মাছ চাষে দোয়েল কোয়েলের ৪৩ নারী স্বাবলম্বী

মাছ চাষে দোয়েল কোয়েলের ৪৩ নারী স্বাবলম্বী

  • শাহজাহান নবীন, ঝিনাইদহ

গ্রামের নারী। সবাই গৃহিণী। সংসারের ঘানি টানাই যাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। স্বামী সন্তান আর প্রাণের সংসার গুছিয়ে রাখা যে নারীর সহজাত দায়িত্ব। সে দায়িত্ব অবহেলা করার জো নেই নারীর। তবুও আজ নারী তার আসন করে নিয়েছে মহাশূণ্য থেকে অতল সমুদ্র তলে শামূকের দেশে। কোথায় নেই নারীর অবস্থান। তথ্য প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক যুগের এই ক্রমবর্ধমান উন্নতির জোঁয়ারে নারীর অবদান আজ সমানে সমান। নারীর এই উন্নতি শুধু শহরেই চোখে পড়ে তা কিন্তু নয়। অজপারাগাঁ থেকে এখন খবর আসে নারীর উদ্ভাবণের, খবর আসে নতুন নতুন সৃষ্টির। তেমনি এক খবরের বিষয়বস্তু ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বলাকান্দর গ্রামের ৪৩ জন নারী।

দোয়েল ও কোয়েল নামে দুটি সমবায় সমিতির মাধ্যমে তারা গড়ে চলেছেন নিজের পায়ে দাড়ানোর ভিত্তি। স্থানীয় শিরিষকাঠ খাল পরিস্কার করে শুরু করেছেন মাছ চাষ। আর এভাবেই ৪৩ নারী হয়ে উঠেছেন এলাকার রোল মডেল।

খোজ নিয়ে জানা যায়, বলাকান্দর গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শিরিষকাঠ খাল যা যুক্ত  হয়েছে চিত্রানদীর সাথে। সালেহা খাতুন নামে সমিতির এক নারী সদস্য জানান- খালের বিভিন্ন স্থানে দখলদাররা বাঁধ দিয়ে খালের পানির গতিপথকে বাধা গ্রস্থ করেছে। গ্রামের মধ্যে প্রায় ৫ বিঘা জায়গায় বছরে ৬ মাস পানি জমে থাকে। একদিন আমরা ৪৩ নারী মিটিং করি। কিভাবে নিজেরা খালে মাছ চাষ করা যায় তা নিয়ে কথা হয়। 

Jhenaidah Shiriskat Kal 22.5.16 (1)

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে শিরিষকাঠ খাল। খালটির সঙ্গে মল্লিকপুর, বলরামপুর, মহেশ্বরচাদা, কামালহাট, দৌলতপুর, হরিগোবিন্দপুর গ্রামের মাঝখানের বিস্তর মাঠ ও টায়াখালী বিলের সঙ্গে রয়েছে খালের সংযোগ। আর বলাকান্দর গ্রামের মধ্যে দিয়ে যে অংশ গিয়েছে তার নাম শিরিষকাঠ খাল। বলাকান্দর গ্রামে দোয়েল ও কোয়েল নামে ২টি নারী সমিতি আছে। একটির নাম দোয়েল মহিলা সমবায় সমিতি আরেকটি কোয়েল মহিলা সমবায় সমিতি। দুই সমিতিতে প্রায় ৪৩ জন সদস্য রয়েছে। তারা প্রতি সপ্তাহে চাঁদা জমা দিয়ে ফান্ড তৈরি করেন। তারা একদিন উদ্যোগ হন কিভাবে শিরিষকাঠ খালে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। উভয় সমিতির সদস্যরা একদিন মিটিংয়ে বসেন। তার পর কোন পুরুষের সহযোগিতা ছাড়াই তারা  সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালের দুপাড় পরিস্কার পরিচ্ছন করেন। এরপর তার প্রাথমিক অবস্থায় বেশ কিছু মাছের পোনা ছাড়েন পরীক্ষামুলক ভাবে। সেটা ২০১৩ সালের কথা। সে বার তারা যে টাকার মাছ ছেড়েছিল তার চেয়ে প্রায় ৩ গুন টাকার মাছ আহরণ করে। এরপর তারা আর থেমে থাকেনি। প্রতিবছর  গ্রামের ঐ খালে তারা রুই, কাতল, সিলভারকাপ,তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ শুরু করে। গত ২০১৫ প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। এবার ২০১৬ সালে লক্ষাধিক টাকার মাছ বিক্রি করেছেন।

দোয়ের মহিলা সমিতির সভানেত্রী হাজেরা খাতুন জানান, তারা প্রায় ৪ বছর ধরে এই খালে মাছ চাষ করছেন। আর তাদের এই মাছ চাষে সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করছেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড। তিনি জানান, মেয়েরা খালে নেমে মাছ চাষ করবে কিনা এটা নিয়ে প্রথম দিকে একটু সমস্যা হচ্ছিল। পরে যখন সকল সদস্যই চাষকৃত মাছ হাতে পেলো এবং বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় হলো তখন থেকে সবার মধ্যে উৎসাহ ও উদ্যোম আরো বেড়ে গেছে।

তিনি আরো জানান- নিজেরাই মাছের খাবার দেওয়া, দেখাশোনা এমনকি মাছ ধরার কাজটি নিজেরাই করেন। ইতিমধ্যে তাদের গড়ে তোলা দোয়েল ও কোয়েল সমবায় সমিতিতে মাছ বিক্রির কয়েক লক্ষ টাকা সঞ্চয় করেছেন।

কোয়েল মহিলা সমিতির সভানেত্রী আজিজা বেগম জানান, আমাদের খুব ভাল লাগে। গ্রামের মধ্যে প্রবাহিত পরিত্যক্ত খাল পরিস্কার করে মাছ চাষ করে কিছু পরিবার স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। উৎসাহ ও কৃতিত্বের ব্যাপার হলো যারা মাছ চাষ করছে তারা সকলেই নারী। বাড়ির অন্য কাজ শেষ করে এই খালে মাছের পেছনে সমিতির সদস্যরা সময় দিচ্ছে। তিনি জানান, শিরিষকাঠ খালে বছরে ৬ মাস পানি থাকে। যদি সরকার এটিকে  খনন করে সংস্কার করে ১২মাস পানি থাকার ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে তারা এখানে ১২মাস মাছ চাষ করতে পারতো।

কালীগঞ্জ উপজেলার হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর প্রোগ্রাম অফিসার শাহজাহান আলী বিপাশ বলেন-‘বলাকান্দর গ্রামের দুটি সমিতির নারীদের উদ্যোমে আমরা অভিভুত। পরিত্যক্ত খালে মাছ চাষের যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। এটি সত্যিই নজীর। আমরা আমাদের জায়গা থেকে তাদেরকে সহযোগীতা দেয়ার চেষ্টা করেছি।’

কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খন্দকার শরিফা আক্তার বলেন- ‘আমি নিজে সরেজমিনে ঐ গ্রামে মাঝে মাঝে যায়। খালে যে সব নারীরা মাছ চাষ করেন তাদের সার্বিক সহযোগিতা ও খোঁজখবর রাখি।’ তিনি আরো বলেন, এবার মৎস অধিদপ্তরের সহযোগিতায় শিরিষকাঠ খালে বেশ কিছু মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। যার মালিক পরবর্তীতে দুটি সমিতির মহিলা সদস্যরাই পেয়েছেন। মাছ আহরণের দিন আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম। গ্রামের নারীদের এমন সাহসী উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না।’ favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment