জাগরণের কাল
- রউফুল আলম
লেখকসীমাহীন আনন্দ লাগে, যখন দেখি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে পড়ছে জ্ঞানান্বেষণে। জানার জন্য তারা বেরিয়ে পড়ছে দিগ্বিদিক। চলে যাচ্ছে চীন, জাপান, কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। মনে হচ্ছে একটা জাগরণ তৈরি হয়েছে। এই জাগরণের কালে তাদের আর রোধ করা যাবে না। বাঙালিকে বলা হয় হুজুগে জাতি। কিন্তু এই হুজুগ যদি ভালো কাজে লাগানো যায়, তাহলে দাঁড়াতে সময় লাগে না। পৃথিবী থেকে নেওয়ার যে হুজুগ আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে তৈরি হয়েছে-সেটা অসম্ভব আলোকিত এক দিক।
চীনের জেইজিয়াং ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, শুধু তার ক্যাম্পাসেই তারা প্রায় ৪০ জন বাংলাদেশি গবেষক। আমি শুনে শিহরিত হলাম। জেইজিয়াং ইউনিভার্সিটি হলো চীনের C-9 প্রতিষ্ঠান। আমেরিকায় যেমন আইভিলিগ স্কুল, ইংল্যান্ডে যেমন গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল তেমনি চায়নাতে হলো C-9। বেইজিং ইউনিভার্সিটি, ইউএসটিসি, ফুদান ইউনিভার্সিটি, জেইজিয়াং ইউনিভার্সিটি, এগুলো হলো C-9 প্রতিষ্ঠান। চীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক শত্রু কী বন্ধু সে হিসাব ভিন্ন। তবে চীন থেকে আমাদের নিতে হবে। সে দেশের প্রথম সারির ২০টি বিশ্ববিদালয়ে যদি প্রতিবছর আমরা দুই হাজার ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে দিতে পারি, সেটাই দেশের জন্য অনেক কাজে আসবে। চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যেচে গিয়ে কথা বলা উচিত। বৈঠক করে সুযোগ তৈরি করা উচিত।
টেক্সাস থেকে একজন বললেন, তাঁরা সেখানে প্রায় পঞ্চাশের বেশি বাংলাদেশি গবেষক। কী দারুণ কথা! যে আমেরিকায় ট্রাম্প আসার কারণে ভিসা পাওয়াটাই কঠিন হয়ে গেছে, সে আমেরিকায়ও বাংলাদেশের বহু ছেলেমেয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত আসছে। মানুষ জাগলে, তাকে রোখা কঠিন! গত দশ বছর আগেও, যে পরিমাণ ছেলেমেয়ে দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ত, এখন সে সংখ্যা পাঁচগুণ বেড়েছে। অথচ গত ১০ বছরে, দুনিয়ার রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। ভিসা পাওয়া কঠিন হয়েছে।
বাড়ির পাশে ভারতের আইআইটিগুলোতেও ছেলেমেয়েদের যেতে হবে। ভারতের রাজনৈতিক বন্ধুত্ব-শত্রুতা নিয়ে যুবকদের ভাবলে চলবে না। তরুণদের ধ্যান হলো, পৃথিবী থেকে শিখে নেওয়া। যত পারো নিয়ে নাও। বিশ্বজোড়া এক পাঠশালা। একজন তরুণ দাঁড়াতে পারলে, তাঁর পরিবার দাঁড়ায়। সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাঁর অর্জিত জ্ঞান, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সমাজের কাজে আসে। একজন মানুষকে পুরো দেশ বদলে দিতে হয় না। প্রত্যেকে যদি নিজেকে বদলানোর ব্রত নিয়ে লেগে থাকেন, সেটাই অনেক বড় দেশপ্রেম। ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন। অথচ ইসরায়েল থেকে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান নিতে পারতাম। এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা যায় কিনা ভাবতে হবে। ইরান গবেষণায় ব্যয় করছে। তোমরা ইরানে যাও। শেখো।
আমাদের এক অকৃত্রিম বন্ধু জাপান। তাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঘন ঘন দাওয়াত দিন। তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। আরও বেশি বেশি বাংলাদেশের তরুণদের সে দেশে পাঠিয়ে দক্ষ করার চেষ্টা করুন। বাংলাদেশের আরও কিছু অকৃত্রিম বন্ধু হলো কানাডা, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ইতালিসহ এমন আরও অনেক দেশ। গবেষণায় তারা বিশ্বমানের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সুইডেন-ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড এগুলো দেশ ছোট, তবে প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে রেখেছে। ইউরোপিয়ানরা সেসব দেশে ফ্রি পড়ে। সরকারের উচিত, সেসব দেশ থেকে বেশি বেশি সুযোগ সৃষ্টির পথ তৈরি করা।
দেশে প্রায় পাঁচ লাখ ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। দুনিয়ার বহু দেশে পাঁচ লাখ তরুণও নেই। এই ছেলেমেয়েদের বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ দরকার। জ্ঞান দরকার। সারা দুনিয়ার দেশগুলো দাঁড়িয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ধার করে। অন্যদের কাছ থেকে শিখে। আমাদেরও সে সম্ভাবনা আছে। তরুণদের উঠে-পড়ে লাগতে হবে। সুযোগগুলো নিতে হবে। চৌদ্দ শ বছর আগে হিউয়েন সাং চীন থেকে বাংলায় আসতে পেরেছেন। আর জিপিএসের কালে চীন, ভারত, কোরিয়া, জাপান যেতে পারবে না তুমি? দিনভর কম্পিউটারে বসে এগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো। ধর্ম গেল, রাজনীতি গেল—এই সব ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজে দাঁড়াও। আলোকিত হও। প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে গেলেই দেশ দাঁড়ায়। চীনা ভাষা শেখো, জাপানি শেখো, কোরীয় ভাষা শেখো। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ শেখো। সুযোগগুলো লুফে নাও, এখনই! জাগরণের কালে, হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাই সবচেয়ে বড় মূর্খতা!