আছে।
তার কাছে প্রশ্ন রাখি- ঢাকার কোনো সেরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেন, তখন সেটা টেলিভিশনের মাধ্যমে অনেক স্কুলে শোনানো হয়। এভাবে প্রত্যন্ত গ্রামের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ঢাকার সেরা একজন শিক্ষকের আলোচনা শুনতে পারে। ঢাকার ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে প্রশ্ন করে। কিন্তু বাইরের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সে সুযোগ পায় না। স্কাইপে বা এ ধরনের প্রযুক্তি যুক্ত হলে তারাও প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুনর রশীদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ক্লাসে পড়াবেন, সেটা কেন একই সঙ্গে ৫০টি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা শুনতে পাবে না? বাংলাদেশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক অনুপম সেন, অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ড. এম এম আকাশ এবং এ ধরনের আরও অনেক বরেণ্য শিক্ষক রয়েছেন। তাদের পাঠদান নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে সীমিত। বিদ্যালয় পর্যায়ে যদি একযোগে অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষকের লেকচার শুনতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তেমন আয়োজন করতে সমস্যা কোথায়? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমার প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। আশা করব যে, তিনি বিষয়টি নিয়ে বিভিম্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সভায় আলোচনা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে পারে।
এ ধরনের প্রস্তাব থেকে কি কলেজগুলো উপকৃত হবে, এ প্রশ্ন রেখেছিলাম নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ মধুমিতা চক্রবর্তীর কাছে। তার প্রতিষ্ঠানে ১৪টি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। কিন্তু কলেজ পর্যায়ের অধ্যাপক আছেন মাত্র ৭ জন। বেশিরভাগ সাবজেক্টে অ্যাসিন্ট্যান্ট প্রফেসররাই বিভাগীয় প্রধান। অথচ দেখুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ফুল প্রফেসর রয়েছেন ২৮ জন। ইংরেজি বিভাগে ১১ জন পূর্ণ অধ্যাপক। বাংলা বিভাগে ১১ জন। কলেজগুলোতে অধ্যাপক পদের জন্য অনুমোদন নেই, অথচ অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। পড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসরণ করে। মধুমিতা চক্রবর্তীর কাছে প্রশ্ন রাখি- যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিভিম্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষকদের নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঠদানের আয়োজন করে, তাদের কলেজ সে সুযোগ গ্রহণ করতে রাজি আছে কি-না। তিনি জবাব দেন, যেদিন এ সুবিধা চালু হবে, সেদিন থেকেই এটা চালু করা সম্ভব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে এ জন্য এখনই চাহিদাপত্র পাঠাতে পারেন।
একই সঙ্গে তিনি কলেজগুলোর জন্য আরও পূর্ণ অধ্যাপক পদ সৃষ্টির অনুরোধ করেন। তবে এ জন্য চাই বাড়তি অর্থ। সেটার জোগান আসতে পারে দু’ভাবে- সরকারের বরাদ্দ। শিক্ষার জন্য ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বরাদ্দ। এ সমস্যার সহজ সমাধান নেই। কিন্তু বিভিম্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক সহজে যে সেবা আমরা পেতে পারি, সেটা কেন নেওয়া হবে না?
বাংলাদেশে এখন পাঁচ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী। আমরা শিক্ষার দুয়ার কারও জন্য বন্ধ করব না, বরং আরও প্রসারিত করব। শিক্ষার সঙ্গে মানের প্রশ্ন যুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একটি ক্লাসে যতজন ছাত্রছাত্রী, প্রত্যন্ত গ্রামের কলেজের অনার্সের বিভিম্ন শ্রেণিতেও একই বিভাগে রয়েছে ততজন কিংবা তারও বেশি ছাত্রছাত্রী। আমরা এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কি যোগসূত্র স্থাপন করতে পারি না? একইভাবে বুয়েটের শিক্ষকরা যুক্ত হতে পারেন আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। মেডিকেল কলেজেও এ ধরনের আয়োজন সম্ভব।
এ আয়োজনে বাড়তি অর্থের তেমন প্রয়োজন নেই। কিন্তু সমল্প্বয়ের কাজটি হওয়া চাই সর্বোচ্চ মানের। বিভিম্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর মধ্যেও চাই সহযোগিতার মনোভাব। এতে ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে উপকৃত হবে। দেশের বরেণ্য শিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়মিত লেকচার শোনার সুবিধা পাওয়ার বিনিময়ে তাদের ওপরে কিছু পরিমাণ ব্যয়ের বোঝাও চাপানো যেতে পারে। এটা তারা করবে মানসম্পম্ন শিক্ষার জন্য।
ছাত্র ও শিক্ষকদের সংগঠনগুলোও এটা নিয়ে ভাবতে পারে। বাংলাদেশ আমলে শিক্ষার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার নজির খুব একটা মিলবে না। অথচ দেশে অনেক ছাত্র সংগঠন সক্রিয়। আমাদের সবার অলক্ষ্যেই কয়েকটি কোটি পরিবারে শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছে। সবার ঘরে এ আলো সমানভাবে পৌঁছায়নি। ধনবানরা সন্তানদের জন্য টিউটর রাখে। মধ্যবিত্তরাও কোচিং সেন্টারের মাহাত্ম্য বুঝে গেছে। হতদরিদ্ররা হু-হুতাশ করে। কিন্তু আমাদের যে সামর্থ্য আছে তার কিছুটাও যদি সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে শিক্ষার মান বাড়বে বৈকি।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এ আলোচনায় অংশ নিয়ে জাপানের একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলেন। আর তিন বছর পর ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিক। ক্রীড়া জগতের এই সেরা আয়োজনের সময়ে বিপুলসংখ্যক বাড়তি লোকের চাপ পড়বে টোকিওতে। কীভাবে সে চাপ সামলানো সম্ভব? এর একটি সমাধান নিয়ে ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে- ঘরে বসেই অফিসের কাজ সম্পম্ন করা। এ জন্য প্রযুক্তি হালনাগাদ করা হচ্ছে। কেউ অফিসের কাজ করার যুক্তি দেখিয়ে বাসায় স্থাপিত অফিসের কাজের টেবিলে না বসে টিভিতে অলিম্পিক দেখছে কিংবা আড্ডা দিচ্ছে কি-না, সেটা ধরে ফেলার প্রযুক্তিও বের করা হয়েছে।
আমরা নিশ্চয়ই এ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব। ফোরজি চালু হলে এ কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমরা নিশ্চয়ই এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারব।
অজয় দাশগুপ্ত: সাংবাদিক