ভালো ফল অর্জনের চেয়ে সৎ মানুষ হওয়া বেশি জরুরি

ভালো ফল অর্জনের চেয়ে সৎ মানুষ হওয়া বেশি জরুরি

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন, অধ্যক্ষ, গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজ, গত ৩০ আগস্ট, ২০২০ তারিখে ক্যাম্পাস টিভি কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা বিষয়ক সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান ‘আধুনিক শিক্ষায় সক্রিয় প্রিন্সিপাল’ এ অংশগ্রহণ করেন। ক্যাম্পাস টিভির পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছে ড্যাফোডিল ইনটারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস’ অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন ও সম্পাদনা করেছেন সুজন নাজির।


সৈয়দ রাজু: ‘আধুনিক শিক্ষায় সক্রিয় প্রিন্সিপাল’ অনুষ্ঠানে আমাদের অথিতি হয়ে এসেছেন গিয়াসউদ্দিন মডেল কলেজের সম্মানিত অধ্যক্ষ জনাব মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমরা অধ্যক্ষ মহোদয়কে স্বাগত জানাচ্ছি।

আমরা জানি আপনাদের কলেজ আগে থেকেই টেকনোলজি ডিপেনডেন্ট, তারই ধারাবাহিকতায় এই করোনাকালীন সময়ে যেখানে সারা পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থা নড়বরে। সেখানে নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত রেখেছেন। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মদেরকে সংযুক্ত রাখার ক্ষেত্রে যারা অসাধারণ অবদান রাখছে তাদের মাঝে আপনার কলেজ একটি। স্যার আপনার শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস করা বা এই সময় তাদের পড়াশোনা চালিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কেমন দেখতে পাচ্ছেন বা তারা কীভাবে আপনার সাথে যুক্ত আছে বলে মনে হয়?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: ২০১০ সালের ১৪ই জানুয়ারি নারায়নগঞ্জের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি লক্ষ এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইহকাল এবং পরকালের কল্যাণের জন্য এই শিক্ষাকে কাছে নিয়ে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। শুরু থেকেই আমাদের কার্যক্রম অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যতিক্রম ছিল। আমরা বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির দিকে নজর দিয়েছি এবং আমাদের শিক্ষার্থীকে কিভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তারসাথে ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা নিয়ে কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। আমরাই নারায়নগঞ্জ জেলাতে প্রথম যারা প্রতিটি ক্লাস রুমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিশ্চিত করে নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসন কর্তৃক একটি মডেল কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করি। এই করোনাকালীন সময়ে যে একটি মহামারীর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আমরা কেউই তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা হঠাৎ করে শিক্ষার্থীদের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। ১৭ মার্চ ২০২০ যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল আমরা চিন্তিত হয়ে গেলাম কিভাবে আমাদের  শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে পারি। আমরা ২৪ মার্চ প্রাথমিকভাবে অনলাইন কার্যক্রম শুরু করি এবং এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন কার্যক্রম শুরু করি। আমি মনে করি, আমরাই বাংলাদেশে ২য় এবং নারায়নগঞ্জ জেলায় ১ম যারা ১ম বর্ষের বার্ষিক পরীক্ষা অনলাইনে নিয়েছি। আমরা ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীকেই অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাতে পেরেছি। বাকি ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনেক প্রতিবন্ধকতার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। আমরা তাদের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করছি।

সৈয়দ রাজু: কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে অনলাইনে শিক্ষা কার্র্র্যক্রমে অংশগ্রহন করতে পারছেন না। আপনি আশা দিচ্ছেন তাদের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শতভাগ অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে পারবেন। এমনটা ভাবতে পারছেন কেমন করে? এটাতো খুব কঠিন কাজ। আপনি যদি খুলে বলতেন, তাহলে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বিষয়টি জানতে পারবে।

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: আমরা অনলাইনে পরীক্ষা নিয়েছি ক্যামেরা অন করে, আমরা ক্লাসরুমে পরীক্ষা দিতে যে ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজন হতো আমরা অনলাইন কেন্দ্র্র্রেও তেমন ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্ট করেছি। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থীদের মূল্যয়ন আরো সহজতর হয়েছে। আমাদের ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রমে অংশ না নিতে পারার পেছনে কারণ হলো, আমরা যখন শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাসের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি তার পূর্বেই অনেকেই গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছেন, আর সেখানে ইন্টারনেট কানেকশন এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভালো না। তারপরও আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন খুব কম খরচে ইন্টারনেট/ওয়াইফাই সংযোগ যেন শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করতে পারেন। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরাই প্রথম যারা বিনা সুদে এবং বিনা জামানতে গিয়াসউদ্দিন মডেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঋণের সুবিধা দিচ্ছি। শিক্ষার্থী তার প্রয়োজন অনুযায়ী আবেদন করবে। তারপর আমরা পর্যালোচনা করে তার প্রয়োজনমতো বরাদ্ধ দিচ্ছি। যা শিক্ষার্থীর বাবার পরিশোধ করতে হবেনা, তা শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠিত/সাবলম্বী হওয়ার পর তার নিজের মূল্যবোধ থেকে পরিশোধ করতে পারবেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আত্মসাবলম্বী করে তোলা। তারা চলার পথে হয়তো সাহযোগিতা নিবে কিন্ত যখন তারা সাবলম্বী হবে তখন সেটা পরিশোধ কবে দিবে আমরা সেই পথে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছি।

সৈয়দ রাজু: আপনি বললেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে একটা মূল্যবোধ তৈরি হবে। আমি সহযোগিতা নিয়েছিলাম আমি সেটা পরিশোধ করে আমার পরবর্তী প্রজন্মের কারও জন্মের পথটাকে সুগম করে যাব। যেন অভিজ্ঞতাটা ভালো থাকে। সেই জায়গায় কি আপনারা ফেরত পাওয়ার জায়গায় কি গিয়েছেন?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন:  না, আমরা সেটা আশাও করিনা। আমরা শিক্ষার্থীদের দিচ্ছি যেন তারা এইটা ভাবতে পারে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে এটা পরিশোধ করতে পারে। আমরা তার সততা এবং দায়বদ্ধতার উপর ছেড়ে দিয়েছি এবং আমরা চাচ্ছি সে যেন আমাদের সহযোদিতায় তার কাঙ্খিত গন্তব্যে ফিরে যায়।

সৈয়দ রাজু: শিক্ষার মূল জায়গাটাই হতো এডাপ্টেশান (মানিয়ে নেওয়া) অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারাই শিক্ষার বা শিক্ষিত মানুষের কাজ। আপনাদের শিক্ষকদের ট্রেনিং ডেভলেপমেন্টের জন্য কি ধরনের কাজ করছেন? সাধারণ সময় আর করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে ক্লাসের দিক একটু আলাদা। সেই দিকটা কিভাবে কাজ করছেন?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: করোনা পরিস্থিতির পূর্বে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পূর্ন নিষেধ করি। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে যখন সব বন্ধ হয়ে গেছে তখন আমরাই শিক্ষকদের মাঝে সভা করে অভিভাবকদের জানাই অনলাইনে ক্লাসের ব্যাপারে। তখন অভিভাবকরাই অবাক হয়েছিল যেই কলেজ ফোন ব্যবহার নিষেধ করেছিল তারাই এখন শিক্ষার্থীদের ফোন দেয়ার কথা বলছে। এখানে বলার কারণ হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে বদলাতে হবে, তার সাথে সামঞ্জস্য করে চলতে হবে, তাছাড়া পৃথিবীতে হারিয়ে যেতে হবে। আমাদের কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই শতভাগ পাশ নিশ্চিত করছি। আমরা শিক্ষকরা টিম ওয়ার্ক করি। আমাদের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা মহোদয় আমাদের শিখিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক তিনজনের মাঝে যদি সমন্বয় থাকে, তাহলে অবশ্যই সফলতা আসবে। আমরা আমাদের শিক্ষকদের একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। যেহেতু আমরা আগে থেকেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাস করি এবং আমাদের এমএমসি যে সফটওয়্যার আছে সেখানে আমাদের শিক্ষকরা আগে থেকেই প্রশিক্ষিত ছিল। তাই আমাদের তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়নি।

সৈয়দ রাজু: এই পরিস্থিতিতে টিম ওয়ার্ক নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানকে আপনি কি পরামর্শ দিবেন এবং এর গুরুত্ব নিয়ে যদি আলোচনা করতেন।

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভার্নিং বডির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি গভার্নিং বডির মাঝে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে সুষ্ঠভাবে কাজ সম্পাদন করা কঠিন হয়ে যায়। তাই আমরা প্রথম থেকেই টিম ওয়ার্ক করার চেষ্টা করেছি। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর মাঝে যদি সমন¦য় থাকে তাহলে সফলতা সুনিশ্চিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের ডাটাবেজ থাকতে হবে প্রতিষ্ঠানে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ডাটাবেজ নাই বলে এই করোনা পরিস্থিতিতে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারছেনা। ডাটাবেজের মাধ্যমে খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের মাঝে এবং অভিভাবকদের মাঝে পৌছানো সম্ভব এবং আমরা তা পেরেছি। অনেক সময় বিভিন্ন অভিভাবক ব্যস্ত থাকেন। তাই ছাত্র শিক্ষকের যোগাযোগটা বেশি হতে হবে, তাদের সম্পর্কটা মধুর হতে হবে।

সৈয়দ রাজু: করোনাকালীন সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ডিসকানেক্টেড হয়ে যাওয়া। আগে প্রতিষ্ঠানে আসতো দেখা হতো নানাভাবে। এই করোনা পরিস্থিতিতে আপনারা কি শুধু সিলেবাস নিয়েই পড়াচ্ছেন? নাকি সিলেবাসের বাইরেও পড়াশোনা করাচ্ছেন?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: আমাদের পৃথিবীতে পূথিগতবিদ্যা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নৈতিকশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। আমি জিপিএ ৫ পেলাম, ভালো রেজাল্ট করলাম, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলাম কিন্তু আমার নৈতিকশিক্ষা লাভ করতে পারিনি। তাহলে সেই শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। সে শিক্ষা দিয়ে দেশ জাতি কিছুই পাবেনা। আমরা প্রথমেই আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিকশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেষ্টা করি। ভালো ফল অর্জনের চেয়ে সৎ মানুষ হওয়া বেশি জরুরি। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা মহোদয় এই প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পরিবেশের নিশ্চিত করেছেন। সকল ধর্মের শিক্ষার্থীদের যার যার ধর্ম অনুযায়ী নৈতিকশিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করি। আমরা পুথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার জন্য ক্লাসের ব্যাবস্থা করেছি এবং প্রতিদিন সকালে এসেম্বলির মাধ্যমেও এই কাজটা করে থাকি। শিক্ষার্থীদের যত কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিজ সম্পৃক্ত করা যাবে সে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকবে এবং মানসিক বিকাশ ঘটবে।

সৈয়দ রাজু: এসময়ে দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীরা ঘরে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে অধৈর্য্য হয়ে গেছে। অনেকে হয়তো স্কুলে/কলেজে আসছেনা কিন্তু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। স্বাস্থবিধি কেউ হয়তো মানছে কেউ আবার মানছেনা। তাই সেই জায়গাটাকে কেন্দ্র করে আপনারা কোনো কো-কারিকুলাম বা এক্সট্রা-কারিকুলাম এক্টিভিটিজ করছেন কিনা?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রথএেন মোটিভেট করেছি সবাই যেন স্বাস্থ্যসচেতনতা মেনে চলে। কারণ আমরা আগে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। আমরা লাইভ শো এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করার পরামর্শ দিয়েছি। আমরা এখনো কোনো কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিজ করতে পারিনি। কিন্তু এই ব্যাপারে প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীদের মোটিভেট করছি। তবে সময়টা যেহেতু দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে তাই আমি মনে করি তাদের মানষিক প্রশান্তির জন্য শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের কিছু করা উচিত।

সৈয়দ রাজু: আমরা ক্যাম্পাস টিভির পক্ষ থেকে তেমনই একটা চিন্তাভাবনা মাথায় রেখেছি। আপনাদের মতো যারা ভাবেন, যারা সিলেবাসের বাইরেও ভাবেন তাদেরকে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়েই আমরা সেরকম একটি কারিকুলাম তৈরি করতে চাই। এই ক্যাম্পাস টিভিতে নিয়মিত একটি অনুষ্ঠান করতে চাই। এই করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের মাসের পর মাস প্রতিষ্ঠান বন্ধ যাচ্ছে। তার মাঝেও আশার আলো হলো শুরুতে আমরা অনলাইন ক্লাসের তেমন গ্রহনযোগ্যতা না পেলেও আস্তে আস্তে আমরা তার গ্রহনযোগ্যতা পাচ্ছি এবং পরীক্ষাও নিচ্ছি। অনলাইন ক্লাসের এখন কোনো বিকল্পই নেই। স্যার আপনি একটু হাইলাইট করেন যে, আমরা কি থেমে যাচ্ছি, নাকি আরো বেগবান হবো সামনে?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: আমি মনে করি আপনিই যে কথাটি বলেছেন যেখানেই বাধা সেখানেই পথযাত্রা সেটিই বাস্তবসত্য। অনলাইন ক্লাসের কথা আমরা বাংলাদেশে আগে চিন্তাও করতাম না। আমার সাথে অনেকেই একমত হবেন যে, আমরা অনেক সময় ঠিক সময়ে সিলেবাস শেষ করতে না পারলে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করি। কিন্তু এখন থেকে করোনা পরিস্থিতির পরেও আমরা যেকোনো সময়ে ঘরে বসেই অতিরিক্ত ক্লাস করাতে পারি। তাই বলতে পারি, করোনা আমাদের দুঃখের সাথে সাথে সফলতাও দিয়ে গেছে। আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। তাই আমাদের শিক্ষার্থীদেও মোটিভেট করতে হবে তারা যেন প্রযুক্তির খারাপ দিক না নিয়ে ভালো দিকটা যেন গ্রহণ করতে পারে। যত ভালো দিক গ্রহণ করতে পারবে ছাত্র-ছাত্রী তত সফলতা লাভ করতে পারবে। আমরা হয়তো উন্নত বিশ্বের মতো প্রযুক্তির দিক দিয়ে  শতভাগ সফলতা লাভ করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করতেছি কিন্তু আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী যারা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে কিন্তু করোনার কারনে দেশে চলে এসেছে তারা কিন্তু থেমে থাকেনি, প্রায় একবছর তারা আমাদের দেশ থেকেই অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। আমরাও সফলতা আনতে পারবো বলে আমি আশাবাদী।

সৈয়দ রাজু: আমিতো আরেকটু আশাবাদি হতে চাচ্ছি যে, কোনো একদিন আমেরিকার শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে অনলাইনে পড়বে। সেটা কি হতে পারেনা স্যার?

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: অবশ্যই হতে পারে। এখন তো অলরেডি পড়ছে। অনেক দেশ থেকে আপনাদের ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসছে। এটিতো আমাদের জন্য পজেটিভ যে আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থা এগুচ্ছে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছিনা। বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে, সফলতার পথে চলতে গেলে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকবেই কিন্তু থমকে গেলে হবেনা, এগিয়ে যেতে হবে।

সৈয়দ রাজু: আমার এই মূহুর্তে মনে হলো আমি গত বছর এই দিনে গ্রিসে ছিলাম। গ্রিসে এথেন্সে একটা স্কুল উনারা করেছেন আমাদের একজন বাঙালি যিনি খুবই সক্রিয় মানুষ যিনি ওখানে কাজ করছেন। উনার সেই স্কুল নিয়ে বলছিলেন কিভাবে সেটার উন্নয়ন করা যায় কিভাবে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষক আনা যায়। এখনতো আমার মনে হচ্ছে যদি কোনো প্রবাসী তার সন্তানকে বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায় তাহলে ওখান থেকেই অনলাইনেই আপনার নারায়নগঞ্জ কলেজেই পড়তে পারবে।

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: অবশ্যই স্যার, একটা জিনিস আপনি লক্ষ্য করবেন। কয়েক বছর আগেও আমাদেও দেশের বাচ্চারা ইন্টারমিডিয়েটের পর ইন্ডিয়া বা অন্যান্য পার্শবর্তী দেশে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন আমাদেও দেশে বিশেষ করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এবং পাবলিক ইউনিভার্সিটি বাড়ার পর ৯০শতাংশ শিক্ষার্থীই আমাদের দেশেই লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থা এখন অনেক উন্নত।

সৈয়দ রাজু: স্যার যেটা বলছিলেন সেটা আসলেই বাস্তবসম্মত। আমাদের দেশে যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না হতো, তাহলে আমাদের অনেক বৈদেশিক মূদ্রা চলে যেতো। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালোদিক খারাপ দিক থাকে। কিন্তু সেখান থেকে গঠনমূলক অনেক জিনিস আমরা বের করতে পারি।

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: আমাদের ক্লাসের সময় অনেক সময়ে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবন্ধতার মাঝেও আমাদেও এগিয়ে যেতে হবে। একটা শ্রেণি বলছে, এখন দশ শতাংশ শিক্ষার্থী যে বঞ্চিত হচ্ছে এরা কি করবে? আমি আমার শিক্ষার্থীদের আস্বত্ত¡ করেছি। যারা পারছেনা যারা নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছে তাদেরকেও আমি বাকি নব্বই ভাগের মাঝে আনতে পারবো। সবচেয়ে আশার আলো হলো, আমাদের এক ছাত্র খাগড়াছড়ি থেকে অনলাইনে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছে। তাই আমি মনে করি দশ শতাংশের জন্য আমি ৯০ শতাংশকে স্থির করে দিব তা ঠিক হবেনা। আমরা কিভাবে তাদের ৯০ শতাংশের মাঝে ঢুকাতে পারবো আমাদেও সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা এই ব্যাপারে আশাবাদী।

সৈয়দ রাজু: ধন্যবাদ স্যার, আমার মনে হয় আপনি এই মূহুর্তে যে কথাটা বললেন সেটাই আমাদের অনুষ্ঠানের শেষ কথা হওয়া উচিত বা যে কথাটা নিয়ে আমরা অনুষ্ঠান শেষ করতে চাই অর্থাৎ সমস্যা থাকবেই সেটাকে সমাধান করতে হবে এবং সমাধান করতে গিয়ে আমরা যদি দেখি যে ১০শতাংশের জন্য কি ৯০শতাংশকে আমরা ডিপ্রাইভড করবো নাকি ৯০শতাংশকে এগিয়ে নিয়ে ১০শতাংশকে সহযোগিতা করবো। অর্থাৎ আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ে দেখেছি যারা একটু ভালো কানেক্টিভিটির মাঝে আছে তারা দূর্বল কানেক্টিভিটির শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছে। অর্থাৎ পিয়ার এডোকেশনকে আমরা এই সময় প্রমোট করছি আমাদের ইউনিভার্সিটিতে। অর্থাৎ তারা বন্ধুদের খেয়াল রাখছে। যেমন অনেক সময় ক্লাসটা হয়তো এক ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের নিজস্ব যে প্লাটফর্ম আছে ব্লেনডেড লার্নিং সেন্টারে সেই ক্লাসের রেকর্ডিংটা থেকে যাচ্ছে। এতে যারা কানেক্টিভিটির জন্য ক্লাস করতে পারেনি তারা যথন কানেক্টেড হতে পারবে তখনই রেকর্ডিংয়ে পুরো ক্লাসটাই দেখতে পারছে।

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন:  জি স্যার। ছেলে মেয়েদের মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে। আমি আমাদের কো-কারিকুলামের কিছু অংশ এখানে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। আমি আমাদের কলেজে বস্ত্র ব্যাংক তৈরি করেছি। আমাদের অনেকেরই পুরাতন অপ্রায়োজনীয় বস্ত্র আছে যেগুলো আমরা ফেলে রাখি কিন্তু আমরা দেখি রাস্তাঘাটে অনেক বাচ্ছারা বস্ত্রের অভাবে খালিগায়ে আছে। আমরা আমাদের বস্ত্র ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন-পুরাতন কাপড় মিলিয়ে তাদের দিয়ে আসি। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের মানবিক করার জন্য এটি অত্যন্ত ভ‚মিকা রাখে। আমরা ব্লাড ব্যাংক তৈরি করেছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিনামূল্যে ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় করে দিচ্ছে এবং আমাদের নাম্বারগুলো আমরা দিয়ে দিচ্ছি যেন যখনই কোনো মূমুর্ষ রোগীকে বাচাতে রক্তের প্রয়োজন হবে। আমরা সেটা ব্যাবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করবো। এমনকি করোনা যখন পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করছিলো আমরা ছাত্র শিক্ষক মিলে নারায়নগঞ্জ শহরে প্রায় বিশ হাজার সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেছি। আমরা যখন মানবিক হবো, একটা শিক্ষার্থী যখন মানবিক হবে তখন তার সহপাঠীও বিষয়টা বুঝবে। এভাবে আমরা একটি শিকলের মাধ্যমে আবদ্ধ হতে পারবো। এভাবে মানবিক গুনাগুন গুলোকে জাগ্রত করার মাধ্যমেই সফলতা আসবে।

সৈয়দ রাজু: স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনি সময় দিয়েছেন।

মীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসাইন: ধন্যবাদ জানাচ্ছি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যাম্পাস টিভিকে। এই প্রোগ্রামের আয়োজন করার জন্য। করোনাকালে ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধা ছিল, দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো এবং আমাদের বাংলাদেশকে আমরা আবার সোনার বাংলা তৈরি করতে পারবো, হতাশার সূর্য ডুবে আবার নতুন সূর্য উদিত হবে সেই প্রত্যাশা রাখছি। আমাদের ছাত্র সমাজকে বলতে চাই তোমরা পথভ্রষ্ট হয়োনা, তোমরা শিক্ষার সাথে থাকো, নৈতিকতার সাথে থাকো। তাহলে অবশ্যই সফলতা লাভ করতে পারবে। নৈতিকশিক্ষা এবং তোমার বাবা-মার প্রতি সম্মান, গুরুজনের প্রতি সম্মান এবং শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত থাকো তাহলে তোমার সফলতা আসবে এবং নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটবে। ধন্যবাদ সবাইকে।

Sharing is caring!

Leave a Comment