কলেরার বিরুদ্ধে লরাই করা এক বিশ্বনায়ক ডা. কাদরি
- বিল গেটস
“কোভিড-১৯’’ বর্তমান বিশ্বে যেন এক আতংকের নাম। যার ফলে মানুষ হয়ত ভুলেই গেছে বিশ্বে দীর্ঘকাল ধরে চলমান মহামারী ‘কলেরার’ কথা। গত ২০০ বছরে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন ছাড়াই গড়ে ওঠেছে অনেক অঞ্চল এবং সেই সব অঞ্চলে মারাত্মক ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। কলেরা মহামারী, বিশ্বের সপ্তম মহামারী, যা ১৯৬১ সালে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আফ্রিকা ও আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
একটি সাশ্রয়ী মূল্যের, কার্যকর এবং নিরাপদ কলেরা ভ্যাকসিন অবশ্য ভুলে যাওয়া এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গেম চেঞ্জার হিসাবে প্রমাণিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী কলেরা রোগের সংখ্যা ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও ২০১৯ সালে কলেরা রোগির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবুও মোট কলেরার মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৩৬ শতাংশ।
এই অগ্রগতিটি হলো বাংলাদেশের ইমিউনোলজিস্ট এবং সংক্রামক রোগ গবেষক ড. ফিরদৌসী কাদরির জন্যে। গত ২৫ বছর ধরে ড. কাদরী ও আরো কয়েক জন লোক কলেরা মহামারী থেকে পুরো সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের ভ্যাকসিনের পক্ষে ছিলেন।
উনিশ শতকের শেষের দিকে বেশ কয়েকটি কলেরা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয, সেগুলি ব্যয়বহুল এবং স্বল্প সরবরাহ ছিল। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে, প্রধান কলেরা ভ্যাকসিনটি প্রচুর পরিমাণে ধনী দেশগুলির ভ্রমণকারীরা ব্যবহার করতেন এবং রোগের ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র সম্প্রদায়ের সাধ্যের বাইরে ছিল এ টিকা।
২০১১ সালে ডা. কাদরি এবং তার দল ইন্টারন্যাশনাল ডায়রিয়া ডিজিজ অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি) এর মাধ্যমে একটি নতুন ও সাশ্রয়ী মূল্যের কলেরার ওরাল ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন, যা দরিদ্র নগরীর পরিবেশে কলেরা ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে সস্তা ও কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে এবং মানুষকে এই রোগের বিরুদ্ধে ৫০ শতাংশেরও বেশি সুরক্ষা প্রদান করতে পারে।
এটি ড. কাদরির বৃহত্তম পরীক্ষা ছিল যা বিশ্বের কলেরা মোকাবেলায় চিন্তাভাবনার জগতে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছিল। ডা. কাদরি বলেন, “আপনাদের যদি ভাল পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষা, ভাল ঘর থাকে তাহলে কোন মানুষের কলেরা থাকতে পারে না”। তবে যতক্ষণ না আপনারা এসব পাচ্ছেন ততক্ষণ আপনাদের দুর্দশাকে থামানো দরকার। আপনাদের এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, এবং ভ্যাকসিন হচ্ছে প্রথম স্তরের সমাধান।
তবে নিশ্চিতভাবে, দীর্ঘমেয়াদে কলেরা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিষ্কার খাবার পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উনবিংশ শতাব্দীর সময় ভারতে দেখা দেওয়া কলেরা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে অবশেষে পানি এবং নর্দমা ব্যবস্থাতে বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে আমেরিকা এবং ইউরোপ তা নিয়ন্ত্রণে আনে। স্বল্প আয়ের দেশগুলিতে এখনো পরিষ্কার পানি এবং স্যানিটেশনের ব্যবহার উন্নত করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে অবকাঠামোগত উন্নতি ব্যয়বহুল হতে পারে এবং নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সময় লাগতে পারে।
কলেরার প্রাদুর্ভাবগুলি রক্ষা করতে এবং প্রতিরোধ করতে ২০১৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কলেরার ভ্যাকসিন মজুত রেখেছিল। তখন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬০০ কোটিরও বেশি ডোজ পাঠানো হয়েছে।
পাশাপাশি দ্বিতীয় সাশ্রয়ী মূল্যের কলেরা ভ্যাকসিন ইউভিচলের সরবরাহ বাড়াতে সহায়তা করে। কলেরার “হটস্পটস” বা বেশি ঝুঁকিতে যে দেশগুলি আছে সেসব দেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই কলেরার ভ্যাকসিন ব্যবহার করতে গ্যাভি, ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স সহায়তা করছে।
এই প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি সামনের বছরগুলিতে আরও সমালোচিত হবে কারণ জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি কলেরা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি করে। মানবিক সংকটগুলিও এই রোগের একটি প্রজনন ক্ষেত্র। উদাহরণস্বরূপ, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে আধুনিক ইতিহাসের বৃহত্তম ও দ্রুততম ছড়িয়ে পড়া কলেরা মহামারী দেখা দিয়েছে, ২০১৬ সালে সে সময় কয়েক মিলিয়ন মানুষ সংক্রামিত হয়েছিল এবং ৩,০০০ এরও বেশি মানুষ তখন মারা যায়।
তবুও অগ্রগতি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে মায়ানমার থেকে আসা প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবিরে কলেরা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়ছিল। সরকারের সাথে কাজ করে ড. কাদরী একটি টিকা কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যা প্রাদুর্ভাব রোধে সহায়তা করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা পরিচালিত গ্লোবাল টাস্ক ফোর্স অন কলেরা নিয়ন্ত্রণ সংগঠনটি ৫০টিরও বেশি সংস্থার একটি অংশীদারিত্ব যা একসাথে কলেরার অবসানের জন্য কাজ করছে। সংগঠনটির লক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে কলেরার মৃত্যু ৯০% কমাতে এবং ২০ টি দেশে কলেরা নির্মূল করার লক্ষ্যে কাজ করেছে।
সূত্র: গেটস নোট
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আল মোমিন। শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ডিআইইউ।