রুপালি বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ

রুপালি বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

মাছের উৎপাদন-সাফল্য উৎসাহজনক হলেও উৎপাদন সম্ভাবনা রয়েছে এর চেয়ে বহুগুণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। মৎস্য উৎপাদন বাড়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে চতুর্থ এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে পঞ্চম স্থান লাভ করেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সঠিকভাবে চিংড়ি চাষ করা সম্ভব হলে- দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হেক্টর জমিতে থাইল্যান্ডের মতো অর্থনৈতিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আড়াই লাখ টন চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। শুধুমাত্র ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ বা ১১ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্যখাতে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে প্রায় ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে এই মৎস্য সেক্টরে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মৎস্যসম্পদের উৎপাদন ও প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণায় ১৬ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল রুই জাতীয় মাছের নতুন জাত এবং দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষ ব্যবস্থাপনা ও প্রজননবিষয়ক ৪৯টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।


ফিরে আসবে দেশীয় মাছ

আশির দশকে বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের পাঙাশ, রুই, কাতল, তেলাপিয়া চাষ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নত জাতের কই, শিং, মাগুর, শোল মাছের চাষ ব্যাপক হারে বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশীয় প্রজাতির মাছ শোল, মাগুর, শিং, কৈ, পুঁটি, সরপুঁটি, বাইন, টাকি, পাবদা, ফলি, মলা, গোলসা, টেংরা, ভেদা, বোয়াল, কালো বাউশ চাষ করা হচ্ছে। সারাবছরই এসব মাছ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। মৎস্য অধিদফতরও ৫৪ প্রজাতির মাছকে ঝুঁকিপূর্ণ, ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও ১২ প্রজাতির মাছকে মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ভাল খবর হলোÑ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরে আসছে শিং, বাটা, সরপুঁটি, ভাঙগনা, কালোবাউশ, গনিয়া, মহাশোল, পাবদা, মাগুর, চিতল ও ফলি বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ। মৎস্য অধিদফতরের পরিচালনায় বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বাড়াতে জলাশয় ভরাট ও দূষণ রোধের পাশাপাশি মাছের অতি আহরণ ও প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ বন্ধ করা, উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তি ও বিল নার্সারি কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষে বিপ্লব

১৯৮৬ সালে দাউদকান্দিতে প্রথম প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষ শুরু করেন ধানুয়াখোলা গ্রামের সুনীল কুমার রায়। প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষ প্রকল্পের ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, দাউদকান্দির সবচেয়ে বড় খামারগুলোর মধ্যে এশিয়া, প্রশান্ত, পানকৌড়ি ও খিরাই মৎস্য প্রকল্প ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। জানা গেছে, দাউদকান্দির বিভিন্ন গ্রামের ৬০ হাজার পরিবার চলছে মাছ চাষের আয় দিয়ে। এসব খামার থেকে বছরে লাভ হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মানুষের। দাউদকান্দি উপজেলার ২০ হাজার বিঘা জমির প্লাবন ভূমিতে উৎপাদিত হয় ৮২ হাজার ৭৬৭ টন মাছ।

মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ

২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশে প্রতিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। জাতিসংেঘর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এর প্রতিবেদনে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশ সরকার ভিশন ২০২১-এ দেশের মাছের উৎপাদন ৪৫.০ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লাখ টন বেশি। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ আহরণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২৫তম। বঙ্গোপসাগরে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও প্রায় ৫০০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ রয়েছে। এই মাসের অতি সামান্যই মাত্র আহরিত হয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার আইনগত অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।

মৎস্য রফতানি আয়ের নতুন খবর

সরকার মাছ রফতানি করে বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। বাংলাদেশের মাছের ফেলে দেয়া অংশ দিয়ে তৈরি স্যুপ বিক্রি হচ্ছে পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নামী-দামী রেস্তরাঁয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, অপ্রচলিত এই পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ বছরে আয় করছে শত কোটি টাকা। ইউরোপসহ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এসব অপ্রচলিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রফতানিকারকদের সূত্রে জানা যায়, কার্প জাতীয় মাছের আঁশ, চিংড়ির মাথা ও খোসা, কাঁকড়ার খোলস, মাছের বায়ু থলি, হাঙরের লেজ, ডানা, চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে- ইতালি, জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানি, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং সহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ থেকে চীন ও ভিয়েতনামে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ টন চিংড়ির খোসা, মাথা এবং প্রায় ৫০ টন কাঁকড়ার খোলস রফতানি হয়। মৎস্য উৎপাদন ও রফতানিতে নতুন আশাবাদে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

নজর দিন সরকার

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশে পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান প্রবচনটি ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো- নদী আছে পানি নাই, জলাশয় আছে মাছ নাই। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, জাতীয় উদ্যোগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এসব সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। হাওড়, বাঁওড়, বিল ও খালগুলোকে সুষ্ঠুভাবে তদারকি না করার কারণে এর প্রকৃত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এই সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করা যেতে পারে।favicon59

 লেখক: এস এম মুকুল

Sharing is caring!

Leave a Comment