দয়া করে তাঁকে নিয়ে কিছু লিখুন
- গাজী আনিস
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় বৃহত্তর উৎসব ‘বাহা পরব-১৪২৪’ নিয়ে ফিচার লিখতে দিনাজপুরের পার্বতীপুর যাচ্ছি। বন্ধু বান্ধব অনেকেই অনেক উৎসাহ দিলেন। শুভকামনা জানালেন। কিন্তু নওগাঁ জেলার একজন আকুল হয়ে আমার কাছে আবেদন করে বসলেন—দিনাজপুরের কাজ শেষ করে আমি যেন নওগাঁ যাই। সেখানেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছে। তাঁরা অনেক অবহেলিত। প্রতিভা থাকা স্বত্বেও উপস্থাপনের অভাবে কেউ কেউ স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। আমার পরিচিত একজন আছেন, যার নাম স্বপন সরদার। চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ-২০১৭র প্রতিযোগী ছিলেন। বিচারকদের বিচারে তিনবার ‘ভয়েস অব দ্যা ডে’ নির্বাচিত হয়, কিন্তু এসএমএস রাউন্ডে বাদ পড়ে যান। তিনি জাতিতে ওঁরাও, দয়াকরে তাঁকে নিয়ে কিছু লিখবেন।
দিনাজপুরের কাজ শেষ করে ১৭ মার্চ সকালে পার্বতীপুর থেকে ট্রেনযোগে সান্তাহার নামি। তারপর সিএনজি যোগে নওগাঁ যাই। গন্তব্য নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা গ্রামে স্বপন সরদারের বাড়ি। যোগাযোগ হয় নওগাঁয় ‘আড্ডায় কফি’ নামক রেস্টুরেন্টের উদ্যোক্তা ও সমাজ সেবক তসলিমা ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি স্বপন সরদারকে চিনেন এবং তার বর্তমানের অনুপ্রেরণা দানকারী। স্বপন সরদারের মোবাইল নম্বরে আমরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিপত্তি হল তার বাড়ি নেটওয়ার্কের বাইরে। কিঞ্চিৎ নেটওয়ার্কের দেখা মিললে তবেই তার সঙ্গে কথা হবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্বপন সরদারের এক প্রতিবেশির সঙ্গে যোগাযোগ হল। খোঁজ পেলাম স্বপন সরদার বাড়িতে আছেন। তাসলিমা ফেরদৌসকে সঙ্গে নিয়ে সিএনজি যোগে দ্রুত নিয়ামতপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দেড় ঘণ্টা পর পৌঁছালাম ভাবিচা গ্রামে। গ্রামের মধ্যে খেলাধুলায় ব্যস্ত কিশোরদের জিজ্ঞাসা করলাম স্বপন সরদারের বাড়ির ঠিকানা। অপরিচিত মানুষের উপস্থিতি দেখে তারা কৌতূহলের সঙ্গে দূরের একটি বাড়ি দেখিয়ে দিল। যেখানে গ্রামের সীমানা শেষ।
মাটির প্রাচীর বেষ্টিত একটি বাড়ি। নকশা সমৃদ্ধ সুন্দর দোতলা মাটির ঘর। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বাড়ির মতোই সুন্দর। দেখানো পথ ধরে আমরা এগোলাম। ইতিমধ্যে স্বপন সরদারের কানে আমাদের আগমনের খবর পৌঁছে গেছে। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। বসতে দিলেন। তারপর অনেক কথা জমে উঠলো।
স্বল্পভাষী স্বপন সরদারের জীবন কাহিনী অনেক সংগ্রামের। ১৯৯৭ সালে নওগাঁর নিয়ামতপুরের ভাবিচা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। জাতিতে ওঁরাও। অর্থাভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বৃত্তি পেয়ে টালিথাকুমি মিশন স্কুলে ভর্তি হন। ভালোভাবে লেখাপড়া চলছিল। সেখানে স্বপন সরদার সর্বপ্রথম আবু হেনা মোস্তফা কামাল নামের একজন গানের গুরুর দেখা পান। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পরবর্তীতে সেরা শিষ্যে পরিণত হন। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় তার গুরুর সহযোগিতায় নাম লেখান ‘মৌসুমি গান’ নামের একটি প্রতিযোগিতায়। উপজেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে সুনামের সঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
অষ্টম শ্রেণিতে এসে মিশন স্কুলের বৃত্তি বন্ধ হয়, তখন আবার স্বপনের পড়ালেখা থমকে যায়। এর মধ্যে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে পড়েন। খ্রিস্টান ধর্মের দীক্ষা নেন। ফলে সমাজ থেকে দুবছর তার পরিবারকে একঘরে (বিচ্ছিন্ন) করে রাখা হয়। তাঁদের সঙ্গে আশপাশের পরিবার মেশা বন্ধ করে দেয়।
তখন স্বপনের লেখাপড়া সচল করতে নিয়ামতপুর বালাহৈর সিডিএসপি মিশন স্কুল কর্তৃপক্ষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, এবং সেখান থেকে স্বপন এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় বিএ ক্লাসে ভর্তি হন।
লেখাপড়া জীবনের একপর্যায়ে স্বপনের গানের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। মঞ্চের বিভিন্ন শিল্পীদের কণ্ঠের সঙ্গে নিজের কণ্ঠের তুলনা করতে থাকেন। তারপর তিনি মনে ভরসা নিয়ে বিভিন্ন গানের মঞ্চে অডিশন দেবার জন্য মনস্থির করেন। কিন্তু গানের মঞ্চ পর্যন্ত যাবার গাড়ি ভাড়াটি তাঁর কাছে ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে নওগাঁ শহরে রিক্সার প্যাডেল ঘুরিয়ে টাকা জমান। জমানো টাকা নিয়ে সর্বপ্রথম ২০১৪ সালে চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠের অডিশন দিতে রাজশাহী যান এবং নির্বাচিত হন। ৬ হাজার জনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঢাকায় ক্যাম্প রাউন্ডে বাদ পড়েন। তিনি ২০১৪-১৫ সেশনে বিজয় টিভির গানের একটি প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। প্রতিযোগিতা চলাকালীন আনুষঙ্গিক খরচের জন্য রাতের বেলায় তিনি ঢাকায় রিক্সা চালাতেন।
গানের ভুবনে নিজের জ্বলজ্বলে স্থান না করতে পেরে স্বপন সরদার কখনও হতাশ হননি। গানের সঙ্গে লেগে থেকে আবারও চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ-২০১৭তে অডিশন দেন। নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় আসেন। চ্যানেল আই-তে দিনে শুটিং শেষ করে তিনি রাতে আবারও রিক্সার প্যাডেল ঘুরাতে থাকেন। এভাবে এসএমএস রাউন্ড পর্যন্ত আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ের দেখা পান নি। তাঁর পক্ষে যথেষ্ট এসএমএম না পড়ায় স্বপনের স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
স্বপন সরদারের গান শুনে সদ্যপ্রয়াত ফোক সম্রাট বারী সিদ্দিকী, শিল্পী সামিনা চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, মিতালী মুখার্জী, ফেরদৌস ওয়াহিদসহ অনেক শিল্পী প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ তাঁর নামের সঙ্গে বড় বড় বিশেষণ জুড়ে দিয়েছেন। প্রয়াত বারী সিদ্দিকী তাকে ‘গানের সর্দার’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
এখন ভাবিচা গ্রামের সবাই স্বপন সরদারকে ভালবাসেন। তাকে নিয়ে গর্ব করেন। তাদেরও আশা স্বপন সরদার একদিন নামীদামী শিল্পী হবেন। সমগ্র দেশবাসি তাকে চিনবে। ইতিমধ্যে নওগাঁ, রাজশাহী সহ আশেপাশের শহরগুলোতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মঞ্চে নিয়মিত গান পরিবেশনের জন্য তার ডাক আসে। কিন্তু গানের ব্যান্ড ও বাদ্যযন্ত্রের অভাবে তিনি থমকে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য সমাজের বিত্তবানদের মুখপানে চেয়ে আছেন।
স্বপনের গানের চর্চা শুরু হয় সেই বাড়ির কাছের একটা বড় দীঘির পাড়ে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেখানে তিনি গানের চর্চা করতেন। থালা-গামলা বাজিয়ে নিজে নিজে গানের সুর ঠিক করতেন। যদিও প্রথম দিকে এ বিষয়ে তার কোন ওস্তাদের সান্নিধ্যে যাবার সৌভাগ্য হয় নি। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। এখনও যন্ত্রাভাবে সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে।
বিদায়ের বেলায় স্বপন সরদারকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন, তাতে তার প্রতি ভক্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। গান নিয়ে তার স্বপ্ন কতটুকু জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘নিজেকে একজন ভালোমানের শিল্পী হিসেবে দেখতে চাই, সহযোগিতার অভাবে যারা গানের চর্চা করতে পারেন না, সেইসব বঞ্চিত মানুষদের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিবর্তনে অবদান রাখতে চাই’।