সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির সফলতা-বিফলতা
- এস এম রওনক রহমান আনন্দ
শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন মানসম্মত ও আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক যুগোপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। এ পদ্ধতি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আমার ধারণা। এ পদ্ধতি সম্পর্কে বর্তমানে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি অবগত। গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা সীমিত প্রশ্ন মুখস্থ করত। ফলে পাঠ্যবইয়ের বিরাট অংশ তাদের জ্ঞানের বাইরেই থেকে যেত। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ্যবইয়ের সবখান থেকে প্রশ্ন করার নিয়ম রয়েছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধি আরও বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বের যে কোনো দেশের শিক্ষার্থীদের যথার্থ জ্ঞানলাভ করানোর প্রত্যাশায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন হয়। মূলকথা হলো, এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পাঠ্যবইয়ের আলোকে বিন্যস্ত মৌলিক উদ্দীপকের সাহায্যে জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা যাচাই করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন হুবহু গাইড বই থেকে হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা, অন্যদিকে গাইড বই থেকে প্রশ্নের প্রচলন হওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। উল্লেখ্য, ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষায় গাইড বইয়ের নমুনা প্রশ্ন পুরোপুরি মিলে যাওয়ার অভিযোগও বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালও গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে এবং লেখালেখির মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে একই রকম অভিযোগ করেছেন। তিনি লিখেছেন, সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেওয়ার একটি বিষয় ঘটতে শুরু করেছে। এক অর্থে এ বিষয়টি প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকেও গুরুতর। প্রশ্নপত্র ফাঁস কারা করছে, সেটি ধরা সম্ভব না হতে পারে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারা কারা গাইডবই থেকে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, সেটি বের করা সম্ভব। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। শিক্ষকরা যাতে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন নিজে প্রণয়ন করতে পারেন তার জন্য এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়েছে, বাজার অথবা গাইড থেকে নমুনা প্রশ্ন নিয়ে পাবলিক কিংবা স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু এ প্রজ্ঞাপন যে মানা হচ্ছে না, তার দৃষ্টান্ত পাবলিক পরীক্ষাগুলো। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলে বাজারে প্রচলিত গাইড বইগুলো আর লাগবে না-এমনটি বলা হলেও গাইড থেকে হুবহু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন আমাদের সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে। ভাবিয়ে তুলেছে পাঠ্যবইয়ের চেয়ে গাইড বইয়ের গুরুত্বকে।
এ ধরনের ঘটনা গাইড ও কোচিংয়ের দিকে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি করবে। এক প্রকার অসাধু ব্যক্তিরা শিক্ষাক্ষেত্রে নিষিদ্ধ গাইড মুদ্রণ, বিক্রি, বিপণন ইত্যাদির মাধ্যমে জাতির মেরুদণ্ডে ধস নেমেছে। এসব কারণে আমাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা গাইডনির্ভর হয়ে পড়ছে। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের দিকে লক্ষ রেখে আমরা শঙ্কিত বোধ করছি। কাজেই সময় থাকতে আরও সচেতন হওয়া উচিত। এমনকি অধিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতিটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকেই হূদয়ঙ্গম করাতে হবে। পাশাপাশি প্রশ্নপত্র তৈরিতেও যথোপযুক্ত সময় দেওয়া প্রয়োজন। গাইডভিত্তিক শিক্ষা যোগ্যতাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি অর্থাত্ সৃজনশীল পদ্ধতি, গণিত উত্সব, বই উত্সব ইত্যাদিকে বিতর্কিত করে তুলবে। বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকেই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি সম্পূর্ণ গাইডনির্ভর হয়ে পড়বে।
লেখক :শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর