নতুন দিগন্তে কৃষি

নতুন দিগন্তে কৃষি

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

একসময় আমাদের গ্রামের মানুষের আয়ের বড় অংশ আসত চাল উৎপাদন থেকে। এখন কিন্তু তা আর নেই। বর্তমানে দেশের মানুষের মোট আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ আসে ধান-চাল থেকে। ধান ছাড়াও গ্রামীণ অর্থনীতিতে আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসী-আয়, ক্ষুদ্র ব্যবসা, শিল্প শ্রম, ক্ষুদ্র উদ্যোগসহ আয়ের নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

চালের দাম বাড়লে তা দেশের দারিদ্র্য বাড়াবে—এটা তথ্যভিত্তিক কোনো চিন্তা নয়। এটা ঠিক যে ২০০৭-০৮ সালে দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া নিয়ে একটা বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছিল। সেটা যতটা না উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে, তার চেয়ে বেশি বাজারে চালের সংকট হবে এমন আতঙ্ক থেকে। দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা একই প্রবণতা লক্ষ করেছি। কোনো কারণে আবারও যদি সে ধরনের কোনো সংকট দেখা দেয়, তা মোকাবিলা করতে সরকারের খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরেই খাদ্য মজুতের পরিমাণ বেশ ভালোই থাকছে। ফলে চালের দাম নিয়ে এত দুশ্চিন্তা না করলেও চলে। চালের দাম বাড়তে থাকলে, তা কিছুটা বাড়তেই দেওয়া উচিত। এক হিসেবে আমরা দেখেছি, চালের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্য বাড়ে না, বরং কিছুটা কমে আসে।
খাদ্য মানেই চাল, এই ভাবনা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। দেশে এখন চাল ছাড়াও সবজি, মাছ, ভুট্টা, ডাল, আলুসহ নানা ধরনের ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। আমাদের দৈনিক খাবারের তালিকায় দেশে উৎপাদিত অনেক পুষ্টিকর খাবার ঠাঁই নিয়েছে। এটা প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কৃষকের সৃজনশীলতা ও বাজারের প্রতি সাড়া দেওয়ার কারণেই ঘটেছে।

দেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির যে বদলটা গত দুই যুগে ঘটে গেছে, তা কিন্তু সামগ্রিকভাবে কেউই মূল্যায়ন করেনি। বিশ্বব্যাংক একবার করেছিল, তাও বিচ্ছিন্নভাবে। বাংলাদেশে ষাটের দশকে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, উচ্চফলনশীল বীজ দিয়ে যে আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ শুরু হয়েছিল, যা সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত, তার সর্বোচ্চ চূড়ায় আমরা পৌঁছে গেছি। অনেক চেষ্টা করেও এই পদ্ধতি আর উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। কয়েক বছর ধরেই ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে অধোগতি আমরা দেখছি। ফলে আমাদের এখন সবুজ বিপ্লবের নতুন অধ্যায় শুরু করতে হবে। কৃষিতে আরও আধুনিক প্রযুক্তি আনতে হবে। সেটা কী হবে, কীভাবে হবে, তা নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে হবে। আগামী বছরটায় সেই চিন্তা ও পরিকল্পনার সূত্রপাত ঘটুক।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানি করেছে। এই ঘটনায় অনেকে খুশি হতে পারেন। কিন্তু আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চালের বাজারের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া সত্ত্বেও চালের দরের ওপরে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব পড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দর বাড়লে বাংলাদেশে কিছুটা হলেও বাড়ে, কমলে দেশেও কমে। আর যদি আমরা চাল রপ্তানি শুরু করি, তাহলে দেশের উৎপাদকেরা ওই আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারের একটি সম্পর্ক তৈরি করবে। থাইল্যান্ড যে কাজটি করে এখন বিপদে পড়েছে। সে দেশে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের ভুল নীতির কারণে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। কেননা, আমাদের এটা তো মেনে নিতে হবে, দেশে চালের দর আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক কম। যখন নিয়মিত রপ্তানি শুরু হবে, তখন আন্তর্জাতিক দরের কাছাকাছি দামে দেশে চাল বিক্রি শুরু হতে পারে। তখন চালের দাম আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষের ক্রয়সীমার অনেক বাইরে চলে যেতে পারে।

চাল আমদানির ক্ষেত্রেও অনেক সাবধানি হতে হবে। গত দুই বছরে আমরা দেখেছি, দেশে যথেষ্ট পরিমাণে চাল উৎপাদিত হওয়া সত্ত্বেও ভারত থেকে চাল আমদানি হয়েছে। কৃষক ধান কেটে যখন বাজারে আনছেন, তখন বাজারে ভারতীয় কম দামের চাল চলে এসেছে। ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাননি। সরকার অবশ্য দেরিতে হলেও আমদানি চালের ওপর কর আরোপ করেছে। তাতে আমদানি কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু ততক্ষণে বাজারে বিপুল পরিমাণে ভারতীয় চাল চলে এসেছে। কতটুকু আমদানি করতে দেওয়া হবে, কখন দেওয়া হবে—সেই সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বদলে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া উচিত। সরকারের একটি খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন বিভাগ রয়েছে। তারা ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ও পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু চাল আমদানি বিষয়েও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিচক্ষণভাবে সিদ্ধান্ত নিলে আমরা এই পরিস্থিতি এড়াতে পারতাম।
খাদ্য নিয়ে আমাদের নতুন দিগন্তের দিকে তাকাতে হবে। খাদ্য মানেই চাল, এই মজ্জাগত ধারণা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি বটে, তবে এখন খাদ্য মানেই পুষ্টি—এই চিন্তার দুয়ারে প্রবেশ করতে হবে। কৃষি ও খাদ্য বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে নজর দিতে হবে।
কে এ এস মুর্শিদ: মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান

সূত্র: প্রথম আলো favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment