‘মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত জাতি’
- রেবেকা সুলতানা
যা কিছু সুন্দর, তার জন্য পরিবর্তন হতেই পারে। তবে তা হওয়া উচিত পরিকল্পিত। অন্যথায় একই বিষয়ে বারবার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আসবে, কিন্তু কখনই তা প্রত্যাশিত ফলাফল আনতে পারবে না।
আমাদের দেশের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও ঠিক একই অবস্থা বিদ্যমান। কী লক্ষ্য সামনে রেখে ঠিক কোন ধরনের পরিবর্তন করা হচ্ছে, এর কোনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে কিনা- তা আসলে স্পষ্ট নয়। কেমন যেন একটা ধর তক্তা, মার পেরেক অবস্থা। আমার মেজ ছেলে জেএসসি পরিক্ষার্থী; ঈদের ছুটি শেষে স্কুলে প্রথমদিন ক্লাস করে এসে জানাল-
: আম্মু! আমাদের সিলেবাস পাল্টে গেছে। এখন থেকে বাংলা ও ইংরেজিতে একশ’ নম্বরের একটি পরীক্ষা হবে, দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষা হবে না।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম-
: বেশ! নতুন সিলেবাস ধরে প্রস্তুতি নিতে থাক। এটি একটি সার্টিফিকেট পরীক্ষা, এর ফলাফল তোমার দীর্ঘজীবনের পথচলায় সঙ্গে থাকবে।
আমার বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্কুল থেকে ফিরে ও খুব চিন্তিত মুখে বলল-
: আম্মু! এবার থেকে নাকি নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা থাকবে না। এককথায় উত্তর ধরনের প্রশ্ন থাকবে। তুমি শুনেছ?
আমি হেসে বললাম-
: নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন বাতিল করার সিদ্ধান্তটি এখনও চূড়ান্ত নয়। সরকার চাইলে যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে। পরিবর্তন তো তোমার একার জন্য আসছে না, তাই না? তুমি প্রস্তুতি নাও, পরীক্ষা পদ্ধতি যাই হোক, তোমার পাঠ্যবই ভালো করে পড়া হলে পরীক্ষা ঠিক ভালো দিতে পারবে।
ছেলেরা যার যার কাজে চলে গেল কিন্তু আমার মধ্যে ভাবনা শেষ হল না। ঠিক কী উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তড়িঘড়ি পরিবর্তন আনা হয়, বুঝতে পারছি না! শোনা যাচ্ছে, এ বছর জেএসসি পরীক্ষা এক মাস এগিয়ে অক্টোবর থেকে আরম্ভ হবে।
২০১৮ সাল থেকে পিইসি পরীক্ষার সব প্রশ্নপত্র কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিতে করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। বছরের মাঝামাঝি এসে শিক্ষার্থীদের ওপর এসব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। শিক্ষাব্যবস্থার নানা স্তরে ত্র“টি রয়েছে।
সেগুলো সমাধানে প্রয়োজন গবেষণালব্ধ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কখনও গতানুগতিক প্রশ্ন তুলে দিয়ে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন, কখনও ছয়টির জায়গায় সাতটি সৃজনশীল প্রশ্ন, কখনও পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময় থেকে এগিয়ে নিয়ে আসা, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র তুলে নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর চিন্তা- এসব সিদ্ধান্ত অপরিকল্পিত এবং নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ।
বর্তমান সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, তথাপি কিছু তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত সরকারের এ অর্জনগুলো ম্লান করে দুর্বলতাগুলোই স্পষ্ট করে তুলছে। নারী শিক্ষার প্রসার, শিক্ষাসেবায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে বই বিতরণ, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ই-বুক ও ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরি, ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের অর্জন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এডুকেশন-৯ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। কিন্তু সরকারের এতসব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে যখন-তখন প্রশ্নপত্রের ধরন পাল্টানো, লাগামহীন প্রশ্নপত্র ফাঁস, সরকারি সুবিধাভোগী শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য, পাঠ্যবই পরিবর্তনের নামে প্রশ্নবিদ্ধ পরিবর্তন, শিক্ষক সংকট ও অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, আমাদের বাংলাদেশ হাঁটছে স্বপ্নের পথে, হয়ে উঠছে সোনার বাংলা। স্বপ্নের পদ্মা সেতু আলোর মুখ দেখছে, নিজস্ব স্যাটেলাইট হয়েছে, আলোর মুখ দেখছে বিদ্যুতের নানা মেগা প্রকল্প, জিডিপির ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি অর্জন করে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ঈর্ষণীয়।
কিন্তু হতাশার জায়গাটি তৈরি করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশটি স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর ছুঁই ছুঁই, অর্জনের তালিকাও যথেষ্ট। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড তৈরি করে তার শিক্ষাব্যবস্থা। যে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা যত শক্তিশালী, সে রাষ্ট্রের ভিত্তি তত মজবুত হয়ে ওঠে।
আমাদের সোনার বাংলা স্বাধীনতা অর্জনের লম্বা পথ পাড়ি দিলেও কার্যত শিক্ষাব্যবস্থার গলদ দূর করতে পারেনি। অলঙ্করণ তথা সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেলেও কারিকুলামগত দুর্বলতা, পরীক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা, শিক্ষকদের অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশিক্ষণের অভাব, গবেষণার অভাব ইত্যাদি কারণে দিনের পর দিন আমাদের খোলসটা শক্ত হলেও ভেতরটা ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে।
আমি মনে করি পিইসি এবং জেএসসির মতো দুটি পাবলিক পরীক্ষা সৃষ্টির পর সিস্টেমটা আরও বেশি জগাখিচুড়ি হয়েছে। ভর্তি পদ্ধতিতে জিপিএ ডিমান্ড ও ঢালাও জিপিএ ফাইভ পাওয়ার ফলাফল পদ্ধতির ভিড়ে টিকে থাকতে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের মেধাবী তৈরি করার চেয়ে জিপিএ তৈরি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।
হুট করে আমাদের সন্তানদের জন্য চালু করা হল সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির চিন্তা অত্যন্ত সুন্দর- যদি কার্যত যে উদ্দেশ্যে এটি প্রণীত হয়েছে, তা সফল হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ হলে পদ্ধতিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায়। অদক্ষ শিক্ষকে ভরপুর আমাদের স্কুল কলেজগুলো।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা থাকায় টাকার বিনিময়ে সবচেয়ে নিুপর্যায়ের ছাত্রটি চলে এসেছেন জ্ঞান বিতরণের মহান পেশায়। এসব শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি জরুরি। অধিকাংশ শিক্ষক কোনো ধরনের অধ্যয়ন ছাড়াই পাঠদান করেন। আমাদের গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ।
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষ করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও কার্যত তার কোনো সুফল নেই। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণে আসেন, দু’চার দিন নিয়ম মেনে প্রশিক্ষণে অংশ নেন, প্রশিক্ষণ ভাতা-উপকরণ নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরেন; কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টায় না! বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষমতা নেই নিজ উদ্যোগে একটি সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন। সেই শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর পাঠদান করেন- তবে শূন্যতা কোথায় তৈরি হচ্ছে, সেটা ভাবতে হবে।
এ ধরনের শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন নির্ভর করে গাইডবইয়ের ওপর কিংবা কোনো সমিতি কর্তৃক প্রণীত প্রশ্নপত্রের ওপর। যেখানে শিক্ষকদের মধ্যেই সৃজনশীল পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর এ পদ্ধতির প্রয়োগ নিতান্তই শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা।
একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে মনে করি, শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুর্নীতি দূর করা। সরকার নানা সময় কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরব হয়েছে। কোচিং বাণিজ্যকে একমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি মনে করছেন কেউ কেউ। কিন্তু আমি ভিন্ন চোখে দেখতে চাই।
কোচিং সেন্টারে পড়া, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া, শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে পড়া যুগে যুগেই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে প্রস্তুতির স্বার্থে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অনেকেই কোচিং সেন্টারে পড়ান। ইদানীং বিসিএস, ব্যাংক কিংবা অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতির জন্যও কোচিং সেন্টারে যাচ্ছেন অনেকেই। আমাদের দেশে নানারকম কোচিং সেন্টার আছে।
কিছু কোচিং সেন্টার সরাসরি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের নিয়োগকৃত শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত, যারা শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের ফাঁদে ফেলে বিদ্যালয়ের পাঠে অমনোযোগ দিয়ে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের আসতে এক প্রকার বাধ্য করে। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বরের ফাঁদে ফেলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে। প্রকৃতপক্ষে এটি সম্পূর্ণ বাড়তি অর্থ উপার্জনের ধান্ধা। এ অর্থ উপার্জনের ধান্ধায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে গোল্লাছুট খেলা প্রকৃত অর্থে দুর্নীতি। এটি বন্ধ করা প্রয়োজন।
তবে আমি মনে করি, শুধু আইন করে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ, নিয়মিত যথাযথ পর্যবেক্ষণ। পাশাপাশি শিক্ষকদের নৈতিক মানদণ্ড উন্নয়নের স্বার্থে প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের পাঠের প্রতি মনোযোগী করে তোলাও সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবর্তনশীল বিশ্বে পাঠ্যপুস্তকে নতুন নতুন তথ্য সংযুক্তির সঙ্গে শিক্ষকদের সঠিক যোগাযোগ না থাকলে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত পাঠদান করা কখনই সম্ভব নয়। আমাদের দেশে আরও কিছু কোচিং সেন্টার আছে, যেখানে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অন্যান্য শ্রেণীপেশার মানুষ বিনিয়োগ করছে। চটকদার বিজ্ঞাপন আর নানা প্রলোভনে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করছে এবং চড়া দাম হাঁকাচ্ছে বিভিন্ন কোর্সের বিপরীতে। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচানো জরুরি।
তবে শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষে সবসময় পাঠ সঠিকভাবে বুঝবে- তা নাও হতে পারে। বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংকট আছে, আছে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব। গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকরা ঠিকমতো শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ দেন না বললেই চলে। নানা অজুহাতে বিদ্যালয়গুলোয় বছরের অধিকাংশ সময় পাঠদান বন্ধ থাকে। শিক্ষার্থীদের ওপরে সিলেবাস শেষ করার তাড়া থাকে। কাজেই শিক্ষার্থীদের সামনে কোচিং, গৃহশিক্ষক, গাইডবইয়ের বিকল্প থাকে না। মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান না হলে কোচিং, প্রাইভেট পড়া, গাইডবই বন্ধ করলে সমস্যা বাড়বে কিন্তু কমবে না।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে পাঠদান ও গৃহশিক্ষকতায় সম্পৃক্ত। আমি মনে করি, এর অনেক ইতিবাচক দিক আছে। শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সঠিকভাবে পড়িয়ে সম্পন্ন করতে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে দরিদ্র, মেধাবী অনেকেই নিজের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করতে পারে। নিজেদের পাঠাভ্যাসও বজায় থাকে। পাশাপাশি হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে।
কাজেই কোচিং সেন্টার বা গাইডবই নিষিদ্ধ করার আগে এমন উদ্যোগ নেয়া জরুরি, যাতে এগুলোর প্রয়োজন কমে আসে। স্কুল-কলেজে নিয়োজিত শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং করানোর ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়া জরুরি। যদি কোনো শিক্ষক তার স্কুল-নির্ধারিত সময়ের বাইরে কোনো শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে অতিরিক্ত পাঠদান করেন, তবে তিনি নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন না। কোচিং সেন্টারগুলো থাকলেও তাদের একটি নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি। কোচিং সেন্টারগুলোর ফি, পাঠদানের সময়সূচি সবকিছুই নির্ধারিত করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। পাশাপাশি কঠিন শর্তে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করা উচিত, যাতে যত্রতত্র যে কেউ কোচিং সেন্টার খুলে ব্যবসার পুঁজি তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার সুযোগ না পায়।
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আরও একটি বড় সংকট হচ্ছে, আমরা ভালো ফলাফল পাচ্ছি কিন্তু মেধাবী পাচ্ছি না। জিপিএ ফাইভ পাওয়া দেশসেরা ছেলেমেয়েরা দেশের স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস ইত্যাদি কবে- বলতে পারছে না! অবুঝ শিশুর উপযোগী একটি ছোট বাক্য বাংলা থেকে ইংরেজি করতে পারছে না এসব শিক্ষার্থী। যেখানে মেধাবীদের জয়গান হওয়ার কথা পত্রপত্রিকায়- সেখানে তাদের নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, হাসি-তামাশা হচ্ছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে ফেল করার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। তাহলে এতসব পরিবর্তন দিয়ে আমরা কোন পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছি? আমাদের শৈশবে যেসব শিক্ষা আমরা গ্রহণ করেছি, তার সবটুকু যদি ভুল ধরে আধুনিকতার নামে পুরো প্রক্রিয়াই পাল্টে ফেলি- এর বিনিময়ে আমরা যা পাচ্ছি, সে হিসাব মেলানো কিন্তু জরুরি। জ্ঞান-মেধায় যেখানে বর্তমান প্রজন্মের আমাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! জাতি হিসেবে এটি একদিন আমাদের ‘মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত জাতি’ বলে পরিচিত করে তুলবে।
প্রকৃতপক্ষে মেধার বিকাশ জরুরি। প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা, মানসম্মত নিবেদিত শিক্ষক, দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ, গবেষণালব্ধ পদ্ধতির প্রয়োগ- যাতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং প্রকৃতপক্ষে ফলাফল অর্জন নয়, মেধাবী হওয়ার প্রতিযোগিতায় শামিল হয় নতুন প্রজন্ম। একটি পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন জরুরি। সমস্যা আসবেই, নিত্যনতুন সমস্যা সামনে আসবে এবং তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে পরিকল্পিত ও গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে। প্রত্যেকবার নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে সব সিস্টেমকে বারবার পাল্টানো সঠিক হবে না হয়তো।
বাংলাদেশে মোটামুটি চার স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়। এ চারটি স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে আরও নানা উপস্তর যেমন মক্তব, গ্রামভিত্তিক শিক্ষা, কওমি শিক্ষা, তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে এবং পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি ও পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবু কোথায় যেন শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এর মূল কারণ সমস্যার আলোকে কোনো গবেষণা ছাড়া মনগড়া সিদ্ধান্ত হুটহাট চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে; ফলে কোনো সিদ্ধান্তই কার্যত টেকসই হচ্ছে না। পরিবর্তনটা প্রয়োজন, তবে অবশ্যই তা হতে হবে পরিকল্পিত এবং যে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে বছরের শুরুতে। মাঝপথে যে কোনো পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের গতিপথ রুদ্ধ করে এবং নানা প্রশ্নের তৈরি করে।
আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি, পাঠ্যক্রম, শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার; শিক্ষকদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। বদলানো দরকার শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। পাঠ্যপুস্তকে সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা দরকার, তাও অবশ্যই গবেষণালব্ধ হতে হবে। আমার রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন কিছু পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করা আত্মঘাতী হবে বলেই মনে করি। তা হলেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সামঞ্জস্য আসবে। হতাশা সত্ত্বেও আমার বিশ্বাস- আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অন্ধকার অবস্থা থেকে আলোর পথে হাঁটবে। উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলবে দেশ, শিক্ষাব্যবস্থাও এ জাতির শক্তিশালী মেরুদণ্ড তৈরি করতে কার্যকর হবে।