সমস্যার অপর নাম সুযোগ
ড. মো. সবুর খান
আজকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এই বিশ্বে সকলেই যখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে, তখন অনেকেই আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি কে, কেন, কোথায় এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আবার এরই মধ্যে যারা প্রকৃত বুদ্ধিমান, তারা কিন্তু শুধু মাত্র সমস্যা গুলোকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকে কিভাবে এর সমাধান করা যায় তা নিয়েই দিন রাত চেষ্টা করে যাচ্ছে। আজ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই অধিকাংশ মানুষ চাকরী হারিয়ে বেকার হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা, ইউরোপের মত উন্নত দেশে আজ প্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। একটি সময় যারা পৃথিবীর সকল দেশগুলোর মধ্যে প্রায় সকল সেক্টরে রাজত্ব করেছে, আজ তাদেরই দেশে জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, পর্যাপ্ত খাদ্য নেই। আজ তারাও অন্যান্য দেশগুলোর মত রিলিফ নিচ্ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তা বারবার বলেছেন, “আমি অনর্থক কাউকে সৃষ্টি করি নাই”। সুতরাং এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্ম কখনই অনর্থক নয়। সেই সাথে আজকের এই মহামারী পরিস্থিতিও কিন্তু কোন অনর্থক সৃষ্টি নয়। এটি ঘটার পিছনেও রয়েছে সৃষ্টিকর্তার আপন উদ্দেশ্য। আমরা ইতিহাসে বহুবার দেখেছি একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর মানুষ যখন সীমা লংঘন করা শুরু করে তখন সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে এ সকল কঠিন পরিস্থিতির সূচনা করে মানবজাতিকে জানান দেন যে, আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার নিয়মের মধ্যে থেকেই চলতে হবে, সীমা লংঘন করা যাবে না। পৃথিবীতে যারা বিজ্ঞ, দূরদর্শী ও শুধু মাত্র পজিটিভ চিন্তা করতে পারে, তারা অনেক সময়ই এ ধরণের কঠিন পরিস্থিতি গুলো Predict করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন ১৯৬২ সালে ইটালিয়ান একটি ম্যাগাজিনে একটি ছবি ছাপা হয়েছিল যার ক্যাপশন ছিল ‘২০২২ সালের পৃথিবী’। ছবিটিতে দেখা গিয়েছিল মানুষেরা সকলে গ্লাসে ঢাকা এক প্রকার গাড়িতে চড়ে চলাফেরা করছে যেখানে শুধু একজন চালকই বসতে পারে। অর্থাৎ মানুষ তখন কারো সাথে সম্পর্ক করতে চাইবে না। মানুষ চাইবে একা একা চলাফেরা করতে ও একা বেঁচে থাকতে। মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বেড়ে যাবে। আবার ২০১১ সালে হলিউডে ‘Contagion’ নামে একটি মুভি মুক্তি পায়, যেখানে দেখানো হয় এক অজ্ঞাত ভাইরাসের কবলে পড়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ একে একে মারা যাচ্ছে ও সেই ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য নানান রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োগ করছে। সেই মুভিতে দেখানো গোটা পরিস্থিতিই মিলে যায় আজকের এই করোনা আক্রান্ত বিশ্বের সাথে। যুগে যুগে এভাবেই অনেক রকম উপায়ে কিছু মানুষ Predict করেছে, গোটা বিশ্বকে সাবধান করার চেষ্টা করেছে ভবিষ্যতের অনাগত বিপদসমূহ সম্পর্কে।
আজকের বিশ্বে করোনার কারণে যেখানে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বহু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখ দেখছে ও লাখ লাখ মানুষ চাকরী হারাচ্ছে, তেমনি ভাবে যারা এই সময়টিকে পজিটিভ ভাবে নিয়ে যুগোপযোগী উপায়ে সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে, একমাত্র তারাই লাভবান হচ্ছে। যেমন ‘Zoom’ এর মত কোম্পানী আগে যেমন তাদের ফ্রি ভার্সন দিয়েও কাস্টোমারদেরকে আকর্ষন করতে পারতো না, আজ তারাই অনলাইন সেবাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানী গুলোকে পিছনে ফেলে দ্রুততরে এগিয়ে যাচ্ছে মুনাফার দিকে। আমরা আগে কথায় কথায় ‘Uber’ এর উদাহরণ দিতাম কিন্তু আজ ‘Uber’ বন্ধ, সারা বিশ্বের হোটেল গুলো বন্ধ, Airlines গুলো বন্ধ কিন্তু টিকে আছে একমাত্র তারাই যাদের ব্যবসা ছিল অনলাইন কেন্দ্রিক। যেমন ‘Twitter’ ইতঃমধ্যে ঘোষনা দিয়েছে যে তারা অফিস খোলার আর প্রয়োজন মনে করে না। তাদের কর্মীরা বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারছে এবং করোনা পরবর্তী সময়েও তারা চাইলে বাড়িতে বসেই অফিস করতে পারবে। একই কাজ ‘SISCO’ করেছিল আজ থেকে ১৫ বছর আগে যা এখনও বহাল আছে। ‘Google’ ও আজ বেশ ভাল ফর্মে আছে তাদের অনলাইন ভিত্তিক সেবার কারণে। অর্থাৎ যারা প্রকৃত দূরদর্শী, তারা আগে থেকেই নিজেদের ব্যবসা ও কর্মকান্ডকে সকল বিপদের কথা চিন্তা করে সেভাবেই সাজিয়ে নেয়।
কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা বা এই এই South East Asia এর মানুষেরা আমাদের সুযোগ গুলোকে কাজে লাগাতে পারিনি। বিশ্বে যত Technology আবিষ্কার হয়েছে তার প্রায় সবই আমাদের হাতের লাগালে কিন্তু আমরা সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে ও আমাদের ব্যবসাগুলোকে Automated করতে পারিনি, ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারিনি। যদি পারতাম, তবে আজকের এই বিপদের দিনে আমাদেরকে বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকতে হতো না। এখন আমরা সকলে লকডাউনের মধ্যে আছি। দেশ বিদেশের সকল নামি দামী দোকান ও প্রতিষ্ঠান আজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ৩/৪ মাস বা তারও পরে যখন সেই সকল দোকান ও প্রতিষ্ঠান খুলবে তখন দেখা যাবে দোকান ও প্রতিষ্ঠানের সকল দামী দামী জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে, ছত্রাক পড়ে গেছে। মানুষ তখন আর সেগুলোকে ব্যবহার করতে পারবে না। সেগুলো তখন মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মানুষ তখন বাধ্য হবে সেগুলো ফেলে দিতে। অর্থাৎ মানুষের সম্পদ তখন মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মানুষ চাইলেও তার সম্পদ গুলোকে আর কাজে লাগাতে পারবে না। আমরা সবাই জানি যে আজকের এই বিপদের সময় টাকা কোন কাজে আসেনি। সমাজে যারা বিত্তবান, তারা সকলেই আজ ভীত। তাদের অর্থ কোন কাজে আসেনি করোনা থেকে তাদেরকে বাঁচাতে। আবার একই সাথে যারা প্রতিশ্রুতিশীল, দূরদর্শী ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারদর্শী তারা কিন্তু সামনে এগিয়ে গেছে, তারা তাদের কাজ ও ব্যবসাকে গুছিয়ে নিয়েছে, Automated করে নিয়েছে।
দেশের Young Generation যারা আছে, তাদের অধিকাংশকেই এখন দেখা গেছে Social Mediaতে একে অপরের সমালোচনা ও দোষারোপ করে। আবার এদের মধ্যে একটি দল আছে, যাদের আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা নিজেদের নানান রকম Soft Skills গুলোকে Develop করেছে। তারা বিভিন্ন Online Platform থেকে তাদের পছন্দ মত নানান রকম কোর্স করেছে। নিজেদেরকে করোনা পরবর্তী সময়ের চাকরীর বাজারের জন্য প্রস্তুত করেছে। আর এসকল Creative ছাত্র ছাত্রীদের Skills Development এর জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি ও ‘GoEdu’ Online Platform কয়েক ডজন অনলাইন ফ্রি কোর্স তাদেরকে উপহার দিয়েছে। কতজন সেই কোর্স গুলোকে নিজেদের উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছে তা আমরা জানি না কিন্তু এটুকু বলতে চাই, যারা সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছে তারাই আজকের এই কঠিন সময়ের প্রকৃত যোদ্ধা ও ভবিষ্যতে তাদেরকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা মনে করি, এই সময়টিকে যে যেভাবে পারে, সঠিকভাবে কাজে লাগানো উচিত। আজ যে সময়টা চলে যাচ্ছে, সেটা আর ফিরে আসবে না। দেশে বিদেশের অনেক মানুষ আছে যারা Paralyzed হয়ে বছরের পর বছর নিজ বাসায় বা হাসপাতালে পড়ে আছে। তাদের গোটা জীবনটাই কাটছে লকডাউনের মধ্যে। আমাদের সকলের ‘Stephen Hawkin’ এর কথা মনে আছে। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যার শুধু মস্তিষ্ক ছাড়া দেহের আর কোন কিছুই সচল ছিল না কিন্তু তিনি তার সেই মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়েই সারা বিশ্বকে জয় করেছেন। তার মৃত্যুর পরেও তার উদ্ভাবিত নানান আবিষ্কার ও Theory নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষই অসম্ভব শক্তিশালী, অসম্ভব জ্ঞানী ও অসম্ভব সম্ভাবনাময়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমরা আমাদের এই জ্ঞান ও শক্তিকে সমস্যা সমাধানে কাজে না লাগিয়ে শুধু সমালোচনা করেই আমাদের সম্ভাবনা গুলোকে নষ্ট করে ফেলছি।
আমরা বর্তমান বিশ্বের আজকের এই অবস্থার জন্য করোনা ভাইরাসকে দায়ী করছি এবং ভবিষ্যতের ভয়ে আমাদের অনেকেই আজ হতাশ ও বিষন্নতায় নিমজ্জিত আছি। কিন্তু অন্যদিকে অনেকেই আছে যারা বর্তমান এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে পৌছে দিচ্ছে সফলতার দ্বারপ্রান্তে। যেমন, চায়নার Electronics Company গুলো যখন দেখলো যে তারা লকডাউনের কারণে ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা তাদের ব্যবসা চেঞ্জ করে করোনা ভাইরাসের Protective Equipement তৈরী করে সারা পৃথিবীর ৯০% ব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসছে। আমরা দেখেছি করোনা ভাইরাসকে পূঁজি করে ভিয়েতনাম সারা পৃথিবীর সামনে নিজেদেরকে মডেল হিসেবে স্থাপন করেছে যার কারণে সকলে এখন ভিয়েতনামে Invest করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে তাইওয়ান প্রমাণ করেছে যে এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাদের আছে। সেই সাথে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমাদের প্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা এই পরিস্থিতির মধ্যে অপরের ও প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেছে আবার অনেকেই আছে যারা সম্মুখ যুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের পাশে থেকে এগিয়ে এসেছে। আমাদের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক বড় Contribute করেছে। এটা ঠিক যে, প্রথমদিকে আমাদের অনেকেই ঠিক মত না বোঝার কারণে Online Education বিক্ষিপ্ত ভাবে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এর থেকেও Best Service দিতে হবে যার ফলশ্রুতিতে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি Blended Learning Center। আমরা বিশ্বাস করি যে, এখানেই যদি আমরা আমাদের Best Contribution করতে পারি তবে একদিন আমরাই হয়তো গোটা বিশ্বের Education System এ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবো।
আমরা যদি টেকনোলজীর সর্বোত্তম ব্যবহারকে দেখি তবে আমরা দেখবো আজকে Hospital Solution দিচ্ছে রোবট। আজকে Artificial Inteligence দখল করে নিচ্ছে মানুষের জায়গা। মানুষ সারাক্ষণ ফেসবুকে বসে বসে সমালোচনা করছে, একে অপরের দোষারোপ করছে আর যারা বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী তারা বুঝতে পেরেছে যে এই মানুষগুলোকে নিয়ে আর সমাজ পরিবর্তন করা যাবে না। আর এই কারণেই Industrial Revolution 04 এ তারা নিয়ে এসেছে Technology, যেখানে মানুষকে Replace করবে রোবট এবং ইতঃমধ্যে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন ব্যবসায়িক খাতে। এদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ‘Justin Trudeau’ বলেছেন “করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার কিংবা মহামারি শেষ হয়ে গেলেও বিশ্ব পাল্টে যাবে। কোভিড-১৯ আমাদের সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করে দেবে। তাই সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।” সুতরাং এটা নিশ্চিত যে করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের জন্য অনেক বড় একটি পরিবর্তন অপেক্ষা করছে, বিশেষ করে চাকরীর বাজারে। কারণ বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ায় তখন চাকরী পাওয়াটা এতটা সহজ হবে না যতটা সহজ এখন। যারা নিজেদেরকে করোনা পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত করতে পারবে না, তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতির থেকেও অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে। সুতরাং এত কিছু দেখার পরেও কি আমাদের ঘুম ভাংবে না ? এখনও কি আমরা শুধু বসে থাকবো সমালোচনা করার জন্য ? এখনও কি আমরা আমাদের মাঝে সৃষ্টিকর্তা যে সুপ্ত প্রতিভা গুলো দিয়েছেন, সেগুলোকে খুঁজে বের করে বিকশিত করার চেষ্টা করবো না ? নাকি সারা জীবন শুধু Problem নিয়েই সমালোচনা করতে করতে একদিন এই পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিবো ?
অবশেষে, Problem আজীবন ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। Problem মানুষের জীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এখান থেকেই কিভাবে আমরা আমাদের Opportunity গুলো খুঁজে বের করে সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারি, Modern Technology গুলোর সাহায্যে আমরা আমাদেরকে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে পারি এবং সর্বোপরি আমাদের ভিতরের সুপ্ত প্রতিভা গুলোকে বিকশিত করে এসব কিছুর দ্বারা ভবিষ্যত পৃথিবীকে জয় করতে পারি, এটাই হবে আমাদের আগামী দিনের প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞা।
ড. মো. সবুর খান, চেয়ারম্যান, ড্যাফোডিল ফ্যামিলি