শিক্ষকের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা
- কাজী ফারুক আহমেদ
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কো নির্ধারিত দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য : ‘Teaching in Freedom, Empowering Teachers’. বাংলায় এর ভাষান্তর বা ভাবান্তর নিয়ে একমত হওয়া কঠিন। কারও মতে তা হওয়া উচিত: শিক্ষণের স্বাধীনতা, শিক্ষকের ক্ষমতা। আবার ‘স্বাধীনভাবে পাঠদান, শিক্ষক হবেন ক্ষমতাবান’ এ মতের পক্ষেও সমর্থন প্রচুর। তবে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিবেচনায় ইউনেস্কো এবং আইএলও প্রদত্ত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের সুপারিশগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক। ১৯৬৬ সালের সুপারিশমালার ৬১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশা অবাধ প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ভোগ করবে। বিশেষ করে কোন শিক্ষা উপকরণ বা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী তা বিচার করার ব্যাপারে শিক্ষকরাই যেহেতু যোগ্যতাসম্পন্ন, কাজেই অনুমোদিত কর্মসূচির কাঠামোর আওতায় এবং শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় শিক্ষা উপকরণ অভিযোজন, পাঠ্যবই নির্বাচন এবং শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগে তাদের অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা থাকতে হবে।’ একই সুপারিশমালার ৬২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে : ‘নতুন কোর্স, পাঠ্যবই এবং শিখন সহায়ক উপকরণ উন্নয়নে শিক্ষক ও তাদের সংগঠনের অংশগ্রহণ থাকতে হবে’। ১৯৯৭ সালের উচ্চতর শিক্ষা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গের মর্যাদাবিষয়ক ইউনেস্কো সুপারিশমালার ২২ অনুচ্ছেদের ঝ-তে বর্ণিত হয়েছে- উচ্চতর শিক্ষা প্রদানকারী ব্যক্তিগণ যাতে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় অথবা গবেষণা চালাতে গিয়ে কোনো রকমের সহিংসতা, বাধা ও হয়রানির সম্মুখীন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সুপারিশমালার ৭০ অনুচ্ছেদে আছে : ‘মনে রাখতে হবে, পেশার মর্যাদা অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। তাই নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে শিক্ষকদের সচেষ্ট থাকতে হবে।’ ১৯৬৬ সালের সুপারিশমালায় উল্লেখযোগ্য আরও ৪টি অনুচ্ছেদ : শিক্ষকদের বেতন ও কাজের শর্তাদি উভয়ই শিক্ষক সংগঠনের ও শিক্ষক নিয়োগ কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমের নির্ধারিত হতে হবে (৮২)। সব শিক্ষকই পূর্ণ বেতনসহ পর্যাপ্ত বার্ষিক অবকাশ যাপনের অধিকার ভোগ করবেন (৯৪)। শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে বেতন কাঠামো সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠিত চুক্তির আলোকে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে হবে। কোনো পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের প্রবেশনকাল অথবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের কারণে নিয়মিত শিক্ষকের জন্য নির্ধারিত স্কেলের চেয়ে কম বেতন দেয়া যাবে না (১১৬)। বার্ধক্যকালীন ভাতার হার সর্বশেষ পেনশনের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্কিত হতে হবে, যেন শিক্ষকের জীবনমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে তা পর্যাপ্ত হয় (১৩৪)।
উন্নত, উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে শিক্ষকরা কী পড়াবেন আর পড়াবেন না তা নিয়ে যেমন মতভেদ আছে আবার ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের যে দুটি সুপারিশমালা বিবেচনায় রেখে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে; তাতে শিক্ষকদের সঙ্গে, তাদের সংগঠনের সঙ্গে পরামর্র্শ করে পাঠ্যবই, পাঠক্রম তৈরি বা চালুর কথা থাকলেও অনেক দেশেই মানা হয় না। কোন্ দেশে শিক্ষক স্বাধীনভাবে পড়াতে পারেন? যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে ডারউইনের তত্ত্বের প্রবেশাধিকার সংকুচিত। এরদোগানের তুরস্কে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্জন সত্ত্বেও পাঠ্যপুস্তকের সূচিতে রক্ষণশীল মতাদর্শের অন্তর্ভুক্তি সাফল্যের অন্বেষণকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে।
নির্ধারিত বিষয়ের পাঠক্রম শিক্ষকের দক্ষতার সঙ্গে পড়াতে বলার পেছনে যুক্তি আছে। কিন্তু সৃজনশীলভাবে পড়াবেন- বলা যত সহজ কার্যত তা যে কত কঠিন আমাদের দেশের শিক্ষকরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। শিক্ষকের স্বাধীনভাবে পাঠদানের প্রসঙ্গ বোধগম্য। কিন্তু শিক্ষকের ক্ষমতাবান হওয়া? সে তো আকাশকুসুম ব্যাপার। মানতে হবে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জনের তালিকা এখন আর ছোট বলা যাবে না। কিন্তু শিক্ষকের ন্যায্য প্রাপ্তি সে তালিকায় কতটুকু স্থান করে নিতে পেরেছে?
ইউনেস্কো এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্বাচন ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে মূলত বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক, সেসব কর্মসূচিতে বাজেট হ্রাস, বিশেষ মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা, গবেষণা কর্মে নিয়োজিত শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি প্রতিকূল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে।
গত চার দশকে বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, এটা ঠিক। তবে সময় ও বিশ্বের তুলনায় এটা এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। এখন মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছে না। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা অবসরে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু এসব শূন্যস্থান যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে না। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। অতি সম্প্রতি ইউনেস্কো জাতীয় শিক্ষক নীতি প্রণয়ন, প্রধান শিক্ষককে প্রধান করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছে এবং জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্য ঘোষণা করেছে তার মধ্যে ৪ নম্বর যা প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশের শিক্ষক ও কর্মচারীদের ১১টি সংগঠন নিয়ে গঠিত জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে যে ১১টি দাবি উপস্থাপন করেছে তা উল্লেখযোগ্য : ১. সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মতো বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, বৈশাখী ভাতা, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ভাতা, পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও পূর্ণাঙ্গ পেনশন প্রদান। ২. অনুপাত প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি কলেজ-স্কুল শিক্ষকদের মতো বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি এবং টাইম স্কেল প্রদান। ৩. কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের অতিরিক্ত চাঁদা কর্তন অবিলম্বে প্রত্যাহার। ৪. এমপিও শর্ত পূরণকারী নন-এমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি। ৫. কর্মচারীদের চাকরি বিধি বাস্তবায়ন। ৬. ইউনেস্কোর সুপারিশ ২০১৬ মোতাবেক প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি করে বিধিমালা সংশোধন। ৭. অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি। ৮. কোড সমস্যার সমাধান, স্তর বিন্যাসের নামে ৯ মে/১৭-এর পরিপত্র অবিলম্বে বাতিল ও বেসরকারি প্রধান শিক্ষকদের সরকারি প্রধান শিক্ষকদের মতো স্কেল প্রদান। ৯. কারিগরি ও সাধারণ শিক্ষায় বৈষম্য দূর। ১০. পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণের দাম কমানো। ১১. শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকায় এ বছর বাংলাদেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ৫ অক্টোবর ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে না। বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয় উদযাপন কমিটি ১৮ অক্টোবর তা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৫ অক্টোবর দিবসটি পালিত না হওয়ার আরেকটি মানবিক কারণ মিয়ানমার থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুসহ কয়েক লাখ মানুষের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ। এসব মানুষের করুণ অবস্থার প্রতিকারে বিশ্ব বিবেক ইতিমধ্যে অনুকূল অবস্থান নিলেও চীন রাশিয়ার মতো দুটি বৃহৎ দেশ যে ভূমিকা নিয়েছে তাকে মানবতার পক্ষে বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষক সংগঠনগুলোর ভূমিকা ইতিবাচক ও মানবিক। জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট ও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন মানববন্ধন, আশ্রয় গ্রহণকারী বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি সংহতি জানিয়ে কর্মসূচি পালন করেছে। এখনও করছে। ফ্রন্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের প্রতিবাদে এবং বিশ্বের শিক্ষক সমাজসহ নারী-পুরুষ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শতাধিক দেশের শিক্ষক সংগঠন, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বরাবর ই-মেইলে আবেদন পৌঁছানো হয়।
মানবতার পক্ষে, সবার জন্য শিক্ষা, শিক্ষার জন্য অপরিহার্য শিক্ষকের মর্যাদা উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষা, শিক্ষা গবেষণা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ বন্ধের প্রত্যয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ পালন করবেন ২০১৭ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সঙ্গে থাকবেন শিক্ষার্থীর অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং নীতি প্রণেতা, শিক্ষানুরাগী বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয় উদযাপন কমিটির সমন্বয়ক। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য