সবজি চাষে সবজি বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ

সবজি চাষে সবজি বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

একসময় ভাল স্বাদের সবজির জন্য শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। গ্রীষ্মকাল ছিল সবজির আকালের সময়। এখন সারা বছরই প্রায় ২৫ জাতের সবজি পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে দেশে বর্তমানে এক কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। জমির পাশের উঁচু স্থান, ক্ষেতের আইল, বাড়ির উঠোন, ঘরের চালা, মাচা কিংবা এখন ভাসমান পদ্ধতিতে পানির ওপর এমন শহরের অট্টালিকায় ছাদে ছাদে সবজির চাষ হচ্ছে। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজিবিপ্লব ঘটে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। সবজি উৎপাদনের বার্ষিক বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়।


বাড়ছে উৎপাদন ও নতুন জাত

আশার খবর হলো, চার দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। দেশে বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে। সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন এবং আধুনিক প্রযুক্তি মূল ভূমিকা পালন করছে। গবেষণার মাধ্যমে উন্নত বীজ উদ্ভাবন ও কৃষিতে আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে দিন দিন সবজি উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইঅজও) এ পর্যন্ত ৫০ প্রকার সবজির আবিষ্কার করেছে। তথ্য অনুসন্ধানের জানা গেছে, সারাদেশের তুলনায় রংপুর অঞ্চলের সবজি উৎকৃষ্টমানের, সুস্বাদু। লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার পরিবার সবজি চাষ করে সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। প্রতি বছর এ উপজেলার ৩ হাজারেরও বেশি হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপন্ন হচ্ছে যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকারও বেশি। কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কের ২০ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ শসার ক্ষেত। এলাকার ১৪টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের মাঠে এখন শসার চাষ করে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব মতে, বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের ৮ জেলায় মৌসুমে ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়।

হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে রফতানির আয়

রফতানির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের সবজি রফতানি শুরু হলেও ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ববাজারে ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা। বর্তমানে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, মিরসরাই, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী, মাগুরা, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, কক্সবাজার, সিলেট ও গাজীপুরের সবজি রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। দেশের রফতানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়। এসব সবজির মধ্যে করলা, কাকরোল, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, ঢেঁড়স, লাউ, কচুরলতি, কচুরমুখী, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, কাঁঠাল, শসা, চিচিঙ্গা, লালশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, পটোল, ঝিঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও প্রক্রিয়াজাত সবজির মধ্যে রয়েছে- ডাটা, কচুরলতি, শিমের বিচি, কাঁচকলা, কলার ফুল, কচুশাক, কাঁঠাল বিচি প্রভৃতি। পণ্য পরিবহনে নানান অসুবিধা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাক-সবজি রফতানি করে ৬০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রফতানি হয়। যেসব দেশে বাংলা ভাষীরা বসবাস করছে সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজি রফতানির চাহিদা বেশি। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রবৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে আগামীতে সবজি রফতানি খাতে আয় ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

তারুণ্যের আত্মকর্মসংস্থান

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুব সমাজের মাঝে সবজি চাষ আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। খুলছে অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার। দেশে কোটি কৃষকের পাশাপাশি লাখো লাখো শিক্ষিত বেকার তরুণ উদ্যোক্তা শাক-সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় নিজেদের জমির পাশাপাশি বর্গা জমি নিয়ে সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এসব সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে অনেকেই। যার ফলে চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে এখন আমাদের গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত তরুণরা আর বিদেশ যেতে চায় না। তাই শিক্ষিত যুব সমাজ এখন বেশি মনোযোগী হচ্ছে কৃষিভিত্তিক এই লাভজনক প্রকল্পে। ফলে বাড়ছে গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা।

খুলে যাবে সম্ভাবনার দ্বার

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, একসময় বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলু আমদানি করতে হতো কিন্তু ২০১৩ সালে রাশিয়ায় প্রায় ২৫ হাজার টন আলু রফতানি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদনের পরিমাণ ৯৬ লাখ টন। দেশের মোট কৃষিজমির পরিমাণ কমলেও সবজি চাষের এলাকা বেড়েছে। কারণ জমির পাশের উঁচু স্থান, আল, বাড়ির উঠান, এমনকি টিনের চালায়ও এ দেশের কৃষকরা সবজির চাষ করছেন। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার স্ট্যাটেস্টিকাল ইয়ার বুক ২০১৩ অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদী জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশেÑ বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। দেশের চাষযোগ্য জমির মাত্র ১.৮ শতাংশ জমিতে শাকসবজি চাষ হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমানে স্বাভাবিক পর্যায়ে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, শুধুমাত্র মানসম্মত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ ভাগ সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। এজন্য গ্রামে গ্রামে কৃষকদের গ্রুপ তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উন্নতজাতের বীজ উৎপাদনে দেশের হাজার হাজার নার্সারিকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ইরি সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রতিটি পরিবার যদি প্রতিদিন এক কেজি করে সবজি উৎপাদন করে, তাহলে দেড় কোটি বসতভিটা থেকে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন সম্ভব।

প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ

রফতানি আয় বাড়াতে ইউরোপের ২৭টি দেশে শতভাগ স্যালমোনিলামুক্ত পান ও ব্যাকটেরিয়ামুক্ত শাকসবজি রফতানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বছরে সবজি রফতানি থেকে আয় হবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রয়োজন- বিদেশের বাজার ধরার ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হওয়া। সবজি সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্যাকেজিং পদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং নিরাপদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সবজি রফতানির খাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তাদানের পাশাপাশি সরকারী অংশগ্রহণও বাড়ানো। এ খাতের রফতানি আয় বাড়বে যদি- বাংলাদেশের বিমানগুলো তাদের মোট পণ্য পরিবহন ক্ষমতার ৩০ শতাংশ শাক-সবজি পরিবহন করে। স্থানীয়ভাবে পরিবহন সুবিধা বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব হয়। বিমানবন্দরের কাছাকাছি রফতানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা স্থাপন করা হয়।

সবজি বিপ্লব বাংলাদেশের নতুন আশা

আশা জাগানিয়া খবর হলো, এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গ্রীষ্মকালীন টমেটো, পেঁয়াজ, লাউ, করলাসহ বেশ কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে বছরে বীজের চাহিদা সাড়ে ৪ হাজার টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে ১৯৬০ সালে যেখানে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ, সেখানে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশে সবজির উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভোগের পরিমাণও। গত এক যুগে দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে ২০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) হিসেবে গত বছর দেশে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ হয়েছে ৭০ গ্রাম। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতানুযায়ী- একজন মানুষের দৈনিক ২২৫ গ্রাম সবজি খেতে হবে এই লক্ষ্যমাত্রা এখনো ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ।

লেখক: এস এম মুকুলfavicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment