বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ শ্রেণিকক্ষ কেমন হওয়া উচিত?
- গৌতম সাহা
কোনো শ্রেণিকক্ষ কেমন হওয়া উচিত সেটি বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে কীভাবে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে একত্র করে একটি শ্রেণিকক্ষকে শিক্ষণ-উপযোগী করে তোলা যায়। এটি অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষাদানের পদ্ধতি, প্রযুক্তিগত সুবিধা কী কী রয়েছে, শ্রেণিকক্ষের অন্যান্য সরঞ্জাম এবং শ্রেণিকক্ষের বিন্যাসের ওপর।
একটি শ্রেণিকক্ষের গঠনগত বিন্যাস যদি সঠিক না হয় তাহলে সেটি কিছুটা হলেও শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাদান এবং জ্ঞানার্জন ও বিতরণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্বল নকশাযুক্ত বিন্যাসের শ্রেণিকক্ষ ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে দেখতে বা বসতে সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা তাদেরকে ক্লাসে অমনোযোগী করবে। বর্তমান লেখায় আমি একটি মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ কীরকম হওয়া উচিত সেটি নিয়ে আলোচনা করবো।
একটি শ্রেণিকক্ষের গঠনগত বিন্যাস যদি সঠিক না হয় তাহলে সেটি কিছুটা হলেও শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাদান এবং জ্ঞানার্জন ও বিতরণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্গাকৃতির শ্রেণিকক্ষ
একটি মানসম্মত শ্রেণিকক্ষের আকার হতে হবে বর্গক্ষেত্র। মানে হলো, যে কক্ষের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান হবে। কিন্তু কক্ষটি যদি আয়তক্ষেত্রও হয় তাহলে সেটি প্রস্থ:দৈর্ঘ্য = ৪:৩ হওয়া উচিত। দরজা বা জানালার অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে কোন দেয়ালে বোর্ড বসানো হবে সেটি নির্ধারণ করা হয়। খেয়াল রাখতে হবে, শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের দরজা যেন দেয়ালে অবস্থিত বোর্ডের উল্টো দিকে হয়।
একইসাথে শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও থাকতে হবে এবং এ-জায়গাটি কখনোই যেনো শ্রেণিকক্ষ থেকে খুব বেশি দূরে না হয়। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হওয়া ও প্রবেশের জন্য এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই অপেক্ষা করার জায়গাটি যেন সবার জন্য আরামদায়ক হয়, সেটিও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এ-অংশে কিছু শিক্ষার্থীকে বসার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে।
আদর্শ শ্রেণিকক্ষের মেঝে
একটি আদর্শ শ্রেণিকক্ষের মেঝে হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী। সেটি সহজে পরিষ্কার করা যায় এবং অবশ্যই সেটি যেন সাশ্রয়ী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণত মেঝে কেমন হবে সেটি নির্ভর করে শ্রেণিকক্ষের ধরনের ওপর।
দেখা যায়, একটি আদর্শ শ্রেণিকক্ষে গুণগত মানের মেঝে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মেঝে তৈরিতে সাধারণত যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয় সেগুলো আরো বেশি উন্নত হতে পারে। বিশেষ করে, টাইলসের মেঝে দেয়া হলে সেগুলো পরিষ্কার করা সহজ এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। অনেক শ্রেণিকক্ষে কার্পেট বসানো হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। কার্পেট দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না, অনেক ধুলো জমে থাকে এবং পরিষ্কার করাও কঠিন। বরং কার্পেট শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার না করে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা যেমন শ্রেণিকক্ষের প্রবেশপথে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আদর্শ শ্রেণিকক্ষের জানালা
একটি আদর্শ শ্রেণিকক্ষে একের অধিক জানালা থাকতেই হবে, কারণ জানালা সূর্যের আলো ও বাতাস প্রবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবগুলো জানালায় সূর্যের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শেড সিস্টেম থাকা উচিত। এই শেড সিস্টেম এমন হবে যেটি ঘরকে অতিরিক্ত আলো থেকে রক্ষা পেতে কক্ষকে অন্ধকার অথবা হালকা আলোতে রূপান্তরিত করে দিতে পারে।
পাশাপাশি, এই শেডের রং রুমের রঙের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা উচিত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সূর্যের অতিরিক্ত আলো থেকে শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা। একই সাথে, বাইরের কোনো গতিবিধি যাতে শ্রেণিকক্ষে পড়াশুনায় বিঘ্ন না ঘটাতে পারে, সেখানেও এটি সহায়তা করতে পারে।
শ্রেণিকক্ষের দেয়াল
দেয়াল একটি শ্রেণিকক্ষের সামগ্রিক চেহারা কেমন হবে সেটি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেয়ালগুলোকে সাধারণত যে রং করা হয়, সেই রং নির্বাচনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রং সাধারণত দেয়ালের সুরক্ষা, দেয়ালকে রঙিন এবং দীর্ঘস্থায়ী রাখতে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের দরজায় শ্রেণিকক্ষের নম্বর, বিল্ডিংয়ের নাম, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো-সম্বলিত একটি নেমপ্লেট থাকা উচিত।
কক্ষ অ্যাকোস্টিক
কক্ষের অ্যাকোস্টিক হলো এমন একটি সিস্টেম যা কোনো কক্ষে শব্দতরঙ্গগুলো কীভাবে যোগাযোগ করে সেটিকে বর্ণনা করে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ঘর এবং এর মধ্যে থাকা সমস্ত বস্তু শব্দের বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। তাই প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে কক্ষ অ্যাকোস্টিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ বা সংস্কারের সময় কক্ষ অ্যাকোস্টিককে অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এটি একজন শিক্ষককে ভালো বক্তৃতা দেবার জন্য উৎসাহিত করে। একই সাথে এটি শ্রেণিকক্ষের বাইরের ও ভেতরের শব্দগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করে শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলে।
শ্রেণিকক্ষ এবং চকবোর্ড
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো হোয়াইট বোর্ডের তুলনায় চকবোর্ড বেশি ব্যবহার করা হয়। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো, চকবোর্ডগুলো টেকসই। এসব চকবোর্ড দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা যায় এবং সহজে পরিষ্কারও করা যায়। চকবোর্ডের আকার এমন হওয়া উচিত যাতে শ্রেণিকক্ষের কোনো দেয়ালের সর্বোচ্চ জায়গা নিতে পারে এবং লেখার জন্য সবচেয়ে বেশি জায়গা পাওয়া যায়।
চকবোর্ডের রং হিসাবে কালো রংকেই সাধারণত বেছে নেয়া হয়। এছাড়া চকবোর্ডের উচ্চতা এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা চকবোর্ডের সামনে টেবিল রাখার পরও এর নিচের লেখাগুলোকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পারে।
শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টরের ব্যবহার
প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ডান বা বাম দিকে প্রজেক্টর রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। এই প্রজেক্টরের প্রজেকশন স্ক্রিন শ্রেণিকক্ষের সামনে এমনভাবে বসানো উচিত যাতে ক্লাসের সকল শিক্ষার্থী সেটি দেখার সুযোগ পায়। এই প্রজেকশন স্ক্রিন ক্লাসের ছাদের সাথে আটকে দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত এবং এর অবস্থান এমন হবে যাতে এটি লেখার বোর্ডকে দেখার জন্য বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।
প্রজেকশন স্ক্রিনের আকার শ্রেণিকক্ষের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও আকৃতির ওপর নির্ভর করে। তাই শ্রেণিকক্ষ ডিজাইন করার সময় স্ক্রিনের আকারের বিষয় বিবেচনা করা উচিত। একই সাথে, এই স্ক্রিনের সামগ্রিক আকার কীরকম হবে সেটি নির্ভর করে শ্রেণিকক্ষের সবচেয়ে পেছনের সিট থেকে স্ক্রিনের দূরত্বের ওপর।
আদর্শ শ্রেণিকক্ষে আলোর ব্যবস্থা
শ্রেণিকক্ষে লেখার বোর্ড, শিক্ষকের জায়গা ও শিক্ষার্থীদের বসার জায়গায় যেন পর্যাপ্ত আলো থাকে, সেটি খেয়াল রাখা উচিত। বিশেষ করে, যেখানে রাতে ক্লাস হয় সেখানে ক্লাসে প্রয়োজনমতো আলো ও অন্ধকারের ব্যবস্থা থাকতে হবে, কারণ প্রজেক্টর ব্যবহার করার সময় কম আলোর দরকার হয়। এসব শ্রেণিকক্ষে এনার্জি বা এলইডি বাল্ব ব্যবহার করা যেতে পারে।
শ্রেণিকক্ষে লেখার বোর্ড, শিক্ষকের জায়গা ও শিক্ষার্থীদের বসার জায়গায় যেন পর্যাপ্ত আলো থাকে, সেটি খেয়াল রাখা উচিত। বিশেষ করে, যেখানে রাতে ক্লাস হয় সেখানে ক্লাসে প্রয়োজনমতো আলো ও অন্ধকারের ব্যবস্থা থাকতে হবে, কারণ প্রজেক্টর ব্যবহার করার সময় কম আলোর দরকার হয়।
শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্র
শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্রগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের জন্য সেগুলো কার্যকর, আরামদায়ক, টেকসই হতে হবে। শ্রেণিকক্ষে যেন সেগুলো বসানোর পর্যাপ্ত জায়গা থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। এগুলো যেন এমন হয় যাতে সহজে সরানো যায়, পরিষ্কার করা যায় এবং নিয়মিত পরিচর্যাও করা যায়।
শিক্ষার্থীরা এমন শ্রেণিকক্ষ পছন্দ করে যেখানে সে থাকতে আরাম বোধ করে এবং যেখানে শ্রেণিকক্ষের সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। শ্রেণিকক্ষটিতে যেন সবার জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা থাকে, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদেরকেই ভাবতে হবে, কেমন শ্রেণিকক্ষ চাই আমরা? কল্পনা আর বাস্তবতার মিশ্রণে আমরাই খুঁজে পেতে পারি আমাদের স্বপ্নের শ্রেণিকক্ষ।
ড. গৌতম সাহা সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র : বাংলাদেশের শিক্ষা