শিক্ষার্থীদের মেলায় অংশগ্রহণ কেন জরুরি
- ড. মো. সবুর খান
শিক্ষার্থীদেরকে কর্মক্ষেত্রের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু গতানুগতিক ধারার পাঠ্যবইকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রদান করলেই চলবে না, তাদেরকে সময়পোযোগী ব্যবহারিক শিক্ষাও প্রদান করা উচিত। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এ লক্ষে ইতিমধ্যেই দুটি কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেমন আর্ট অব লিভিং ও এমপ্লয়াবিলিটি ৩৬০ ডিগ্রি। একজন মানুষ কর্মজীবনে কতটা সফল হবে তা নির্ভর করে তার জীবনযাপন ও চিন্তা ভাবনার ওপর। এজন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তাদের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য এ দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করেছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি সময়ে বিভিন্ন ধরনের মেলা, প্রদর্শনী, রোড শো ইত্যাদি হয়ে থাকে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত এই মেলা ও প্রদর্শনীগুলোতে অংশগ্রহণ করা। এইসব বড় বড় আয়োজনে শিক্ষার্থীরা যদি অংশগ্রহণ করে, তবে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভ করতে পারবে যা তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া কর্মজীবনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি একজন মানুষকে হতে হয় সেসব সম্পর্কেও তারা বাস্তব জ্ঞানার্জন করতে পারবে।
আমরা জানি, পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে শুরু করে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বদল ঘটছে কর্মক্ষেত্রে। এই সময়ে প্রযুক্তি এত দ্রুততার সঙ্গে এগোচ্ছে যে তার গতির কাছে আমরা বেশিরভাগ সময়ই হার মেনে যাচ্ছি। আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সামনে আসছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এই শিল্প বিপ্লবের কারণে, প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে অনেক মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন। একটা সময় ছিল যখন টাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফারদের অনেক চাহিদা ছিল। চাকরির বাজারে এদের কাজের অভাব হতো না। আজ কম্পিউটার তাদের সেই বাজার দখল করে নিয়েছে। সেজন্য শিক্ষার্থীদেরকে সেই অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনই জ্ঞান নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী এখনই নিজেদেরকে তৈরি করতে হবে। গতানুগতিক চিন্তাধারার ফলে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। আমাদেরকে প্রচলিত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আমাদেরকে জানতে হবে ভবিষ্যতে কোন কোন সুযোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া। এজন্য শিক্ষকদেরকেও নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। পরিবর্তিত এই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষকদেরকে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে এসে চিন্তা করা উচিত। তাঁরা যদি নিজেকে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন করতে না পারেন তাহলে শিক্ষার্থীদেরকে কীভাবে পরিবর্তন করবেন?
শিক্ষার্থীদেরকে তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শিক্ষকদেরকে ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষকরা যদি তাদের শিক্ষার্থীদেরকে ক্যারিয়ারে সফল হওয়ার পথ দেখাতে না পারেন তবে তাদের শিক্ষক হিসেবে গৌরব করার মতো কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে সফল হিসেবে গড়ে তোলা।
যতগুলো মেলা বা ইভেন্ট হচ্ছে ঢাকায় সেগুলোতে শিক্ষার্থীদেরকে অংশগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে শিক্ষকদেরকে। এছাড়া বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা, সম্মেলন, শিল্পকারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন পণ্য ও ধারনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। তাদের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তা তৈরি হবে। তাদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ বিকশিত হবে। কর্মক্ষেত্রে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে এইসব মেলায় অংশগ্রহণ খুবই জরুরি।
এইস অভিজ্ঞতা চাকরিতে প্রবেশের সময় শিক্ষার্থীরা যদি দেখাতে পারে তবে শুরু থেকেই তারা কর্মক্ষেত্রে একটি অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
শিক্ষাজীবন শেষ করার পরও আমাদের অনেক শিক্ষার্থী জানে না, কোথায় কীভাবে আবেদন করতে হয়। কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য সে উপযুক্ত সেটা সে জানে না। সুতরাং শিক্ষাজীবনেই তারা যদি এসব মেলা পরিদর্শন করে, বিভিন্ন শিল্পকারখানা পরিদর্শন করে তবে তাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা তৈরি হবে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কোন প্রতিষ্ঠানে সে ক্যারিয়ার গড়বে।
তাই এখন সময় এসেছে শিক্ষার্থীদেরকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকদের মেলায় যাওয়ার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল পরিদর্শন করার। মেলায় সাধারণত ওইসব প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের সুযোগ হবে তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার। এটা একটা বিরাট সুযোগ। এই সুযোগকে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো উচিত। অন্য সময় এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নাগাল পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। কিন্তু মেলাতে সহজেই তাদেরকে পাওয়া যায়। এই সুযোগে তারা প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে ছবি তুলতে পারে। সেই ছবি পরবর্তীতে তার পার্সোনাল ব্যান্ডিংয়ের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের কী উচিত নয় এই সুযোগ গ্রহণ করা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার, বিভাগীয় প্রধান, কোঅর্ডিনেশন অফিসার—প্রত্যেকের উচিত চোখ কান খোলা রাখা এবং কোথায় কোন সেমিনার, কর্মশালা, প্রদর্শনী, মেলা ইত্যাদি হচ্ছে সেসবের খোঁজ রাখা। শিক্ষার্থীদেরকে সেসব অনুষ্ঠানে পাঠানোও তাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে যদি কোর্স কারিকুলামের পরিবর্তন করতে হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বাজার চাহিদা অনুযায়ী আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে তৈরি করতে হবে। আমরা কিন্তু একসময় ভাবিনি যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিফ টেকনোলজিক্যাল অফিসারের প্রয়োজন হবে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিফ রোবটিক অফিসারের প্রয়োজন হবে। চিফ আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স অফিসারের প্রয়োজন হবে। এই যে নতুন নতুন পরিবর্তন আসছে সেসব পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য শিক্ষার্থীদেরকে তৈরি করা উদ্যোগ নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টারকে।
আমরা জানি, সারা পৃথিবীতে প্রচুর মেলা হয়, প্রদর্শনী হয়, কর্মশালা হয়, সেমিনার হয়। এসব মেলা সম্পর্কে পূণাঙ্গ তথ্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে পারবে। জামার্নিতে হ্যানোভা নামে একটি শহর আছে যেটি শুধু প্রদর্শনীর জন্য বিখ্যাত। এই শহরটি সারা পৃথিবীতে পরিচিত হয়েছে শুধু এক্সিবিশনের কারণে। আজ ইন্টারনেটের কারণে, ইউটিউবের কারণে এসব মেলা আমরা ঘরে বসেই দেখতে পারি। একইভাবে লাস ভেগাসের কথা আমরা বলতে পারি। সেখানেও প্রতিদিন কোনো না কোনো মেলা হচ্ছে।
বাংলাদেশেও প্রতিদিনয়ত মেলা হয়। খাদ্য শিল্পে ওপর মেলা হয়, প্রযুক্তি পণ্যের মেলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্পের মেলা হয়, আবসাবপত্রের মেলা হয়, ফার্মেসির ওপর মেলা হয়। এরকম শত শত ক্ষেত্রের ওপর প্রতিনিয়ত মেলা হয়। যেসব শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হতে চায় তাদেরকে এসব মেলা পরিদর্শন করা অবশ্য কর্তব্য। আমরা চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা চাকরি না খুঁজে চাকরি দেয়ার মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠুক। এছাড়া যারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী নয়, চাকরি করেত আগ্রহী—তাদেরও উচিত এসব মেলা পরিদর্শন করা। কারণ নিজের ক্যারিয়ার গড়ার আগে কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভের জন্য এসব মেলা পরিদর্শনের বিকল্প নেই।