ছয় দফা কেন আজও বহুল চর্চিত
- মেহেরাবুল হক রাফি
ষাটের দশকের মধ্যভাগ। জিন্নাহর জগত-কাঁপানো দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রায় দুই যুগ কেটে গিয়েছে। সেই জিন্নাহও গতপ্রায়, আর তার সাথে ধুঁকছে পোকায় কাটা পাকিস্তানও। মার্শাল আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি নামক সার্কাসের জালে বন্দী দুই প্রান্তেরই জনগণ। সামরিক শাসনের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে লাহোরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বিরোধীদলের সম্মেলন আহ্বান করা হলো। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে সম্মেলনে যোগ দিতে উড়াল দিলেন শেখ মুজিব। পথে সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন দীর্ঘদিনের বন্ধু ও দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সেই সভায় বিরোধী দলীয় সকল প্রতিনিধির সামনে উত্থাপিত হলো ছয় দফা, যার ভিত রচিত হয়েছিলে দুই যুগ আগে সেই লাহোরেই। শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিনতাবাদী এবং অখণ্ড পাকিস্তানের শত্রু আখ্যা দিয়ে সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলা হলো প্রস্তাবনার কপি। প্রতিবাদে সম্মেলন বয়কট করে পরের দিনই ফিরতি ফ্লাইট ধরলেন। বিমানবন্দরে নেমেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার সাগরে নিমজ্জিত হলেন শেখ মুজিব। দলের কার্যকরী সভাতে সর্বসম্মতিক্রমে ছয় দফা প্রস্তাব গৃহীত হলো। সিদ্ধান্ত হলো যে পুস্তিকা ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে পুরো দেশে ছয় দফার গুরুত্ব ও এর ব্যাখ্যা ছড়িয়ে দেয়া হবে। সেই লক্ষ্যে সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধান করে গঠিত হলো কমিটি। স্থানীয় অন্যান্য বিরোধী দলসমূহের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জনমানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে থাকে ছয় দফার দাবি-দাওয়াগুলো।
মূলত চল্লিশ দশকের বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব এবং ‘৫৪ এর নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার ওপর ভিত্তি করেই ছয় দফার রূপরেখা তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কি ছিল সেই ছয় দফায় যার জন্য আজও তা বহুল চর্চিত বিষয়?
ছয় দফার প্রথমেই উঠে আসে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত ফেডারেল রিপাবলিক অব পাকিস্তানের মূল দাবি, যেখানে প্রত্যেকটি স্টেট হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং তাদের নিজেদের স্বাধীন পার্লামেন্ট থাকবে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের অধিকার উল্লেখ করার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের বিষয়টিও সবার সামনে আসে।
দ্বিতীয় দফায় ১৯৪৬ এর মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব মোতাবেক দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র; এই দুইটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্য সব বিষয় ন্যস্ত থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে এমন দাবিই উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু।
প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ভিন্ন দুটি মুদ্রা ছাপানোর দাবি উঠে আসে; যা হবে সহজেই বিনিময়যোগ্য। এছাড়া দুই অঞ্চলের জন্য দুটি আলাদা রিজার্ভ ব্যাংক খোলার প্রস্তাবও করা হয়। যার ফলে দুই অঞ্চলের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মুদ্রা পাচার বন্ধ করা যায়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় সম্পদের সমবন্টনের ক্ষেত্রেও দাবিটি যথেষ্ট নায্য ছিল।
ছয় দফার চার নাম্বার পয়েন্টে ট্যাক্স এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং অর্থবছর শেষে সংগৃহীত ট্যাক্স এবং রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের ফান্ডে যাবে এমন একটি সাংবিধানিক আইন করার প্রস্তাবও রাখেন বঙ্গবন্ধু।
দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল গঠনের কথা বলা হয় ছয় দফা প্রস্তাবনার পঞ্চম প্যারায়। তার পাশাপাশি বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তির ব্যাপারে আঞ্চলিক সরকারকে ক্ষমতা দেওয়ার দাবিও উত্থাপন করা হয়।
ছয় দফার সর্বশেষ দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক প্যারামিলিটারি ফোর্স এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানানো হয়। কারণ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ততদিনে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চলে যায়, আর ভূতপূর্ব পাক-ভারত যুদ্ধ এই অঞ্চলের নিরাপত্তার মুখে এক বিরাট প্রশ্ন হিসেবে দেখা দেয়। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জন্য আলাদা আধাসামরিক বাহিনী প্রয়োজনীয়তায় পরিণত হয়।
ছয় দফা আন্দোলনের দাবানল পৌঁছে যায় বাংলার প্রতিটি গ্রাম থেকে শহরে। সাধারণ জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে নিজেদের বাঁচার দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধু সহ আরো অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার রাজবন্দী হিসেবে অন্তরীণ করে রাখে। শুরু হয় কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। ছয় দফা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে মার্শাল আইয়ুবের। ইয়াহিয়ার অধীনে সত্তরের নির্বাচনে ছয় দফার ম্যান্ডেটের ওপর ভিত্তি করেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। এরপর সেই ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে টালবাহানার সূত্র ধরেই শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। আর এত সব কারণেই আজও বাঙালীর মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হয় ঐতিহাসিক ছয় দফা।