প্লাস্টিকে বিপন্ন মানবসভ্যতা
- সারমিন আক্তার
বাজারের কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের খুটিনাটি ব্যবহার্য সামগ্রীর তালিকায় প্লাস্টিকের অবস্থান শীর্ষেই বলা চলে। সাশ্রয়ী, সহজে বহন সুবিধা এবং সহজলভ্যতার কারণে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই এটির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। প্লাস্টিক বলতে যে পলিথিন জাতীয় জিনিস তাই নয়, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের জিনিস যেমন কাপ, গ্লাস প্লেট—এসবের ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে আবাসিক হোটেল, সুপারশপ, কাঁচাবাজার, এয়ারলাইনস, দোকান, এমনকি বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ওয়ানটাইম প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের এই অতিমাত্রায় ব্যবহার হয়ে উঠছে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্লাস্টিকের এই অধিক ব্যবহার পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৩৮০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই একক ব্যবহার্য প্লাস্টিক। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদনের সাথে একইহারে এগুলো থেকে সৃষ্ট বর্জ্যের পরিমাণও বাড়ছে। পৃথিবীর সব প্লাস্টিক বর্জ্য যদি একত্র করা হয়, তবে তার উচ্চতা মাউন্ট এভারেস্টকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়। বলা যায় প্লাস্টিক বর্জ্য এখন সমগ্র বিশ্বের জন্য গলার কাঁটার মতো।
ওয়ানটাইম প্লাস্টিক কার্বনের পলিমার যৌগ পলিইথিলিন, পলিস্টাইরিন, পলিপ্রপিলিন ইত্যাদি দ্বারা উৎপন্ন করা হয়, যা নন-বায়োডিগ্রেডেবল বা অপচ্য জিনিস। অর্থাৎ এই প্লাস্টিক পদার্থগুলো বছরের পর বছর ধরে বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে থেকে যায়। অথচ এই ওয়ানটাইম জিনিসগুলো একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার পরে পরিবেশের তাপ এবং চাপে ছোট টুকরো বা মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে এগুলো ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে, পানিতে, বাতাসে যা অপচনশীল বর্জ্য হিসেবেই দীর্ঘদিন মাটিতে অবস্থান করার। ফলে মাটির জৈব উপাদানসমূহ ক্রমশ কমে আসছে। মাটি হয়ে পড়ছে দূষিত। এর প্রভাব এসে পড়ছে জীবজগৎ এবং পরিবেশের ওপর। আবার অতিক্ষুদ্র এই কণাগুলো পানিতে মিশে পৌঁছে যাচ্ছে জলজ ও স্থলজ প্রাণীদের পরিপাকতন্ত্রে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এগুলো আবার প্রবেশ করছে মানব-শরীরে। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র এসব কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বায়ু দূষণও হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশগত ভারসাম্য।
শুধু পরিবেশ বিপর্যয়ই নয়, প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে জনস্বাস্থ্যও। গবেষণা মতে, প্লাস্টিক কণা শরীরে প্রবেশ করলে অ্যালার্জি, ক্যান্সার, অ্যাজমা, অটিজম, পাচনতন্ত্রের সমস্যা, হরমোনজনিত সমস্যা, গর্ভপাত ইত্যাদি নানান রোগের সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে এসব প্লাস্টিকের বর্জ্য পোড়ালেও তা থেকে সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করে। যার ফলে ব্রংকিয়াল অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্লাস্টিকের মধ্যে আবার বিসফেনল নামের একপ্রকার টক্সিক উপাদান থাকে যা গরম খাবারের সঙ্গে মিশে নিয়মিত যদি শরীরে প্রবেশ করে, তবে মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোন কাজের স্বাভাবিকতা হারায়। এর ফলে শরীরে ক্লান্তি, মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
এছাড়া প্লাস্টিক নরম করতে ব্যবহৃত হয় থ্যালেট, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বছরে মানুষ ৯ আউন্স ওজনের ১ লাখ ২০ হাজার প্লাস্টিক কণা অনবরত খাচ্ছে। আর এসব প্লাস্টিক কণার উৎস হচ্ছে পানি, চিংড়ি, কাঁকড়া, কাছিমজাতীয় মাছ ও লবণ। আমাদের দেশে শহরাঞ্চলগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়তই অব্যবহৃত পলিথিন, স্ট্র, কটন বাড, বোতলের ক্যাপ, খাদ্যপণ্য মোড়ক, শ্যাম্পু, পেস্ট, সসজাতীয় পণ্যের মিনিপ্যাক ইত্যাদি যেখানে সেখানে ফেলে।
এনভায়রনমেন্ট সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)-এর একটি জরিপের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক থেকে ৮৬ হাজার ৭০৭ টন বর্জ্য সৃষ্ট হয়। যার ৬৩ শতাংশই আসে খাদ্যপণ্যের মোড়ক থেকে। শহরের ড্রেন নালা বা নর্দমার মাধ্যমে এগুলো খাল-বিল, নদী কিংবা সমুদ্রে পৌঁছে যায়। যা বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকে। এই বছরের পর বছর ধরে মুক্ত কিংবা বদ্ধ জলাশয়ে জমে থাকা এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রাণী-বৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের মৎস্য শিল্প এবং সুনীল অর্থনীতি। কারণ এই জলাশয়ে জমে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পানি দূষিত হয়। ক্রমাগত পানি দূষণের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটও বেড়েই চলেছে।
এমনকি প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো থেকে উৎপন্ন হয় গ্রিনহাউজ গ্যাস। এই গ্যাস প্রতিনিয়ত পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে এর বিকল্প ব্যবহার উপযোগী জিনিসের আবির্ভাব ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়ের এই হুমকি থেকে বাঁচার উপায় নেই।
এদিকে প্লাস্টিকের উপর নির্ভরশীলতার ফলে বিশ্বজুড়ে এর ব্যবহার বন্ধে যেন চরম অনীহা মানুষের। ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ার ফলে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে কারখানাগুলোরও আগ্রহ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০০২ সালের সংশোধিত)-এর মাধ্যমে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে এবং মানুষের চাহিদার তোপে তা কার্যকর হয়ে ওঠেনি। এর থেকে ক্রমেই মানবসভ্যতা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকে এগিয়ে চলছে। আর তাই এখনই এর ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ না নিলে মানবসভ্যতা পড়ে যাবে বিরাট ঝুঁকির মুখে। এক্ষেত্রে প্লাস্টিক উৎপাদন, পরিবহন, বিপণনে নিষেধাজ্ঞা প্রণয়ন করে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহী করে তোলার মাধ্যমে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকাংশে কমিয়ে আনা জরুরি।