লাভজনক খাত কাঁকড়া ও কুঁচে চাষ
- রেজাউল করিম খোকন
বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলাদেশের কুঁচে মাছ। পিকেএসএফ অর্থাৎ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন প্রথমে সাতক্ষীরা অঞ্চলে কাঁকড়া চাষিদের পাশাপাশি খামারিদের কুঁচে মোটাতাজাকরণে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রদান করে খামারিদের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। খামারিরা তাদের নিত্যদিনের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এ কাজটি করে থাকেন। কুঁচে চাষের জন্য পিকেএসএফ থেকে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ, পুঁজি ও প্রযুক্তি দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ এবং খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলায় কুঁচে চাষ ব্যাপকভাবে শুরু করার পর সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলার ডোমার, কিশোরগঞ্জ এবং জলঢাকা উপজেলায় এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়েছে। নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চল অথবা কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের হাওরাঞ্চলে দেখা গেলেও উত্তরবঙ্গে কুঁচে খুব একটা বেশি দেখা যেত না। এখন ওই অঞ্চলে কুঁচে চাষে উৎসাহী হচ্ছেন অনেকে। সম্প্রসারিত হচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে গ্রাম থেকে গ্রামে, ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়নে। কেউ কেউ বিকল্প কিংবা আংশিকভাবে কর্মসংস্থান হিসেবে গ্রহণ করছেন কুঁচে চাষকে। মঙ্গা মোকাবিলায় ২০০৯ সালে অতি দরিদ্র এ পরিবারগুলো সম্পৃক্ত হয়েছিল পিকেএসএফের সংযোগ কর্মসূচির মাধ্যমে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, ও পুঁজি পেয়ে আজ তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সংসারে বহুমুখী আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে মর্যাদা বেড়েছে তাদের, বেড়েছে সক্ষমতা। টেকসই উন্নয়নের পথে অনেকদূর এগিয়েছেন তারা। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে এসে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে অনেকে। পরিবারে বহুমুখী আয়ের ব্যবস্থা করে আজ তারা মোটামুটি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে কুঁচের দেশি বাজারেও চাহিদা রয়েছে মোটামুুটি। তবে এর ব্যাপক চাহিদা রপ্তানি বাজারে। দারুণ সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কুঁচে। গড়ে প্রতি কেজি কুঁচে বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। যদিও কুঁচের এ মূল্য আকারের ওপর নির্ভরশীল। আকার যত বড় দামও তত বেশি। চীন, জাপান, হংকং, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, কোরিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের কুঁচে।
বাংলাদেশের মাটি, পানি ও আবহাওয়া কুঁচে চাষের জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় এর চাষের প্রতি আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কুঁচের প্রজনন এখনো প্রাকৃতিক উপায়ের ওপর নির্ভরশীল। কৃত্রিমভাবে প্রজনন ব্যবস্থা অর্থাৎ কুঁচে প্রজননের হ্যাচারির ব্যবস্থা করা হলে এর উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। সরকারি উদ্যোগে দেশে সফলভাবে কুঁচে কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় এর পোনা উত্পাদন শুরু হয়েছে আরো আগেই। নি:সন্দেহে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদেশে ২০০ ও ১৩০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। চীন, জাপান, তাইওয়ান কিংবা থাইল্যান্ডের মানুষ এর চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়াই বেশি পছন্দ করছে। বাঁধাধরা কোনো নীতিমালা না থাকায় ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ কাঁকড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিচ্ছে। শুধু রপ্তানির বাজারই নয়। বাংলাদেশ থেকে ছোটবড় কাঁকড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে অতি সহজেই সেগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সম্ভাবনাময় কাঁকড়া, কুঁচে রপ্তানি খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিদেশে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়ায় সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে এর চাষাবাদ চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ৫০ থেকে ১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদা ভালো। সেই চাহিদা সামনে রেখে বাংলাদেশের কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা, পাইকগাছা এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই কাঁকড়া কুঁচের খামার গড়ে তুলেছেন। সেখানে ৫০ থেকে ১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া হিমায়িত করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি করা হচ্ছে। কোনো কোনো চাষি এ ধরনের কাঁকড়া, কুঁচে উৎপাদন করে স্বর্ণপদকও লাভ করেছেন। চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ায় বেশি লাভ হচ্ছে বলে অনেক চাষি এদিকেই বেশি ঝুঁকছে। এখাতটি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খুব সহজেই দ্বিগুণ পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। সাধারণত পরিবেশ অধিদপ্তর কাঁকড়া চাষাবাদ ও রপ্তানির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সুন্দরবন এলাকার পাশাপাশি কাঁকড়া চাষ করলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বন বিভাগ। ফলে একই বিষয়ে দ্বৈত শাসন কায়েম হয়েছে। এর ফলে এ খাতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাই রপ্তানি নীতিমালাটি সংস্কার করে কাঁকড়ার চাষাবাদ ও রপ্তানির বিষয়টি একই ছাতার নিচে আনা দরকার।
কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি এমন একটি খাত যাতে সরকারের কোনো আর্থিক প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণ কিংবা অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে না। বরং উপকূলবর্তী এলাকার লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ কাঁকড়া চাষের সঙ্গে জড়িত হয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এটি এমন একটি পণ্য যার কোনো বাজার বাংলাদেশে নেই। সেই পণ্যটি বিদেশে রপ্তানি হয়ে উপার্জিত পুরো এক হাজার কোটি টাকাই দেশকে সমৃদ্ধ করছে।
লেখক :ব্যাংকার