শিশুশিক্ষা অধিকার নাকি ফ্যাশন?
- ড. মো. কামাল উদ্দিন
শিক্ষা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে অন্যতম, এটি নতুন করে বলার কিছু নেই। পৃথিবীর সব দেশে শিক্ষা, বিশেষ করে শিশুশিক্ষা নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তবে উন্নয়ন ও আধুনিকতায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর শিক্ষার গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে একটু বেশি, কেননা এখানে শিক্ষাকে উন্নয়নের একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে পরিমাণগত শিক্ষা নয়, গুণগত শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ বা জাতি সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না।
এটি অকপটে সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের দেশে পরিমানণগত শিক্ষা বহু গুণ বেড়েছে এবং শিক্ষার হারও আগের চেয়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে শিক্ষা ছিল শহুরে ব্যাপার। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের ব্যবধান অনেকটা কমে এসেছে। কিন্তু কেন জানি কোথায় এক ধরনের গণ্ডগোল লেগেই আছে। একটি প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে যে, আসলে আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশুশিক্ষা ব্যবস্থা কি আমাদের শিক্ষার অধিকার উপভোগ করতে সহায়তা করছে? এটি কি আমাদের গুণগত শিক্ষা উপহার দিতে সক্ষম হচ্ছে? নাকি শিক্ষা আমাদের কারও কাছে ফ্যাশন, কারও কাছে যন্ত্রণা কিংবা বেদনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
দেশ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে শিশুশিক্ষায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। নতুন শিক্ষা সংস্করণের মধ্যে রয়েছে শিশুশিক্ষার বেসরকারিকরণ ও জাতীয় কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যম। তা ছাড়াও রয়েছে গ্রামার স্কুল, তবে গ্রামার স্কুলের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ বাংলাদেশে গ্রামার স্কুলের শিক্ষাকে কখনও অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। হয়তো ভাবছেন শিক্ষা অধিকারের সঙ্গে শিশুশিক্ষার বেসরকারিকরণ ও জাতীয় কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদানের সঙ্গে সম্পর্ক কী? সম্পর্ক হচ্ছে ব্যাপক আকারে শিশুশিক্ষার বেসরকারিকরণ ও জাতীয় কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যম চালুর ফলে শিশুশিক্ষা আর আমাদের মৌলিক অধিকার থাকল না। কারণ মৌলিক অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রে সকল নাগরিক সমান সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কাজ করবে না। এখন একটু ভেবে দেখুন, শিশুশিক্ষার বেসরকারিকরণ ও জাতীয় কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান চালুর মাধ্যমে কীভাবে আমাদের সমাজে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। ভেবে দেখুন, চাইলেই কি শত ইচ্ছা থাকলেও সমাজের একজন সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ তার সন্তানকে এ ধরনের শিক্ষার সুযোগ দিতে পারবেন? উত্তর না। কারণ এটি তার অধিকার নয়। তার ও তার সন্তানের জায়গা এখানে নেই। এই শিক্ষা অনেক দামি (costly)। সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির সন্তানদের জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছে। যার মাধ্যমে আমাদের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অধিকারকে সীমিত করা হয়েছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা উদাহরণ দেওয়া যায় যে, একজন সরকারি চাকরিজীবীকে তার দুই জন সন্তানের পড়া-লেখার জন্য মাসিক ৫০০ টাকা করে প্রদান করা হয়। বেসরকারি চাকরিতে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে কিনা আমার জানা নেই। এখন ভেবে দেখুন একজন সাধারণ চাকরিজীবীর পক্ষে এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের পড়ানো সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। যদি তিনি বাপের ভিটা-বাড়ি বিক্রি করেন বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করেন।
তাই এ ধরনের শিক্ষা যতটুকু না অধিকার তার চেয়েও বেশি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কার সন্তান কোন স্কুলে পড়ে, কজন গৃহশিক্ষক দিয়ে তাদের পড়ানো হয়, পরীক্ষায় কে গোল্ডন জিপিএ পেয়েছে তার ওপর নির্ভর করে তার সামাজিক অবস্থান। অন্যদিকে যারা এ ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত বা তাদের সন্তানদের এ ধরনের স্কুলে পড়াতে চান না তারা অন্যের কাছে অপমাণিত হতে হয় বিভিন্নভাবে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাই এই শিক্ষা আর আমাদের অধিকার বা মানবাধিকার থাকল না, অধিকার খর্বের একটি যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
অনেকে আবার প্রশ্ন করতে পারেন শিশুশিক্ষার বেসরকারিকরণ ও ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান চালু দোষের কী। এতে কোনো দোষ নেই। তবে এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি কোন উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল বা এ শিক্ষা পদ্ধতি জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণে কতটুকু সফল হবে এ নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়েছিল কি না? হুজুগে যা চালু করা হয়েছিল তা আমাদের পরিষ্কার হওয়া দরকার। এ শিক্ষা পদ্ধতির ফলে সরকারি স্কুলের সঙ্গে বেসরকারি স্কুল এবং ন্যাশনাল কারিকুলামের সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানো হয়েছে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে, বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে–বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে অনেক আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। আরও মান উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ দরকার রয়েছে। সামাজিক বিভক্তি ও অসমতা তৈরির পাশাপাশি এ ধরনের শিক্ষা আর আমাদের কী কী উপহার দিয়েছে তা একটু চিহ্নিত করা যাক।
এ ধরনের শিক্ষা আমাদের শিশু শিক্ষার্থীদের অনেক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। যেমন তারা এখন একজন কর্মজীবী মানুষের থেকেও অনেক বেশি ব্যস্ত। একজন কর্মজীবী মানুষ ৮ ঘণ্টা কাজ করেন আর আমাদের শিশুসন্তানরা তাদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে প্রায় ১২-১৫ ঘণ্টা। সকাল ৬টা থেকে তাদের দিন শুরু করতে হয় এবং তা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে অনেকগুলো বইয়ের বোঝা পিঠে নিয়ে তাদের স্কুল শুরু হয়। স্কুল ছুটির পর পর শুরু হয় ধর্মীয় শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়ে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া। এছাড়াও তাদের শেষ করতে হয় হোমওয়ার্ক। এভাবে চলে তাদের দিনের পর দিন। দুনিয়াটা তাদের জন্য যেন একটা জেলখানা। শিক্ষাটা তাদের কাছে যেন একটা যন্ত্রণা। তাদের কোনো প্রাণচঞ্চলতা নেই। আনন্দ নেই। তাদের যেন কোনো অধিকার নেই। তাদের ভালো করে ঘুমানোর অধিকার নেই, খেলাধুলার অধিকার বা সুযোগ নেই, নেই তাদের নিজেকে জানার, বোঝার ও বিকশিত করার সুযোগ। তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর কোনো সুযোগ ও সময় নেই। তারা তাদের নিকট আত্মীয়দের চিনে না। তাদের তেমন কোনো সমাজ নেই, নেই কোনো সামাজিকতা। একটা নাবোধক সমাজে তারা বড় হচ্ছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা ব্যবস্থা আছে কিনা তা আমার জানা নাই।
শুধু তাই নয়, এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা অভিভাবকদের ফেলেছে আরেক রকমের প্রতিযোগিতায়। তারা লিপ্ত হয়েছেন এক ধরনের যুদ্ধে। প্রথম যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় তাদের প্রিয় সন্তানদের সঙ্গে। যেমন, খুব ভোরে তাদের ঘুম থেকে তোলা, স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা, টিফিন তৈরি করা, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে নিয়ে আসা, ক্লাস শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা। এ যুদ্ধে তারা হারতে চান না। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার মৌলিক সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে।
আমাদের দেশের সংবিধানের আর্টিকেল ১৭-এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সব শিশু মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষাগ্রহণ করবে। এটি তাদের মৌলিক মানবাধিকার। যদিও সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কিছুটা বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও বেসরকারি ও ন্যাশনাল কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে খরচের পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার খরচের চেয়েও অনেক গুণ বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন আইনে এসব স্কুল পরিচালিত হচ্ছে? এগুলোর জন্য কোনো আইন সত্যিকারভাবে আছে কিনা? থাকলেও এই আইন কী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭ এর বিরোধী কীনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের সংবিধানের সীমার বাইরে নয়।
এ ধরনের পুঁজিবাদী শিশুশিক্ষা নতুন যান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করছে বা করবে। অনেকে হয়তো বলবেন, দেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ভালো পড়ালেখা হয় না। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে ওইসব বিদ্যালয়ের কীভাবে মান বৃদ্ধি করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া হোক। তবে সব বেসরকারি ও ন্যাশনাল কারিকুলাম ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোয় পড়ালেখার মান অনুযায়ী যে পরিমাণ খরচ বহন করতে হয়, সে তুলনায় কোনোভাবেই তাকে খুবই মানসম্মত বলা যায় না। আবার এও বলা যায় যে, দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে সরকারি স্কুলের সংখ্যা অপ্রতুল– তা একদম ঠিক। এর একটা সমাধান হিসেবে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারে বা শিশুশিক্ষার বেসরকারিকরণও হতে পারে। কিন্তু সরকারি স্কুলের সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্তানদের সমান সুযোগ থাকতে হবে এসব স্কুলে প্রবেশের ক্ষেত্রে। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ভালো পারবে কিন্তু ইংলিশে দুর্বল থাকবে, আর ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীরা ইংরেজি খুব ভালো জানবে, অন্যদিকে তারা বাংলায় কাঁচা থাকবে এটা হতে পারে না। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। না হয় এটাকে আমাদের মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দিতে হবে এবং সংশোধন করতে হবে আমাদের সংবিধান।