লালসালুঃ অজ্ঞতাই কুসংস্কার
- সানজিদা আক্তার
নানা কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ আমাদের এই সমাজ। আর এই কুসংস্কার থেকেই শুরু হয় নানান ধরণের সামাজিক সমস্যা। কিছু ধর্মব্যবসায়ীরা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে প্রচার করে যাচ্ছে তাদের নিজদের বানানো কুসংকার। আমাদের দেশে চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই রয়েছে নানা কুসংস্কার। তারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে যেই সিনেমায়, সেটি “লালসালু”।
“লালসালু” সিনেমাটি তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত সামাজিক সমস্যামূলক একটি বংলা সিনেমা, যেখানে গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষদের অন্ধবিশ্বাস ও শিক্ষাহীন জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে। এই সিনামাটির গল্প নেওয়া হয়েছে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর বিখ্যাত উপন্যাস “লালসালু” থেকে। ১৯৪৮ সালে “লালসালু” উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তর্কসাপেক্ষে এটি বাঙালি মুসলিম রচিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এর জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, ফরাসি, উর্দু, জার্মান ও চেক ভাষাসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয় এই উপন্যাস। তবে সিনেমাটি তৈরি করা হয় ২০০১ সালে। এই সিনেমার দৈর্ঘ্য ১১০ মিনিট এবং সিনেমাটি দর্শকদের মাঝে এতই সাড়া ফেলে যে সিনেমাটি একাধিক জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
সিনেমাটি মূলত একটি মাজারকে কেন্দ্র করে যা তৈরি করা হয় একটি কবরের উপর লাল রঙের কাপড় বিছিয়ে দিয়ে। লালসালু অর্থই হচ্ছে লাল রঙের কাপড়। লাল কাপড়ের এমনিতে কোন বিশেষ অর্থ থাকলেও লালসালু সিনেমাটিতে লাল কাপড়ে আবদ্ধ একটি সাধারণ কবর এলাকাবাসীদের কাছে হয়ে উঠে অন্ধবিশ্বাসের অলৌকিক শক্তি।
লালসালু সিনেমাটির প্রধান চরিত্র হচ্ছে মজিদ ( রাইসুল ইসলাম আসাদ), যে কিনা একজন ধর্মব্যবসায়ী হিসেবে গ্রামে আসেন। মহব্বত নগর গ্রামের মানুষজনের মধ্যে কোন শিক্ষার আলো না থাকায় তারা নানা কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ আর এই সুযোগেই মজিদ অন্যে নাটকীয়ভাবে প্রবেশ করে মহব্বত নগর গ্রামে। ধর্মের প্রতি নিজে নিষ্ঠ এবং জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও গ্রামে ধর্মের নামে নানা প্রচলন শুরু করে। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে গ্রামবাসীর কাছে তার তৈরিকৃত মাজারকে অলৌকিক শক্তি হিসাবে উপস্থাপন করে এবং গ্রামবাসী সরলমনে মজিদের সব কথা বিশ্বাসী করে।
এভাবেই মাজারটিকে কেন্দ্র করে বিপুল ধন সম্পদ ও গ্রামে নিজস্ব শাসন গড়ে তোলেন মজিদ। তার ইচ্ছা ও এলাকাবাসীদের শক্ত সমর্থনের ফলে দুই যুবতীকে তিনি বিয়েও করে ফেলেন। প্রথম স্ত্রী রহিমা নিঃসন্তান, সহজ-সরল ও ভীতু প্রকৃতির মানুষ। সে গ্রামবাসীদের মতই তার স্বামীকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।
পুরো সিনেমা জুড়ে সে থাকলেও সিনেমাটিতে তার বিশেষ ভূমিকা হচ্ছে শেষ অংশে। অন্যদিকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী জামিলা চঞ্চল প্রকৃতির ও মজীদের কুসংস্কারের বিরোধী। জামিলা সিনেমাটির একটি প্রাণ চরিত্র। জামিলাই যেন সেখানকার কুসংস্কার মুক্তির সুবাতাস। তার কারণেই রহিমা স্বামী ভীরু থেকে হয়ে উঠে প্রতিবাদী নারী।
মজিদ একপর্যায়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজের কর্তা ব্যক্তি হয়ে গ্রামের মানুষের জীবনে উপদেশ নির্দেশ করেন এবং বিচার সালিশিতে সে নিজেই হয়ে ওঠেন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। এ ক্ষেত্রে গ্রমের মাতব্বর খালেক ব্যাপারী তার সহায়ক শক্তি। খালেক ব্যাপারী সিনেমাতে একজন পর নির্ভরশীল ব্যক্ত এবং সে মজিদকেই তার নিজের আর্দশ মনে করেন। তার নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী আমেনা সন্তান কামনায় প্রতিদ্বন্দ্বী পীরের প্রতি আস্থাশীল হলে সেও মজিদের শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পায় না। তার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে তাকে তালাক দিতে বাধ্য করে খালেক ব্যাপারীকে।
সেই গ্রামবাসীই তাহেরার বাবা মা’র মধ্যে পারিবারিক বিবাদেও মজিদ তার শাসন আরোপ করেন। নিজ মেয়ের গায়ে হাত তোলায় সে আদেশ করেন মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে এবং সেই সাথে তার লালসালু মাজারে পাঁচ পয়সা সিন্নি দিতে। অপমান সহ্য করতে না পেরে নিরুদ্দেশ হন তাহেরার বাবা। অপরদিকে, গ্রামকে কুসংস্কারমুক্ত ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে শিক্ষিত যুবক আক্কাস কাজ করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে মজিদ বাহিনী। সিনেমাটিতে আক্কাস খুবই অল্প সময় থাকলেও তার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার প্রথা। সিনেমাটি পুরোনো হলেও এর গল্পের সাথে এখনো মিল পাওয়া যায় আমাদের সমাজের। লালসালু সিনেমাটি ছোট ও সাধারণ চরিত্র নির্ভর সিনেমা হলেও এর গল্প ও উপস্থাপনা বেশ মজবুত, যা কিনা লেখক ও পরিচালক পাঠক এবং দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন অসাধারণভাবে।