কোথায় ফেলছি প্লাস্টিক পণ্য?
- ঋতুপর্ণা চাকী
আমারা প্রতিদিন নিত্য প্রযোজনীয় যেসব জিনিস ব্যবহার করি তার মধ্যে বেশির ভাগ পণ্যই যে প্লাস্টিকের তৈরি তৈরি এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একবারও কী ভেবে দেখেছেন আপনার ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যটি কোথায় যাচ্ছে আপনার ব্যবহার শেষে? এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করছে কিনা?
প্রতিটি জিনিসের ভালো দিক যেমন থাকে খারাপ দিকও তেমন থাকে। অতিরিক্ত প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস ব্যবহার ও এটি সঠিক জায়গায় না ফেলার কারণে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে যেকোনো শারীরিক সমস্যায় (যেমন ক্যান্সার, হরমোনাল ইমব্যালান্স,হার্টের সমস্যা)। এই বিষয়ে খুব কম মানুষই সচেতন।
ফলে নির্বিচারে মানুষ প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করছে এবং যেখানে সেখানে সেগুলো ফেলছে। তারপর এগুলোর স্থান হচ্ছে নদী নালা, খাল বিল ও সমুদ্রের জলে। এজন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর তিন ভাগ জল ও তাতে থাকা সামুদ্রিক প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদের। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রের পানিতে আর মাছ থাকবে না, থাকবে শুধু প্লাস্টিকের পণ্য।
জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শহরগুলেতে বর্জ্য উৎপাদনের মোট পরিমাণ প্রায় ২২.৪ মিলিয়ন টন অথবা মাথাপিছু বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ হিসেবে বলা যায় ১৫০ কেজি। এভাবে বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ হবে প্রতিদিন ৪৭০৬৪ টন, যা আমাদের পরিবেশ এবং পরিবেশে বাস করা অসংখ্য প্রাণীর জন্য হবে ভয়ানক ক্ষতিকর।
প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরির প্রধান কারণ
প্লাস্টিকের বর্জ্য কেন বেশী তৈরি হচ্ছে এই নিয়ে বাংলাদেশে পরিচালিত একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরির পিছনে প্রধানত দায়ী তরুণ সমাজ ও যুব জনগোষ্ঠী। কারণ তারা একবার ব্যবহৃত হয় এমন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্য সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করে। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্য বলতে বুঝায় যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে লাগে না এমন ধরণের পণ্য।
আর এমন ধরণের পণ্যের সবচেয়ে বেশী চাহিদা তরুণদের মধ্যে। ক্যারি ব্যাগ, পানির বোতল, জুস, চা, কফির একবার ব্যবহৃত গ্লাস, প্লেট এই ধরণের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করতে তরুণরাই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফলে মোট বর্জ্যর ৮৭ হাজার টন বর্জ্যই তৈরি হচ্ছে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের তথ্য থেকে আরো জানা যায়, কিছু প্লাস্টিক পণ্য রি-সাইকেল করারও কোনো সুযোগ নেই। এই পণ্যগুলো ২০ থেকে ৩০ বছরেও প্রকৃতিতে মিশবে না। অন্যদিকে পানির বোতলের মতো প্লাস্টিক পণ্য যদি যথা সময়ে রি-সাইকেল না করা হয় তবে তার অবস্থান পরিবেশের উপর থাকবে ৫০ বছরের মতো।
প্লাস্টিক পণ্য এত জনপ্রিয় কেন
প্লাস্টিক পণ্যর জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে এর সহজলভ্যতা। মানুষ সহজেই এখন যেকোনো জায়গা থেকে অনেক কম মূল্যে পছন্দমতো প্লাস্টিক পণ্য কিনে ঘরের যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারছে। প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যেও আনা হয়েছে নানা ধরণের ভ্যারিয়েশন, যা ক্রেতাদের এর প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করে। এ বিষয়ে একজন প্লাস্টিক পণ্য ক্রেতা ইতি চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, কম টাকায় নিজের পছন্দমতো জিনিস দিয়ে যেকোনো কাজকে আরো সহজতর করার জন্যই মূলত তিনি এই প্লাস্টিক পণ্য বেশী পছন্দ করেন এবং ক্রয় করেন।
কমাতে হবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার
পেঙ্গুইন বুক অব ফার্স্টের তথ্যমতে, ১৮৫০ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পার্কস সর্বপ্রথম রাবার থেকে প্লাস্টিক তৈরি করেন। কিন্তু বর্তমানে এই প্লাস্টিকের জন্য মানুষের জীবনযাপন হয়েছে দুর্বিসহ। মানুষের অতিরিক্ত প্লাস্টিকের পণ্য কেনার ফলে কাচ, চিনেমাটি এবং মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা দিন দিন কমতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অংকন পাল জানান, প্লাস্টিকের অব্যবহারযোগ্য পণ্য যা রি–সাইকেল করা যায় না বা অন্য কোনোভাবে অপসারণ করা হচ্ছে না এই ধরণের পণ্য পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এগুলো পরিবেশের ইকো সিষ্টেমকে নষ্ট করে দিচ্ছে। পরিবেশে বায়ুমন্ডল, মাটি, পানি, জীবমন্ডল এই চারটি উপাদানের সঠিক ভারসাম্যতার মাধ্যমেই একমাত্র পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার এনার্জি রিসাইক্লিংয়ে ন্যাচারাল ডিকম্পোজারদের কার্যক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। এজন্য এনার্জি রিসাইক্লিং সঠিকভাবে হয় না, যার ভয়াবহ দিক হিসেবে আমরা দেখতে পাই মাটির উর্বরতা কমে যায়, গাছের প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্টস ঘাটতি ঘটে। এভাবে প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার চলতে থাকলে বৈশ্বিক জলবায়ুকে আরো নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।
প্লস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধে করে পরিবেশকে রক্ষা করতে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান নির্বাহী শাহরিয়ার হোসেন বিবিসি বাংলাতে দেওয়া এক সাক্ষৎকারে বলেন, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার কমাতে আগে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের প্লাস্টিকের জিনিস কেনা ও সংগ্রহ দুইই বন্ধ করতে হবে এবং সরকারিভাবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার ও উৎপাদনে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করতে হবে।