দেশি ফলের  বিদেশী বাজার

দেশি ফলের বিদেশী বাজার

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

শাহীন রহমান ॥ রমজানে ফলমূলের জুরি নেই। প্রতি বছর রমজান এলেই বেড়ে যায় ফলমূলের চাহিদা। বিশেষ করে সারাদিন রোজাব্রত পালনের পর সচেতন রোজাদারদের ইফতারে অন্যতম অনুষঙ্গ থাকে বিভিন্ন ধরনের ফল। এতদিন এ তালিকায় বিদেশী ফলের কদরই বেশি ছিল। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। ইফতার আইটেমে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ভাজা পোড়া ও বিদেশী ফলের চেয়ে এবার রোজাদারদের কাছে দেশী মৌসুমী ফলের কদরই সবচেয়ে বেশি।

চন্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর রোজা ৯ দিন করে এগিয়ে আসছে। এভাবে রোজা এগিয়ে আসার কারণে এবারে মৌসুমী ফলের ভরা মৌসুমে রোজা শুরু হয়েছে। তাই রোজাদারদের কাছে বিদেশী ফলের চেয়ে মৌসুমী ফলের কদর অনেক বেশি। বাজার ঘুরে দেখা গেছে প্রায় ঢাকার প্রত্যেক অলিগলি ফুটপাথে এখন মৌসুমী ফলে সয়লাব। এবারে ফলে বিষাক্ত ফরমালিন, কেমিক্যাল মেশানোর অভিযোগ কম থাকায় রোজাদার আকৃষ্ট করছে বেশি। এছাড়া দামের সঙ্গে সঙ্গতিও রয়েছে। রোজায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ফল আমের দাম এখন সবার হাতের নাগালে। এবারের রমজানের এমন কোন রোজাদার খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের ইফতার মেন্যুতে আমসহ দেশী ফলের সমাহার নেই।

বাজারের মৌসুমী ফলে ব্যাপক যোগান থাকায় রোজাদারদের কাছে অন্যবারের তুলনায় এবারের রমজান মাস একটু ব্যতিক্রম। রমজানে ইফতারে সাধারণত তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সঙ্গে থাকে বিদেশী ফলমূলও। তবে এবারের ইফতারে ফলের তালিকায় এসেছে পরিবর্তন। বিদেশী ফল আপেল, খেজুর, মাল্টা, আঙ্গুর, কমলালেবু, ডালিম, পিচ ফল, চেরি ফল, এ্যাভোকেডো, ড্রাগন ফল, হানি-ডিউ, স্টার আপেল, ব্ল্যাকবেরি, নাশপাতিসহ বিদেশী ফলের পরিবর্তে ইফতারে থাকছে মৌসুমী ফল। সাধারণত রমজানে ঢাকার বড় বড় রেস্তরা সামনে কিংবা রাস্তার পাশে এমনকি অলি-গলিতেও বসে ইফতার সামগ্রীর দোকানে থাকে ভিড়। রমজানের প্রথম দিন থেকেই রোজাদার মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এসব দোকানের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু এবার রমজানে প্রথম দিন থেকে ঢাকার ছোট বড় ফলের দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন ক্রেতারা মৌসুমী ফল কিনতে। বিশেষ করে এবারের রমজানে মৌসুমী ফল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, লটকন, জামরুল মৌসুমী আনারস, পেয়ারা, তালের শাঁস ইত্যাদি ব্যাপক চাহিদ রয়েছে। যোগান রয়েছে প্রচুর।

রোজাদার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এবারের রোজার ইফতারি নিয়ে তারা বেশ খানিকটা সচেতন। ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। সে ক্ষেত্রে ইফতারির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে দেশী ফল। বিশেষ করে এবার ফলের মৌসুমে রোজা পড়ায় সেদিকেই ঝুঁকেছেন তারা। ভাজা-পোড়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ আইটেম বাদ দিয়ে মৌসুমী ফলকে গুরুত্ব দিচ্ছেন রোজাদার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন রমজানে সারাদিন রোজা রাখার পর ভাজা-পোড়া জাতীয় খাবারে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় ইফতারে ফল খাওয়াটাই ভাল। বিশেষ করে রোজার কারণে শরীরে যে মিনারেল ও ভিটামিনের ঘাটতি পড়ে তা ফলমূল খেলে পূরণ হয়। আর এটা পূরণ করতে অন্য বছর রোজাদাররা বেশিভাগ ঝুঁকেছে বিদেশী ফল আপেল আঙ্গুর কমলাসহ অন্যান্য ফলে দিকে। কিন্তু সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে এখন বাজারে ফরমালিন ব্যবহারের প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। এ কারণে স্বাস্থ্যকর দেশী ফলে দিকেই নজর এবার।

রাজধানীর ফলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে মৌসুমী ফল আমের দোকানগুলোতেই ক্রেতার ভিড় বেশি। বিক্রেতারা বলছেন, রোজা শুরুর পর থেকে আমের চাহিদা বেশ বেড়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে, রাস্তার পাশে, দোকানের সামনে অস্থায়ী আমের দোকান দিয়েছেন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। আম ছাড়াও মৌসুমী ফলের মধ্যে আরও জায়গা করে নিয়েছে আনারস, লিচু, কাঁঠাল, জাম, পেয়ারা, জামরুল, তরমুজ, বাঙ্গি, বেল, আমলকি, করমচা, আনারস, জাম্বুরা, কলা, কামরাঙা, আমড়া, ডেউয়া, তেঁতুল, পাকা পেঁপে, লটকন, সফেদা, পানিফল, গাব, তালশাঁসসহ আরও বাহারি রকমের ফল। রোজাদাররা বলছেন এবারের ইফতারের এসব ফলে জুড়ি মেলাভার।

রোজাদারদারা বলছেন বিদেশী ফলের চেয়ে দেশী ফল কেনায় লাভও অনেক বেশি। বিশেষ করে বিদেশী ফলের চেয়ে দেশী ফলে স্বাদ ও পুষ্টিগুণ যেমন বেশি। বেশি তেমনি দামেও সস্তা। এক কেজি আপেল আঙ্গুরের দাম যেখানে ২শ’ থেকে ৩শ; টাকার মধ্যে সেখানে সুমিষ্ট আমের কেজি ৪৫ টাকায় মিলছে। ফল বিক্রেতারা বলছেন রমজান ঘিরে এবার দেশি ফলের চাহিদা কয়েক গুণ বেশি। বিশেষ করে গত বছর ফরমালিনের কারণে কয়েক লাখ মেট্রিক টন ফল ধ্বংস করায় এবার অনেকটা সচেতন হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর অভিযোগ কম থাকায় ক্রেতার চাহিদার এখন অনেক বেড়ে গেছে ফলে দোকানগুলোতে।

ঢাকাজুড়েই এখন রসালো আমের সয়লাব। অলি গলি, ফুটপাথ কোথায় নেই দেশী আমের সমাহার। জানা গেছে এবার সঠিক সময় বাগান থেকে পেরে বাজারজাত করায় কেমিক্যাল মেশানোর প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে। এছাড়া উৎপাদন বেশি হওয়ায় দেশী ফলে দাম অনেকটা কম। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১.৪৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফলের চাষ হয়। বাৎসরিক ফলের উৎপাদন প্রায় ৩৪.৮৯ লাখ টন। বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৭০ ধরনের ফল উৎপাদন হয়। এর বেশিরভাগ হয় বর্তমান মৌসুমে। এছাড়া দেশী ফলে সব ধরনের পুষ্টি গুণাগুণ বিদ্যমান থাকে। পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবারের উৎস হলো এসব ফল। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অন্যতম উৎস। ফলের মধ্যে যেসব উপাদান পাওয়া যায় তা মানবদেহে স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায় বলে বিধায় ফলের মধ্যে থাকার পুষ্টির সবটুকুই শরীর গ্রহণ করতে পারে। এ কারণে ইফতার আইটেমে এবার রোজাদারদের বেশি পছন্দ দেশী ফল।

পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫ জুনের আগে বাগান থেকে আম পাড়তে নিষেধ করায় এবার আমে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর প্রবণত অনেকটাই কম। সঠিক সময় আম বাজারের আসার কারণে দামও অনেকটা কম। তিনি বলেন, ভাল জাতের আম ৫ জুনের আগে পাকা সম্ভব নয়। এ কারণে ৫ জুনের পর আম বাজারজাত করা হলে সে আম পাকাতে কোন প্রকার কেমিক্যালের প্রয়োজন হবে না। এ কারণে এবার আমের চাহিদা অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশি।

এবার সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষায়ও আম, লিচুসহ মৌসুমী বিভিন্ন ফলে ক্ষতিকর ফরমালিনের অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই এবং বিসিএসআইআর ঢাকাসহ বেশ ক’টি জেলায় ফল সংগ্রহ করে গত দেড় মাসে কয়েক দফায় বিভিন্ন ফল পরীক্ষা করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকার কঠোর অভিযান পরিচালনা করায় এবার এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে এবার অন্যবারের চেয়ে আমের দাম অনেক কম। এ কারণে রজমানে রোজাদার আমের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। ফুটপাথে প্রতিকেজি হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে ষাট থেকে সত্তর টাকায়। আর হকাররা কিনে আনেন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকার মধ্যে। পরিবহন খরচ বাবদ প্রতি কেজি আমে খরচ হয় পাঁচ টাকা। ল্যাংড়া, আম্রপালি, গোপালভোগসহ অন্যান্য জাতের আম বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকায়। কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে আকারভেদে ৮০ থেকে ৩শ’ টাকায়। মৌসুম শেষ হতে চললেও এখনো একশ’ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এবারের রমজানে মৌসুম ফলের চাহিদা বেড়ে গেছে অনেক।favicon59

 সূত্র: জনকন্ঠ

Sharing is caring!

Leave a Comment