জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা

জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা

  • ফজিলাতুন নেছা শাপলা

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি। তাই সে বিষয়ে আলোচনা না করে বরং উন্নত বিশ্বের একটি দেশ জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে চাই। যদিও উন্নত এ দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোন তুলনাই চলে না, তবুও লেখাটি এ আশা থেকে লিখছি যে, কিছু তথ্য হয়তো কখনও কোনো সুদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো সুন্দর, পরিকল্পিত এবং সুশৃঙ্খল করে তুলতে সাহায্য করবে।

জাপানিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়কাল ধরা হয় ৬ বছর। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ওরা হিসেব করে ৬-৩-৩-৪ এভাবে। গ্রেড ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, তার পরের তিন বছর জুনিয়র হাই বিদ্যালয় এবং পর্যায়ক্রমে পরের ৩ বছর সিনিয়র হাই স্কুল (বাংলাদেশের কলেজের সমমান) এবং বিশ্ববিদ্যালয়- এভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রাথমিক এবং জুনিয়র হাই স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ বাংলাদেশের মতোই বাধ্যতামূলক।

বাধ্যতামূলক শিক্ষার এই স্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুটো ভাগ আছে। “সবার জন্য শিক্ষা” নীতিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার পাশাপাশি শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য আছে স্পেশাল ডিপার্টমেন্ট। এসব প্রতিবন্ধী বাচ্চারাও খুব সম্মানের সাথে সাধারণ বাচ্চাদের মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে, কিন্তু তাদের পরিচর্যা করা হয় বিশেষভাবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুরা সোম থেকে শুক্র সপ্তাহে পাঁচদিন করে সারা বছর সাধারণত ৩৫ সপ্তাহ ক্লাস করে। জাপানে গ্রেড টপকানোর কোনো নিয়ম নেই এবং প্রতিটি গ্রেডই বাধ্যতামূলক। এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকল শিশুকে বাধ্যতামূলকভাবে যে বিষয়গুলো পড়তে হয় সেগুলো হলো- জাপানি (ককুগো), সোশ্যাল স্টাডিজ (শাকাই), গণিত (সানসু), বিজ্ঞান (রিকা), লাইফ স্টাডিজ (সেইকাৎসু), মিউজিক (ওনগাকু), ড্রইং অ্যান্ড ক্রাফট (যুগা কোউসাকু), হোম ইকনোমিক্স (কাতেই), ফিজিক্যাল এডুকেশন (তাইকু)। এছাড়াও পড়তে হয় মোরাল এডুকেশন (দোওতকু) এবং সাথে সাথে অংশ নিতে হয় বিশেষ কার্যক্রম ও সমন্বিত পাঠ্যক্রমে।

খুবই দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী তাঁদের মেধা, শ্রম, সততা এবং নিষ্ঠা দিয়ে শিক্ষাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছেন যে, সাধারণ জাপানিজরা এই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর খুব আস্থাশীল এবং শিক্ষকদের খুব সম্মান করেন। জাপানিজ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের অন্যতম দুটি শর্ত হলো- consistency এবং monitoring। প্রতি দশ বছরে এদের বাস্তবসম্মত এবং প্রায়োগিক শিক্ষাক্রমগুলো পর্যালোচনা ও উন্নততর করা হয়।

বিদ্যালয় শুরু

ক. বিদ্যালয় ইউনিফর্ম: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কোনো ইউনিফর্ম নেই।

খ. জুতা: জাপানিজরা সাধারণত বাইরের জুতা পরে ঘরে ঢোকে না। বিদ্যালয়ের শিশুরা জুতা খুলে, একজোড়া বিশেষ জুতা পরে স্কুলে ঢোকে। কাপড়ের এই জুতাকে বলে উয়াবাকি।

কাপড়ের এই জুতাকে বলে উয়াবাকি

গ. সময়সূচি: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক-একটি ক্লাসের সময়সূচি হলো ৪৫ মিনিট এবং জুনিয়র হাই স্কুলে এর সময়সূচি হলো ৫০ মিনিট।

ঘ. দুপুরের খাবারের সময়: প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে খাবার বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয় থেকেই পরিবেশন করা হয়। এই খাবারের মান নিশ্চিত করার জন্য থাকেন একজন ডায়েটেশিয়ান যিনি শিশুদের জন্য প্রতিদিনের ক্যালরি মেপে ব্যালান্সড ডায়েট দিয়ে থাকেন এবং এই মেনু দেখে প্রতিদিনের খাবার প্রস্তুত করেন একগুচ্ছ দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুক। প্রত্যেকটি স্কুলে নিজস্ব রান্নাঘর আছে যেখানে খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় খাবারের গুণগত মান।

দৈনিক আহারের সময় শিশুরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তা গ্রহণ করে থাকে। তাদের প্রতিদিন খাবার গ্রহণের পূর্বে নিয়ম করে জানানো হয় তারা কী খাচ্ছে, কেন খাচ্ছে ইত্যাদি। শেখানো হয়, যিনি খাবারটি রান্না করেছেন, তাঁকে কী করে তারিফ করতে হয়। তারা সঙ্গীতের তালে তালে খুব আনন্দ নিয়ে রিল্যাক্স ভঙ্গিতে খাবার গ্রহণ করে। খাবার গ্রহণের সময়টাকে ওরা প্রার্থনার অংশ হিসেবে গণ্য করে থাকে।

বিশেষ পোশাকের কুকরা খাবার পৌঁছে দেওয়ার পর শিশুরা নিজেরাই পালাক্রমে নিজ নিজ ক্লাসে খাবার পরিবেশন করে।

নিয়মিত স্কুল লাঞ্চের পাশাপাশি যে বিশেষ দিকগুলোর দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়, তা হলো দৈনন্দিন স্বাস্থ্যসেবা। যে কোন কাজ করার পর শিশুরা যাতে হাত ধুতে পারে, তার জন্য আছে প্রত্যেকটি ফ্লোরে হাত ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা। সেখানে ছবির সাহায্যে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেয়া আছে হাত ধোওয়ার গুরুত্ব কী। প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করা বাধ্যতামূলক। জাপানিজ জুনিয়র হাই স্কুলসহ শিক্ষার সব স্তরে এ নিয়ম কঠিনভাবে মানা হয়।

জাপানে পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রত্যেকটি ফ্লোরে আছে পরিচ্ছন্ন সব শৌচাগার। বিশেষ এ শৌচাগার ছাড়াও মেয়েদের এবং ছেলেদের জন্য রয়েছে আলাদা শৌচাগার। প্রত্যেকটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে ব্যবহার করাটাও ওদের শিক্ষার একটি জরুরি অংশ।

ঙ. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সময়: খাবারের পর শিশুরা বাধ্যতামূলকভাবে তাদের নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ এবং পুরো বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় আঙ্গিনা পরিষ্কার করে। তাদের সাহায্য করেন বিদ্যালয় শিক্ষকেরা।

চ. বাড়ি ফেরা: দিনশেষে ওদের করতে হয় ক্লাব অ্যাকটিভিটিজ বা বু কাৎসুদোও এবং তারপর শিশুরা বাড়ি ফেরে।

জাপানের ক্লাসরুমগুলো এমন।

শিক্ষাবর্ষ

জাপানিজ স্কুলে শিক্ষাবছর শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে এবং শেষ হয় মার্চে। এদের শিক্ষাবছরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। সারা বছর ক্লাসের পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোতে চলতে থাকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিশেষ কার্যক্রম এবং এগুলোও বাধ্যতামূলক। এই বিশেষ কার্যক্রম বাদ দেওয়ার কোনো উপায়ই নেই।

প্রথম পর্ব বা ফার্স্ট টার্ম (এপ্রিল-জুলাই)

উদ্বোধন: এপ্রিলে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন শিশুরা আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু করে। আমাদের ১ জানুয়ারির মতো।

শুরু: এ অনুষ্ঠানে গ্রেড ওয়ানের শিশুদের খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে বরণ করে নেওয়া হয়। তারা নানা আচারনিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু করে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষাজীবন।

স্বাস্থ্যপরীক্ষা: এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বাচ্চাদের উচ্চতা, ওজন, বসবার উচ্চতা, স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য (চোখ, কান এবং দাঁত) পরীক্ষা করা হয়।

খেলাধুলা দিবস: এই দিনে খেলাধুলার বিশেষ আয়োজন করা হয়। বাবা-মা, দাদা-নানা এবং পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করে থাকেন।

বিদ্যালয় ট্রিপ: নিজস্ব প্রকৃতি, ইতিহাস এবং শ্রেণিকক্ষে যেসব অভিজ্ঞতা শিশুরা নিতে পারে না, সেসব জানানোর জন্য ফিল্ড ট্রিপের আয়োজন করা হয়। ফিল্ড ট্রিপে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা প্রতি বছর অন্য সব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিশেষভাবে কৃষিকাজ করা শিখে থাকে, যেমন- ধান কীভাবে লাগানো হয়, কীভাবে এর পরিচর্যা করতে হয় ইত্যাদি।

শ্রেণি পর্যবেক্ষণ এবং অভিভাবক-শিক্ষক কনফারেন্স: এদের শিক্ষাবর্ষে নির্দিষ্ট দিনে অভিভাবকদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ থাকে। তারা এই দিনে এসে তাদের বাচ্চারা কীভাবে কোথায় ক্লাস করছে, কী শিখছে এবং ক্লাসে তাদের কী কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন এবং ক্লাস শেষে সরাসরি ফিডব্যাক দেন এবং অভিভাবকদের ফিডব্যাক শিক্ষকরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন।

প্রথম পর্ব সমাপনী অনুষ্ঠান: জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম পর্ব সমাপনী ঘোষণা করা হয় এবং প্রথম পর্বের ক্লাস পারফরম্যান্স, কে ব্যক্তিগতভাবে কত বই পড়েছে, সৃজনশীল লেখালেখি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খেলাধুলা, নেতৃত্ব, বন্ধু, শিক্ষক এবং বাবা-মা এবং অন্যান্যদের প্রতি শিশুর কী মনোভাব- এসবের ভিত্তিতে প্রতিটি শিশুকে মূল্যায়ন করা হয়। আর বিশেষভাবে শিশুদের বিদ্যালয়, সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনে তারা কীভাবে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করে চলবে, সে সম্পর্কে তাদের নৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

বিশেষ পোশাকের কুকরা খাবার পৌঁছে দেয়।

গ্রীষ্মকালীন ছুটি: লম্বা সময়ের জন্য শুরু হয় গ্রীষ্মকালীন ছুটি।

দ্বিতীয় পর্ব বা সেকেন্ড টার্ম (অগাস্ট- ডিসেম্বর)

মিউজিক এন্ড ড্রামা এপ্রিসিয়েশন: শিশুদের সঙ্গীত এবং সুরের মাধ্যমে ‘সুন্দর মন এবং হৃদয়’ তৈরির জন্য এ আয়োজন।

শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: এ অনুষ্ঠানে শিশুরা তাদের চারুকলা, টেকনিক্যাল আর্টস, গার্হস্থ্য অর্থনীতি ক্লাস, সামাজিক শিক্ষা ক্লাস এবং বিজ্ঞান ক্লাসে যেসব প্রজেক্ট করে থাকে, তার একটি প্রদর্শনী হয় এবং শিক্ষার্থীরা সেখানে দলগতভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে মূল্যায়িত হয়। এছাড়াও এ অনুষ্ঠানে তারা তাদের সাংস্কৃতিক মেধারও বিকাশ ঘটায়।

দ্বিতীয় পর্বের সমাপনী: দ্বিতীয় পর্বের সমাপনী হয় ডিসেম্বরে।

ছুটি: শুরু হয় তিন সপ্তাহের শীতকালীন ছুটি।

তৃতীয় পর্ব বা থার্ড টার্ম (জানুয়ারি-মার্চ)

শুরু (শিগিও শিকি): জানুয়ারি মাসে শুরু হয়।

গ্রাজুয়েশন: মার্চ মাসের এই অনুষ্ঠানে শিশুদের গ্রেড ফাইনাল সুষ্ঠুভাবে শেষ করে নতুন ক্লাসে উঠবার জন্য খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়।

বছর শেষের উৎসব: মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে শুধু বছর শেষের আনুষ্ঠানিকতাই জানিয়ে দেওয়া হয় না, বরং নতুন বছরের শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রমও সম্পাদন করা হয়।

ছুটি: মার্চের শেষের ১০ দিন কিংবা এপ্রিলের প্রথম ১০ দিন এ ছুটিতে বিদ্যালয় বন্ধ থাকে।

বিশেষ পোশাকের কুকরা খাবার পৌঁছে দেওয়ার পর শিশুরা নিজেরাই পালাক্রমে নিজ নিজ ক্লাসে খাবার পরিবেশন করে।

মূল্যায়ন

শিশুদের রিপোর্ট কার্ড প্রতি টার্মে তাদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে ক্লাসে শিশুরা কী ধরনের ফলাফল করল, তার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ, নিয়মানুবর্তিতা, বন্ধু-শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের প্রতি তাদের মনোভাব এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট কার্ডটির বিন্যাস করা হয়।

প্রতিটি ক্লাস শেষে বাচ্চাদের কাছে থেকেও সরাসরি লেসন টপিক সম্পর্কে ফিডব্যাক নেওয়া হয়। নিজেরা কতটুকু বুঝেছে, বন্ধুরা তাদের বিষয়টি বুঝতে কতটুকু সাহায্য করেছে, পাশাপাশি ক্লাসের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় এবং ক্লাস শিক্ষক সম্পর্কে লিখিত ও মৌখিক ফিডব্যাক দিয়ে থাকে। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে অনেক কিছুই পরিবর্তন এবং পরিমার্জন করা হয়ে থাকে।

বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন

বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন খুব কড়া হওয়ার কারণে এবং এসব নিয়মকানুনের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকার জন্য শিক্ষার্থীরা খুব নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করে।

স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা

বিদ্যালয়গুলো খুবই নিষ্ঠার সাথে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকে। বিদ্যালয় থেকে যাওয়া বা আসার পথে এবং বিদ্যালয়ের ভেতরে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে তার প্রাথমিক চিকিৎসা বিদ্যালয়েই দেওয়া হয়ে থাকে এবং প্রয়োজনে পরিবার, হাসপাতাল এবং পুলিশের সাহায্য নেওয়া হয়। এছাড়াও সারা বছর ধরে বিদ্যালয় চিকিৎসক শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন।

হেলথ সেন্টার: বিদ্যালয়ের ভেতর হেলথ সেন্টার অবস্থিত। এখানে থাকেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স। তারা শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলো দেখেন। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা পরিবার বা হাসপাতালগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন এবং পাশাপাশি বাচ্চাদের নিয়মিত কীভাবে সুস্থ থাকা যাবে, তার গাইডলাইন দেন ও কাউন্সেলিং করেন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বছরজুড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানারকম স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয় এবং তা মনিটরও করা হয়। শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল, তার অবস্থা এবং পর্যায়ক্রমিক উন্নতি বা অবনতির রিপোর্ট সব সময় তার পরিবারকে যথাযথভাবে যথাসময়ে অবহিত করা হয়।

বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যে বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয়: উচ্চতা, ওজন, বসার উচ্চতা, চোখ, কান, যক্ষ্মা, ইলেক্ট্রো-কার্ডিওগ্রাম, ইউরিনালাইসিস, প্যারাসাইটস ইত্যাদি। তবে এর সবগুলো একইসাথে সব গ্রেডের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

শিশুরা বাধ্যতামূলকভাবে তাদের নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ এবং পুরো বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় আঙ্গিনা পরিষ্কার করে।

বিদ্যালয় ডাক্তার যে বিষয়গুলো দেখেন: ইন্টারনাল মেডিসিন, নাক, কান, গলা এবং দাঁতের চিকিৎসা বিদ্যালয়ের পেশাদার চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন।

ভ্যাক্সিনেশন: পূর্বের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখে প্রয়োজনানুসারে বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন টিকার ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, টিটেনাস এবং এনসেফেলাইটিস ইত্যাদি।

বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ

জাপানে PTA মানে প্যারেন্টস-টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন খুবই শক্তিশালী। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সমন্বয়ে গঠিত এদের যৌথ নেটওয়ার্কটি খুবই নিষ্ঠার সাথে কাজ করে। এ গ্রুপটি সরাসরি শিক্ষকদের কাজের ধরন সম্পর্কে অবহিত হন এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে নানারকম পরামর্শ প্রদান করে থাকেন এবং শিক্ষকদের কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ অভিভাবকদের অবহিত করেন।

কাউন্সেলিং

প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে কাউন্সেলিং কক্ষ আছে। সেখানে একজন নিয়মিত স্টুডেন্ট কাউন্সেলর বসেন এবং শিশুদের শিক্ষা-সংক্রান্ত এবং উপযুক্তভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নানারকম শারীরিক ও মানসিক জটিলতা সমাধানে পরামর্শ প্রদান করেন। প্রয়োজনে তারা অভিভাবকদের সাথেও পরামর্শ করেন।

বাড়ি পরিদর্শ: বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ ক্লাসের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর বাড়ি পরিদর্শন করেন এবং স্কুলে ও বাড়িতে বাচ্চাটি কী ধরণের আচরণ করছে, তার কোনো অসুবিধা আছে কি না এসব নিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করেন।

শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সভা: বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অভিভাবকরা বিদ্যালয় প্রিন্সিপ্যাল এবং বাচ্চাদের শ্রেণিশিক্ষকের সাথে দলগতভাবে কথা বলতে পারেন তাদের শিশুদের ব্যাপারে এবং তারা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ আদানপ্রদান করে থাকেন।

ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার : এই সাক্ষাৎকারটি সাধারণত শ্রেণিশিক্ষক এবং অভিভাবকের সাথে সরাসরি এবং এককভাবে হয়। তবে এটি ত্রিমুখীও হতে পারে। যেমন-শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক মিলে সাক্ষাৎকার। সেক্ষেত্রে সবাই মুখোমুখি কথা বলে নিজেদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করার সুযোগ পান।

জাপানিজ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক এবং জুনিয়র উচ্চ-বিদ্যালয়গুলোকে শুধু আদর্শ বিদ্যাপীঠ বললে ভুল বলা হবে, এই বিদ্যাপীঠগুলোকে একটি আদর্শ বা পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিদ্যালয়ের একেকজন শিক্ষককে মনে করা হয় সমাজের আদর্শতম মানুষ। আর প্রতিনিয়ত তাদেরকে অনুসরণ করে সমাজের অন্যান্যরা।

লেখক:

ফজিলাতুন নেছা শাপলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন শেখ বোরহান উদ্দীন কলেজে। সেখানে মনোবিজ্ঞান বিভাগে খণ্ডকালীন প্রভাষক ও বছরখানেক স্টুডেন্ট কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বছরদুয়েক উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করেন দুটো স্বনামধন্য বেসরকারি সংস্থায়। ২০০৫-এর নভেম্বরে সপরিবারে পাড়ি জমান জাপানে। ২০০৬- এর এপ্রিল থেকে ২০১৩-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা সাত বছর জাপানিজ সরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয়ে নেটিভ ইংলিশ টিচার (NET) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

Sharing is caring!

Leave a Comment