ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের শুরুটা যেভাবে

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের শুরুটা যেভাবে

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

পারিবারিক জীবনের নানা প্রতিকূলতা জয় করতে চেয়েছিলেন নীলিমা আক্তার। চাইছিলেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, এ জন্য ১৯৯৭ সালে জাতীয় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। পরে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান এবং এক লাখ টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অগ্রযাত্রা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। নানা ধরনের শো-পিস, ব্লক-বাটিক, এমবোস, জারদৌসি, চুমকি, মোম বাটিক, হাতের কাজ, কনফেকশনারি ইত্যাদির কাজ শুরু করেন এ প্রতিষ্ঠানে। ধীরে ধীরে অগ্রযাত্রার কর্মী বাড়তে থাকে। বর্তমানে তৈরি পোশাকসংশ্লিষ্ট নানা পণ্য রপ্তানিও করা হয় নীলিমা আক্তারের প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে শুরুটা তাঁর এমন ছিল না। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে প্রথম পুঁজির টাকা জোগাড় করতে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) ব্যবসায় লেগে থেকে নীলিমা আক্তার সফল হয়েছেন। তাঁর মতো অনেকেই এসএমই উদ্যোগ নিয়ে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি আরও অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করে দিয়েছেন।

কেন এসএমই
স্বল্প পুঁজি আর শ্রমের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি) উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এসএমই খাতকে। এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বললেন, ‘এসএমই আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। দেশি শিল্পের প্রায় ৯০ শতাংশই দখল করে আছে এই খাত। জাতীয় আয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ এই শিল্পের অবদান।’
চাকরির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হওয়ার ভালো একটি জায়গা হলো এসএমই খাত। আগ্রহ আর চেষ্টা যদি থাকে, তবে একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো কঠিন কোনো কাজ নয়।

অগ্রাধিকারভিত্তিক খাত
ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগ করে যাঁরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হতে চান, তাঁরা এসএমই দিয়ে শুরু করতে পারেন। অনেকে বুঝতে পারেন না কোন খাতে বিনিয়োগ করবেন, বিনিয়োগ লাভজনক হবে কি না ইত্যদি। তাঁরা বর্তমানে সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া খাতগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারেন। বর্তমানে ১১টি বিশেষ খাতকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অগ্রাধিকার পাওয়া এসএমই খাতগুলো হচ্ছে—কৃষিজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং), বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, ফ্যাশন, হস্তশিল্প, রূপচর্চা কেন্দ্র, পাটজাত পণ্য, কৃত্রিম গয়না ইত্যাদি। এর বাইরেও বেশ কিছু খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। যেমন—গবাদিপশু পালন, মৎস্য চাষ, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, হাঁস-মুরগির খামার, পরিবহন, অর্থকরী ফসল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সেবা খাত, পোশাকশিল্পসহ, ওষুধশিল্পসংশ্লিষ্ট, সিরামিক শিল্প ।

গোড়ার কাজ
এসএমই উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হতে হলে প্রথমে ঠিক করতে হবে কী ধরনের ব্যবসা করবেন—উৎপাদনমুখী না বাণিজ্যিক শিল্প। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ নিতে পারেন কোনো বিশেষজ্ঞের। ব্যবসার ধরন ঠিক করার পর আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি একাই ব্যবসা করবেন, না অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে অংশীদারির ব্যবসা করবেন। ব্যবসার জন্য প্রথমেই দরকার ট্রেড লাইসেন্স। এটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আইনি বৈধতা দেয়। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্সের জন্য নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে অফিস বা কারখানার নকশা, প্রতিবেশী দুজনের (কমপক্ষে) অনাপত্তিপত্র, ঘরভাড়া বা চুক্তিপত্রের রসিদসহ প্রয়োজনীয় দলিলপত্রসহ দাখিল করতে হবে। লিমিটেড কোম্পানি হলে ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল’ নিয়ে কোম্পানির নিবন্ধন সনদ জমা দিতে হবে। যদি পাবলিক বা প্রাইভেট কোম্পানি ভিত্তিতে ব্যবসা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে গিয়ে প্রথমে আপনার প্রতিষ্ঠানের নামে ছাড়পত্র নিতে হবে এবং ছাড়পত্রের ভিত্তিতে কোম্পানির নিবন্ধন করিয়ে নিতে হবে।

সনদ ও ছাড়পত্র
ব্যবসা পরিচালনা তথা পণ্য উৎপাদন ও সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের নিবন্ধন ও লাইসেন্স-সংক্রান্ত সনদ বা ছাড়পত্র নিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে ফায়ার লাইসেন্স, বয়লার লাইসেন্স ইত্যাদি। তবে সর্বক্ষেত্রেই এসব নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না। যেমন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া প্রয়োজনে আরও দু-একটি সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নিতে হতে পারে। তবে এসব নিতে গিয়ে ঘাবড়ে যাবেন না। নিয়ম মেনে আবেদন করুন। এর বাইরেও গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন সুবিধাসহ আপনার ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও ইউটিলিটি সেবার জন্য আবেদন করতে হবে। শিল্পকারখানা বা ব্যবসা পরিচালনার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

ভ্যাট ও ট্যাক্স
শিল্পকারখানা ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্যাক্স ও ভ্যাট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, আয়কর ফাঁকি দেওয়া আইনগতভাবে বেআইনি। যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে আয়কর প্রদানের জন্য সবার আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে টিন (ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর) সংগ্রহ করতে হবে। আর এ জন্য আপনাকে আবেদন করতে হবে। এ সময় দরখাস্তের সঙ্গে টিন প্রাপ্তির জন্য সরবরাহকৃত ফরম, কাজ শুরুর অনুমতিপত্র, কোম্পানির মেমোরেন্ডাম ও পরিচালন বিধি, ব্যাংক থেকে দেওয়া সচ্ছলতা সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, ওকালতনামা ইত্যাদির প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া ভ্যাটযোগ্য পণ্যের উদ্যোক্তাকে মূসক নিবন্ধন করতে হবে।

ব্যবসা কোথায় করবেন
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচনও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজধানী, বিভাগীয় বা জেলা সদর নাকি উপজেলা পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে সুবিধা হবে, সেটি ঠিক করে নিতে হবে আপনাকে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি কোথায় করবেন, তা ঠিক করতে আপনাকে ব্যবসার পারিপার্শ্বিক অন্যান্য উপাদান বিবেচনায় রাখতে হবে। যেকোনো স্থানেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। তবে শ্রমিকের সহজলভ্যতা রয়েছে এবং পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা ভালো, এ রকম স্থান বেছে নিলে আপনার প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। স্থান নির্বাচনের আগে পরিবহন খরচের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পর্যাপ্ত পানি ও বিদ্যুৎসুবিধা আছে কি না, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—এসব বিষয়ও স্থান নির্বাচনের সময় ভাবতে হবে। আর সবচেয়ে ভালো হয় নিজস্ব জায়গায় শিল্পোদ্যোগ নিতে পারলে। মনে রাখবেন, এসব সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে পারলে আপনি ব্যবসায়িকভাবে অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারবেন।

আর্থিক সহায়তা
যেকোনো স্বপ্নের বাস্তবায়নে দরকার অর্থ। আপনার যদি অর্থ না থাকে, তাহলে স্বপ্ন কোনো দিনই আলোর মুখ দেখবে না। বর্তমানে দেশে অনেক সরকারি ও বেসরকারি তালিকাভুক্ত ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বিনিয়োগ করছে। এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ ও অর্থসহায়তা দেওয়ার জন্য এসএমই ব্যাংকিং চালু করেছে। যেসব ব্যাংক এ খাতে বিনিয়োগ করছে—অগ্রণী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক। এ ছাড়া আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও মাইডাস ফাইন্যান্সিংসহ আরও কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসএমই খাতে বিনিয়োগ করছে।

সূত্র: প্রথম আলো

Sharing is caring!

Leave a Comment