আধুনিক পদ্ধতিতে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি

আধুনিক পদ্ধতিতে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

যে সব ফসলের কান্ড বা শিকড় শর্করা জমা হওয়ার কারণে মোটা হয়ে রূপান্তরিত বা পরিবর্তিত হয় সেগুলোকে কন্দাল ফসল বলে। বাংলাদেশে আলু, মিষ্টি আলু, কচু, গাছ আলু বা মেটে আলু, কাসাবা, শটি এসব কন্দাল ফসল হিসেবে চাষ করা হয়ে থাকে। বেশি শর্করা থাকার কারণে অনেক দেশেই এসব ফসল প্রধান খাদ্য বা প্রধান খাদ্যের পরিবর্তে বিকল্প খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কন্দাল ফসল অন্যান্য প্রধান খাদ্য শস্য থেকে বেশি শক্তি ও আমিষ তৈরি করে থাকে।
এ অধ্যায়ে আমরা জানব বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় কন্দাল ফসল আলু’র চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।

আলুর সাধারণ পরিচিতি:

০ ইংরেজি নাম: Potato
০ বৈজ্ঞানিক নাম: Solanum teberosum
০ পরিবার: Solanaceae
০ উৎপত্তি: অধিকাংশ বিজ্ঞানীগণ দক্ষিণ আমেরিকাকে আলুর উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচনা করেন।

পুষ্টি মূল্য:

আলুতে রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ। পুষ্টির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ভাত ও গমের সাথে আলুকে তুলনা করা যায়। এছাড়া খাদ্য হিসাবে আলু সহজেই হজম হয়।
এক নজরে দেখে নেই কি কি পুষ্টি উপাদান আলুতে রয়েছে:
(প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে)

উপযুক্ত জমি ও মাটি:
আলু চাষের জন্য বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ ধরনের মাটি সবচেয়ে উপযোগী। লবণাক্ত মাটিতে আলু ভাল হয় না।

জাত পরিচিতি:
১.  বারি আলু-১ (হীরা)  গাছের কান্ডের সংখ্যা ৪-৫ টি, রং সবুজ। আলু চেপ্টা গোলাকার। আকার মাঝারি থেকে বড়। ত্বক মসৃন এবং রং হালকা ঘিয়ে। শাঁশের রং হালকা, চোখ কিছুটা গভীর ও সংখ্যা বেশি। এ জাতের জীবনকাল ৭৫-৮৫ দিন। তবে বপনের ৬০-৬৫ দিন পর থেকেই আগাম আলু তোলা যায়। যশোর, বগুড়া, ও কুমিল্লা এলাকায় এজাতের চাষ বেশি হয়। জাতটি মড়ক ও ভাইরাস রোগ সহনশীল।  ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর

২.  বারি আলু-৪ (আইলসা)  গাছ কিছুটা ছড়ানো, কান্ডের সংখ্যা বেশি ও হালকা সবুজ। অংকুরোধগম  হতে ৩ মাসের বেশি সময় লাগে। এজন্য আলু সাধারণ তাপমাত্রায় ৫-৬ মাস পর্যন্ত ঘরে সংরক্ষণ করা যায়। জাতটি মড়ক ও ভাইরাস রোগ সহনশীল। বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে দেশী আলুর চাষ কমিয়ে এ জাত চাষ করা যায় এবং দেশী আলুর মতই তা অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

৩.  বারি আলু -৪ (ডায়মন্ট)  কান্ডের সংখ্যা কম কিšতু লম্বা ও শক্ত। পাতা একটু বড় ও গাঢ় সবুজ। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। আলু ডিম্বাকার, মাঝারি থেকে বড় আকৃতির। ত্বক মসৃন এবং রং হালকা হলুদের। শাঁস হালকা হলুদের ও চোখ  অগভীর। জাতটি সারা দেশেই চাষ করা যায়। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

৪.  বারি আলু-৮ (কার্ডিনাল)  গাছ শক্ত ও দ্রত বেড়ে উঠে। কান্ডের সংখ্যা কম ও লম্বা। পাতার প্রান্ত কিছুটা ঢেউ খেলানো। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। আলু ডিম্বাকার, মাঝারি আকার। ত্বক মসৃন ও লাল বর্ণের। শাঁস হলদে ও চোখ  অগভীর । জাতটি  মড়ক ও ভাইরাস রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

৫.  বারি আলু-১১ (চমক)  গাছ শক্ত ও দ্রত বেড়ে উঠে। কিছুটা খরা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। জীবনকাল ৮০-৮৫ দিন। অংকুর প্রথমে আঁটসাট থাকে ও পরে মোচাকার হয়। রং লাল বেগুনি, অগ্রভাগ সবুজ এবং রোমশ। আলু ডিম্বাকার, মাঝারি আকৃতির, ত্বক মসৃন, রং হালকা হলুদে ও চোখ  অগভীর। জাতটি সারা দেশেই চাষ করা যায়। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

৬.  বারি আলু-১২(হীরা)  কান্ডের সংখ্যা অনেক বেশি ও পাতা সবুজ। আলু ডিম্বাকার, মাঝারি  আকৃতির, ত্বক মসৃন ও হালকা  হলুদে ও শাঁসের রং ফ্যাকাশে সাদা ও চোখ কিছুটা গভীর। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। জাতটি মড়ক ও অন্যান্য ভাইরাস রোগ এবং কিছুটা তাপ সহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন। সারা দেশেই চাষাবাদ করা যায়। সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি। তাই হিমাগারবিহীন এলাকায় ৩-৪ মাস সংরক্ষণ করা যায়। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

৭.  বারি আল-১৩ (গ্রানোলা)  গাছ কিছুটা ছড়ানোর প্রকৃতির। কান্ডের সংখ্যা বেশি ও সবুজ। প্রথমে গাছের বৃদ্ধি ধীর গতিতে হয় তবে পরে সমস্ত জমি গাছে ডেকে যায়। খরা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। আলু গোল-ডিম্বাকার, মাঝারি  আকৃতির, ত্বক মসৃন হালকা তামাটে হলুদ, শাঁস ফ্যাকাশে ও চোখ  অগভীর। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। সারা দেশেই চাষ করা যায়। আলু ৪-৫ মাস ঘরে রাখা যায়। মড়ক ও অন্যান্য ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

৮.  বারি আলু-১৫ (বিনেলা)  গাছ ছড়ানো প্রকৃতির। কান্ডের সংখ্যা বেশি। কান্ড শক্ত ও হালকা সবুজ। খরা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। আলু ডিম্বাকার, মাঝারি  আকৃতির, ত্বক মসৃন ও হালকা হলুদে, শাঁসের রং হলুদ ও চোখ  অগভীর। কান্ড বেশি রোমশ। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। মড়ক ও অন্যান্য রোগ সহনশীল। সারা দেশেই চাষাবাদ করা যায়। উচ্চ ফলনশীল ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি ও আকর্ষণীয় রং বলে জাতটি চাষ বেশি হতে পারে। ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর

৯.  বারি টিপিএস-১  আলু গোল-ডিম্বাকার, মাঝারি আকৃতির, ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল ক্রীম বর্ণের। শাঁস ফ্যাকাশে হলদে, চোখ কিছুটা গভীর। জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন। এ জাত প্রকৃত আলু বীজ দিয়ে চাষ করা হয়। চাষিদের উচ্চ মূল্যের বীজ আলু কেনার দরকার হয় না। চাষির নিজের উৎপাদিত দ্বিতীয় বছরের কন্দ পরবর্র্তী বছরের বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
প্রকৃত আলু বীজ থেকে : ফলন ৪৫-৫০ টন/হেক্টর
কন্দ থেকে : ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর

১০.  বারি টিপিএস-২  আলু গোল-ডিম্বাকার, ত্বক মসৃণ ও হালকা হলুদে, শাঁস ফ্যাকাশে হলদে, চোখ কিছুটা গভীর। জাতটি  মড়ক ও অন্যান্য ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী। সারা দেশেই চাষাবাদ করা যায়। চাষির নিজের উৎপাদিত দ্বিতীয় বছরের কন্দ পরবর্র্তী বছরের বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।  জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন।
প্রকৃত আলু বীজ থেকে : ফলন ৪৫-৫০ টন/হেক্টর
কন্দ থেকে : ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর

১১.  বারি আলু-১৬ (আরিন্দা)  গাছ দ্রূত বর্ধনশীল, মাঝারি ধরনের, কান্ড শক্ত ও হালকা বেগুনী। পাতা একটু বড় ও হালকা সবুজ। আলু ডিম্বাকার ত্বক মসৃণ ও হালকা হলুদ বর্ণের। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। সারা দেশেই চাষবাদ করা যায়। মোজাইক ভাইরাস রোগ অনেকটা প্রতিরোধী। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

১২.  বারি আলু-১৭ (রাজা)  গাছ মাঝারি ধরনের, কান্ড শক্ত, খাড়া ও বেগুনী। পাতা মাঝারি ও গাঢ় সবুজ। আলু ডিম্বাকার ও মাঝারি  ধরনের, ত্বক মসৃণ ও উজ্জল  লাল বর্ণের। শাঁস হালকা হলুদ বর্ণের। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন।  জাতটি সারা দেশেই চাষ করা যায়। আলু আঠালো ও খেতে সুস্বাদু। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

১৩.  বারি আলু-১৮ (বারাকা)  গাছ খুব সবল ও মোটা। কান্ডের সংখ্যা কম কিšতু লম্বা। পাতা ঘন ও গাঢ় সবুজ। আলু ডিম্বাকার থেকে লম্বা ডিম্বাকার এবং মাঝারি থেকে বড় আকৃতির। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। জাতটি সারা দেশেই চাষ করা যায়। মোজাইক, পাতা মোড়ানো ভাইরাস রোগ, মড়ক রোগ প্রতিরোধক্ষম। ফলন ২০-২৫ টন/হেক্টর

১৪.  বারি আলু-১৯ (বিন্টজে)  গাছ দ্্রূত বর্ধনশীল, সবল এবং কান্ড শক্ত। পাতা বড় ও গাঢ় সবুজ। আলু ডিম্বাকার, মাঝারি আকৃতির, ত্বক মসৃণ ও হালকা হলুদে। ভাইরাস ’এ’ জনিত মোজাইক প্রতিরোধক্ষম। জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন। ফলন ২০-২৫ টন/হেক্টর

১৫  বারি আলু-২০ (জারলা)  কান্ড শক্ত ও মধ্যম আকৃতির। পাতা কিছুটা বড় ও হালকা সবুজ। আলু ডিম্বাকৃতি থেকে লম্বা ডিম্বাকৃতির। ত্বক মসৃণ ও হালকা হলুদে। জীবনকাল ৮৫-৯০ দিন। ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর

১৬  বারি আলু-২১ (প্রভেন্টো)  আলু সাদা, ডিম্বাকার থেকে লম্বাকৃতি, মাঝারি থেকে বড় আকৃতির, মসৃণ ত্বক, ত্বক ও শাঁস ফ্যাকাশে হলুদ, জীবনকাল ৯০ দিন, সাধারণত সংরক্ষণাগারে বীজের জন্য দীর্ঘদিন রাখা যায়। ফলন ২৫-৩৫ টন/হেক্টর

১৭  বারি আলু-২২ (সৈকত)  আলু লাল, গোলাকার থেকে গোলাকৃতি ডিম্বাকার মাঝারি আকৃতির, মসৃণ ত্বক, ত্বক ও শাঁস ফ্যাকাশে হলুদ, জীবনকাল ৯০ দিন। লবণাক্ত এলাকার জন্য উপযোগী জাত। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

১৮  বারি আলু-২৩ (আলট্রা)  আলু সাদা, ডিম্বাকার থেকে লম্বাটে, বড় আকৃতির, মসৃণ ত্বক, ত্বক ও শাঁস ফ্যাকাসে হলুদ, জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন, রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগী। ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর

১৯  বারি আলু-২৪ (ডুরা)  আলু লাল ডিম্বাকার থেকে লম্বাটে, বড় আকৃতির, মসৃণ ত্বক, ত্বক ও শাঁস ফ্যাকাসে হলুদ, জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন, রপ্তানির জন্য উপযোগী। ফলন ২৫-৩৫ টন/হেক্টর

২০  বারি আলু-২৫ (এসটেরিক্স)  আলু লাল, ডিম্বাকার থেকে লম্বাকৃতির, মাঝারি থেকে বড় আকৃতির, মসৃণ ত্বক, ত্বক ও শাঁস ফ্যাকাশে হলুদ, জীবনকাল ৯০ দিন, প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগী। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

২১  বারি আলু-২৬ (ফেলসিনা)  আলু সাদা, ডিম্বাকার থেকে লম্বাকৃতির, বড় আকৃতির, মসৃণ ত্বক, ত্বক ও শাঁস ফ্যাকাসে হলুদ, জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন, প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগী। ফলন ২৫-৩৫ টন/হেক্টর

২২  বারি আলু-২৭ (স্পিরিট)  আলু সাদা, ডিম্বাকার থেকে গোলাকার, উচ্চ ফলনশীল। জীবনকাল ৯০ দিন। সারা বাংলাদেশেই এর চাষ করা যায়। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর

২৩  বারি আলু-২৮ (লেডি রোসেটা)  লাল রংএর, ডিম্বাকার, উচ্চ ফলনশীল। জীবনকাল ৯০দিন। সারা দেশে চাষাবাদ করা যায়। জাতটি ২০০৮ সালে মুক্ত করা হয়। ফলন হেক্টর প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টন। নভেম্বর মাস বীজ রোপনের উপযুক্ত সময়।

২৪  বারি আলু-২৯ (কারেজ)  লাল রংএর, গোলাকার, উচ্চ ফলনশীল। জীবনকাল ৯০দিন। সারা দেশে চাষাবাদ করা যায়। জাতটি ২০০৮ সালে মুক্ত করা হয়। ফলন হেক্টর প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টন। নভেম্বর মাস বীজ রোপনের উপযুক্ত সময়।

২৫  বারি আলু-৩০ (মেরিডিয়ান)  সাদা রঙ, মাঝারি আকারের ডিম্বাকার আলু। সারা বাংলাদেশেই এর চাষ করা যায়। জীবনকাল ৯০ দিন। ফলন ৩০-৩২ টন/হেক্টর

উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার:
কার্ডিনাল ও ডায়মন্ট জাতের আলুই বাংলাদেশে বেশি চাষ করা হয়। তবে বর্তমানে গ্রানোলা জাতের আবাদও দিন দিন বাড়ছে। পেট্রোনিজ, মুলটা ও হীরা আগাম জাতের আলু। হীরা জাতটি খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে, ৮০ দিনের মধ্যেই আলু তোলা যায়। তবে ৬০ দিনেও শতকরা ৬০-৭০ ভাগ ফলন পাওয়া যায়। গ্রানোলা, আল্ট্রা ও ডুরা জাতের আলু বিদেশে রপ্তানীযোগ্য। নতুন জাতের আলুর মধ্যে প্রভেন্টো, ফেলসিনা ও এ্যাসটেরিক্স জাতের আলু দিয়ে চিপস বা শিল্পে অন্যান্য কাচামাল তৈরি কার যায়। রাজা জাতটি দেশী জাতের বিকল্প উচ্চ ফলনশীল জাত।

এ সমস্ত উচ্চ ফলনশীল জাত ছাড়াও দেশী বিভিন্ন জাত যেমন- লাল পাকড়ি, লাল শীল, চলি-শা, শিল বিলাতী, দোহাজারী এবং বেসরকারি কোম্পানীর মাধ্যমে আমদানিকৃত বিভিন্ন হাইব্রিড আলু জাতেরও চাষ হয়ে থাকে।

বীজ শোধন ও বীজ প্রস্তুতি:
কোল্ড স্টোরেজে বা হিমাগারে রাখার আগে বীজ শোধন না হয়ে থাকলে অংকুর গজানোর পূর্বে বীজ আলু দাঁদ বা স্কেব এবং ব্ল্যাক স্কার্ফ রোগ প্রতিরোধের জন্য ৩% বরিক এসিড দিয়ে শোধন করে নিতে হয় (১ লিটার পানি + ৩০ গ্রাম হারে বরিক এসিড মিশিয়ে বীজ আলু ১৫-২০ মিনিট চুবিয়ে পরে ছায়ায় শুকাতে হবে)। বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আস্ত আলু বপন করা ভাল। আলু কেটে লাগালে প্রতিটি কাটা অংশে অন্তত ২টি চোখ অবশ্যই রাখতে হবে। আলু কাটার সময় বার বার সাবান পানি দিয়ে ছুরি বা বটি পরিষ্কার উচিৎ যাতে রোগ জীবাণু এক বীজ থেকে অন্য বীজে না ছড়ায়। বীজ আলু আড়াআড়িভাবে না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটতে হবে। বীজ আলু কাটার পর ২-৩ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে ভিজা চট দিয়ে ঢেকে রাখলে কাটা অংশে আস্তরণ পড়বে ফলে মাটি বাহিত রোগ-জীবাণু সহজে বীজে প্রবেশ করতে পারবে না। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ১.৫ থেকে ২ টন বীজ আলুর প্রয়োজন (একরে ৬০০-৮০০ কেজি)।

আচ্ছাদন পদ্ধতিঃ এক্ষেত্রে বীজ লাগিয়ে গাছ গজানোর পূর্বে বা পরে শুকানো কচুরীপানা অথবা খড়-বিচালী দ্বারা মাটি ঢেকে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত সেচ দেয়া হয় না এবং রোপণের পূর্বে সবটুকু সার প্রয়োগ করা হয়।
ভেলী পদ্ধতিঃ এক্ষেত্রে বীজ লাইনে লাগানো হয় এবং লাগানোর পর এক বা একাধিক বার লাইন বরাবর আইল অর্থাৎ ভেলী তুলে দেয়া হয়। সার লাইনে প্রয়োগ করা হয়।

বীজ রোপণঃ
পুরো নভেম্বর মাসব্যাপী আলু লাগানো যায়। তবে নভেম্বর মাসের ১৫-২০ তারিখ (অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ) উপযুক্ত সময়। বীজ আলুর জন্য নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই (অগ্রহায়ণ মাসের ১ তারিখের মধ্যে) বীজ রোপণ করতে হয়।
৫-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এরপর ভালভাবে আগাছা বাছাই করে নিতে হবে। লাইন করে আলু লাগালে ফলন ভাল পাওয়া যায়। এ জন্য এক লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব থাকবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা প্রায় দেড় ফুট। প্রতিটি লাইনে ১৫ সেন্টিমিটার বা প্রায় ৬ ইঞ্চি দূরে দূরে আলু লাগাতে হয়। মাটি বেশি ভেজা থাকলে আলু লাগানো উচিৎ না। তবে মাটি বেশি শুকনা হলে, জমিতে ভালভাবে সেচ দিয়ে ‘জো’ আসলে আলু লাগাতে হবে।

যে সব জমিতে বর্ষার পানি দেরিতে সরে সে সব জমিতে পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে নরম মাটির ওপর সার ছিটিয়ে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার (প্রায় দুই ফুট) দূরে দূরে লাইন করে, প্রতি লাইনে ২৫ সেন্টিমিটার (প্রায় ১০ ইঞ্চি) পর পর আস্ত আলু বসিয়ে খড় অথবা কচুরীপানা দিয়ে ভালভাবে ঢেকে দিলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে। এ পদ্ধতিকে বিনা চাষে আলু উৎপাদন বলে।

সার ব্যবস্থাপনা:
সারের নাম                       সারের পরিমাণ (গ্রাম/শতক) 
ইউরিয়া                                   ১০০০
টিএসপি                                   ৫৩০
এমওপি                                    ৯৫০
জিপসাম                                    ৪৫০
জিংক সালফেট                             ৩৫
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (অম্লীয় বেলে মাটির জন্য)  ৩৫০
বোরণ (বেলে মাটির জন্য)                 ৩৫
গোবর                                      ৪০ কেজি

গোবর, অর্ধেক ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, ও জিংক সালফেট (দরকার হলে) রোপণের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ পর অর্থাৎ দ্বিতীয় বার মাটি তোলার সময় প্রয়োগ করতে হবে। অম্লীয় বেলে মাটির জন্য ৩৫০ গ্রাম/শতক ম্যাগনেশিয়াম সালফেট এবং বেলে মাটির জন্য বোরণ প্রতি শতকে ৩৫ গ্রাম প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা:
বীজ আলু বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে (স্টোলন বের হওয়ার সময়) প্রথম দিতে হবে, দ্বিতীয় সেচ বীজ আলু বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে (শুটি বের হওয়া পর্যন্ত) এবং তৃতীয় সেচ আলু বীজ বপনের ৬০- ৬৫ দিনের মধ্যে (শুটির বৃদ্ধি পায়) দিতে হবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে বেশি ফলন পেতে হলে ৮-১০ দিন পর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রয়োজন ।

পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা:
পোকার নাম: আলুর কাটুই পোকা
কাটুই পোকা গাছের গোড়া কেটে ক্ষতি করে। ডিম ফুটে বের হয়ে কীড়া পাতার বাইরের (ত্বক) অংশ খেয়ে থাকে।

পোকা চেনার উপায়: কাটুই পোকা বেশ শক্তিশালী, ৪০-৫০ মিমি লম্বা। পোকার উপর পিঠ কালচে বাদামী বর্ণের, পার্শ্বদেশ কালো রেখাযুক্ত এবং বর্ণ ধূসর সবুজ। শরীর নরম ও তৈলাক্ত ।

ক্ষতির নমুনা: কাটুই পোকা চারা গাছ কেটে দেয় এবং আলুতে ছিদ্র করে আলো ফসলের ক্ষতি করে থাকে। পোকা দিনের বেলায় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে। আলুর কাটা গাছ অনেক সময় কাটা গোড়ার পাশেই পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা: কাটুই পোকার উপদ্রব খুব বেশী না হলে কাটা আলু গাছ দেখে তার কাছাকাছি মাটি উল্টে পাল্টে পোকা খুঁজে সংগ্রহ করে মেরে ফেলা উচিত। আলু ক্ষেতে সেচ দেওয়ার সময় পানির সাথে ২০ মি.লি/শতক হারে কেরোসিন তেল মিশিয়ে দিয়ে মাটিতে লুকিয়ে থাকা কাটুই পোকা মেরে ফেলা যায়। এ ছাড়া পাখিকে উৎসাহিত করার জন্য ক্ষেতের মাঝে বাঁশের কাঠি বা ডাল পালা পুঁতে রাখা দরকার। কাটুই পোকার উপদ্রব খুব বেশি হলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। প্রতি লিটার পানির সাথে ৫ মি.লি ক্লোরোপাইরিফস (ডারসবান) ২০ ইসি হারে মিশিয়ে গাছের গোড়া ও মাটিতে স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে হবে। আলু লাগানোর ৩০-৪০ পর স্প্রে করতে হবে।

পোকার নাম: আলুর জাব পোকা
জাবপোকার প্রজাতির মধ্যে মাইজাস পারসিকি নামক প্রজাতি ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে বীজের মান নষ্ট করে।

ক্ষতির নমুনা: এ প্রজাতি আলুর পাতা মোড়ানো ভাইরাস ‘এ’ ও ভাইরাস ‘ওয়াই’ রোগ বিস্তারের সাহায্য করে আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।

অনুকূল পরিবেশ: ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি হতে এ পোকার সংখ্যা বাড়তে থাকে।

ব্যবস্থাপনা: ডাইম্যাক্রন/বেনিক্রন ১০০ এস সি ডবি-উ ১০ মি.লি. ওষুধ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে ভালভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

পোকার নাম: আলুর সুতলী পোকা

আলুর সুতলী পোকার মথ আকারে ছোট, ঝালরযুক্ত, সরু ডানা বিশিষ্ট বাদামি হয়।

পোকা চেনার উপায়: পূর্ণাঙ্গ কীড়া সাদাটে বা হাল্কা গোলাপী বর্ণের এবং ১৫-২০ মি.মি লম্বা হয়ে থাকে।
ক্ষতির নমুনা: কীড়া আলুর মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গ করে আলুর ক্ষতি করে থাকে।
অনুকূল পরিবেশ: বাংলাদেশে বসত বাড়িতে সংরক্ষিত আলু এ পোকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ব্যবস্থাপনা: বাড়িতে সংরক্ষিত আলু শুকনা বালি, ছাই, তুষ, অথবা কাঠের গুড়ার একটি পাতলা স্তর (আলুর উপরে ০.৫ সেমি) দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আলু সংরক্ষণ করার আগে সুতলী পোকা আক্রান্ত আলু বেছে ফেলে দিতে হবে।

পোকার নাম: উড়চুঙ্গা
এটি আলু ফসলের জন্য একটি ক্ষতিকারক পোকা ।

ক্ষতির নমুনা: এরা রাত্রে গর্ত থেকে বের হয়ে আলু গাছের শিকড়, আলু ও কান্ড খেয়ে ফেলে।

ব্যবস্থাপনা: বিষটোপ ব্যবহার করতে হবে। গর্ত থেকে পোকা বের করে মেরে ফেলতে হবে।

রোগ ব্যবস্থাপনা:
রোগের নাম: আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা
ফাইটপথোরা ইনফেসটেনস নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে।

ক্ষতির নমুনা : প্রথমে পাতা, ডগা, ও কান্ডে কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে জমির অধিকাংশ ফসল আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভোরের দিকে আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা পাউডারের মত ছত্রাক চোখে পড়ে। আক্রান্ত ক্ষেতে পোড়া-পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় এবং মনে হয় যেন জমির ফসল পুড়ে গেছে ।
ব্যবস্থাপনা: রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত জমিতে সেচ যথা সম্ভব বন্ধ করে দিতে হবে। রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রিডোমিল (০.২%), ডাইথেন এম-৪৫ (০.২%) ইত্যাদি অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।

রোগের নাম: আগাম ধ্বসা বা পাতার দাগ
অলটারনারিয়া সোলানাই নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে।
ক্ষতির নমুনা : নিচের পাতায় ছোট ছোট বাদামি রঙের অল্প বসে যাওয়া কৌনিক দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশে সামান্য বাদামি এলাকার সাথে পর্যায়ক্রমে কালচে রংয়ের চক্রাকার দাগ পড়ে। পাতার বোঁটা ও কান্ডের দাগ অপেক্ষাকৃত লম্বা ধরনের হয়। গাছ হলদে হওয়া, পাতা ঝরে পড়া এবং অকালে গাছ মরে যাওয়া এ রোগের লক্ষণীয় উপসর্গ। আক্রান্ত টিউবারের গায়ে গাঢ় বাদামি থেকে কালচে বসে যাওয়া দাগ পড়ে।

ব্যবস্থাপনা: সুষম সার প্রয়োগ এবং সময়মত সেচ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে। ডাইথেন এম-৪৫ ০.২% হারে প্রয়োগ করা যায়। আগাম জাতের আলু চাষ করতে হবে।

রোগের নাম: আলুর স্টেম ক্যাঙ্কার স্কার্ফ রোগ
রাইজকটোনিয়া সোলানাই নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
ক্ষতির নমুনা: গজানো অঙ্কুরের মাথায় এবং স্টোলনে আক্রমনে দাগ দেখা যায়। বড় গাছের গোড়ার দিকে লম্বা লালচে বর্ণের দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। কান্ডের সাথে ছোট ছোট টিউবার দেখা যায়। আক্রান্ত টিউবারের গায়ে শক্ত কালচে এবং সুপ্ত রোগ জীবাণুর গুটি দেখা যায়।

ব্যবস্থাপনা: টেরক্লোর (চঈঘই) হেক্টর প্রতি ১৫ কেজি মাত্রায় বীজ লাগানোর পূর্বে বীজ নালায় প্রয়োগ করতে হবে। ৩% বরিক এসিড দ্বারা বীজ শোধন বা ¯েপ্র যন্ত্রের সাহায্য প্রয়োগ করলে ও ভাল ফল পাওয়া যায়। বীজ আলু মাটির বেশী গভীরে রোপন পরিহার করতে হবে। ভালভাবে অঙ্কুরিত বীজ আলু রোপণ করতে হবে।

রোগের নাম: কান্ড পচা
স্কেলেরোসিয়াম রলফসি নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
ক্ষতির নমুনা: এ রোগের আক্রমণের ফলে বাদামি দাগ কান্ডের গোড়া ছেয়ে ফেলে। গাছ ঢলে পড়ে এবং পাতা বিশেষ করে নিচের পাতা হলদে হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে বা আশেপাশের মাটিতে ছত্রাকের সাদা সাদা জালিকা দেখা যায়। কিছু দিন পর সরিষার দানার মত জীবানুর গুটি বা স্কেলেরোসিয়াম সৃষ্টি হয়। আলুর গা থেকে পানি বের হয় এবং পচন ধরে। ক্রমে আলু পচে নষ্ট হয়ে যায়।

ব্যবস্থাপনা: আক্রান্ত গাছ কিছুটা মাটিসহ সরিয়ে ফেলতে হবে। জমি গভীর ভাবে চাষ করতে হবে। জমিতে সব সময় জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

রোগের নাম: আলুর শুকনো পচা রোগ
ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে।

ক্ষতির নমুনা: আলুর গায়ে কিছুটা গভীর কালো দাগ পড়ে। আলুর ভিতরে গর্ত হয়ে যায়। প্রথম পচন যদিও ভিজা থাকে পরে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে গোলাকার ভাঁজ এবং কখনো কখনো ঘোলাটে সাদা ছত্রাক জালিকা দেখা যায়।

ব্যবস্থাপনা: আলু ভালভাবে বাছাই করে সংরক্ষণ করতে হবে। যথাযথ কিউরিং করে আলু গুদামজাত করতে হবে। ডাইথেন এম ৪৫ দ্রবণ (০.২%) দ্বারা বীজ আলু শোধন করতে হবে। বস্তা, ঝুড়ি ও গুদামজাত আলু ৫% ফরমালিন দিয়ে শোধন করতে হবে। প্রতি কেজিতে ২ গ্রাম হিসেবে টেকটো ২% গুড়া দিয়ে আলু শোধন করা দরকার।

রোগের নাম: ঢলে পড়া এবং বাদামি পচন
সিউডোমোনাস সোলানেসিয়ারাম নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হযে থাকে।
ক্ষতির নমুনা : গাছের একটি শাখা বা এক অংশ ঢলে পড়তে পারে। পাতা সাধারণত হলুদ হয় না এবং সবুজ অব¯হায়ই চুপসে ঢলে পড়ে। গোড়ার দিকে গাছের কান্ড ফেড়ে দেখলে বাদামি আক্রান্ত এলাকা দেখা যায়। ঢলে পড়া গাছ খুব দ্রুত চুপসে যায়। আক্রান্ত আলু কাটলে ভিতরে বাদামি দাগ দেখা যায়। আলুর চোখে সাদা পুঁজের মত দেখা যায় এবং আলু অল্প দিনের মধ্যে পঁচে যায়।

ব্যবস্থাপনা: সুস্থ রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। আলু লাগানোর সময় প্রতি হেক্টরে ৮০-৯০ কেজি হারে স্ট্যাবল ব্লিচিং পাউডার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। পরিমিত মাত্রায় সেচ প্রয়োগ এবং রোগ দেখা দিলে পানি সেচ বন্ধ করতে হবে।

রোগের নাম: আলুর দাদ রোগ
স্ট্রেপ্টোমাইসিস স্কেবিজ নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
ক্ষতির নমুনা: হালকা দাদ হলে টিউবারের উপরে উঁচু এবং ভাসা বিভিন্ন আকারে বাদামি দাগ পড়ে। রোগের গভীর দাদে গোলাকার গর্ত বা ডাবা দাগ পড়ে। রোগের আক্রমণ সাধারণত ত্বকেই সীমাবদ্ধ থাকে।

ব্যবস্থাপনা: রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। জমিতে বেশি মাত্রায় নাইট্রোজেন সার ব্যবহার বর্জন করতে হবে। ৩% বরিক এসিড দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। জমিতে হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হয়।

রোগের নাম: আলুর কালো পা/নরম পঁচা রোগ
আরউইনা কেরোটোভোরা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।

ক্ষতির নমুনা: আক্রান্ত অংশে কোষ পচে যায়। পচা আলুতে এক ধরনের উগ্র গন্ধের সৃষ্টি হয়। চাপ দিলে আলু থেকে এক প্রকার দূষিত পানি বেরিয়ে আসে। আক্রান্ত অংশ ঘিয়ে রংয়ের ও নরম হয় যা সহজেই সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়।

ব্যবস্থাপনা: সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত সেচ দেয়া উচিত নয়। উচ্চ তাপ এড়ানোর জন্য আগাম চাষ করতে হবে। ভালভাবে বাছাই করে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। ১% ব্লিচিং পাউডার অথবা ৩% বরিক এসিডের দ্রবণে টিউবার শোধন করে বীজ আলু সংরক্ষণ করতে হবে।

রোগের নাম: পাতা মোড়ানো ভাইরাস
এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ ।

ক্ষতির নমুনা : আক্রান্ত গাছের পাতা খসখসে, খাড়া ও উপরের দিকে মুড়ে যায়। আগার পাতার রং হালকা সবুজ হয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় । কখনো আক্রান্ত পাতার কিনারা লালচে বেগুনি রংয়ের হয়। গাছ খাটো হয় এবং সোজা হয়ে উপরের দিকে দাঁড়িয়ে থাকে। আলুর সংখ্যা কমে যায় এবং আলু অনেক ছোট হয় ।
ব্যবস্থাপনা: রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশক (এজেড্রিন, নোভাক্রন, মেনোড্রিন ইত্যাদি) ২ মিলি অথবা ১ মিলি ডাইমেক্রন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর জমিতে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত গাছ টিউবারসহ তুলে ফেলতে হবে।

রোগের নাম: মৃদু মোজাইক
পটেটো ভাইরাস এ এবং এক্স এর কারণে এ রোগ দেখা যায়।

ক্ষতির নমুনা: পাতা হলদে হয় ও তার উপরে বিভিন্ন বর্ণের দাগ পড়ে। পাতা কিছুটা কুঁকড়িয়ে গাছ খর্বাকৃতির হয়।
ব্যবস্থাপনা: রোগমুক্ত বীজ আলু ব্যবহার এবং এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন আলু বীজ বপন ও জাব পোকা দমন করতে হবে।

রোগের নাম: কমন স্কেব
স্ট্রেপ্টোমাইসিস স্কেবিজ (Streptomyces scabies)

ক্ষতির নমুনা: শুধু মাত্র টিউবারেই লক্ষণ প্রকাশ পায়। টিউবারের গায়ে বাদামী রঙের বসে যাওয়া, উঁচু অথবা খসখসে দাগ (দাদ) দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা : এই রোগের প্রতিকারের উপায় হল- ফসল পর্যায়, শোধিত ও রোগ মুক্ত বীজ ব্যবহার, ক্ষারীয় মাটিতে আলুর আবাদ পরিহার ও জমিতে এবং নিয়মিত ও পরিমিত সেচ।

রোগের নাম: ভিতরের কালো দাগ
অপরজীবি জনিত রোগ

ক্ষতির নমুনা: টিউবারের কেন্দ্র কালো বা নীলচে কালো রং ধারণ করে। অক্সিজেনের অভাব বেশি হলে সমস্ত টিউবারই কালো হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত অংশ সংকুচিত হয়ে ফেঁপে যেতে পারে।

ব্যবস্থাপনা: এই রোগের প্রতিকারের উপায় হল উচ্চ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করা ও গুদামে বাতাস চলাচলে ব্যবস্থা রাখা।

রোগের নাম: অন্তর ফাঁপা রোগ
অপরজীবিজনিত রোগ
ক্ষতির নমুনা: সাধারণতঃ বড় বড় আলুর কেন্দ্রে অসম ফাঁপা অংশ সৃষ্টি হয়। পাশের কোষ সমূহ খসখসে ও বাদামি বর্ণ ধারণ করে যা বাহির থেকে বুঝা যায় না।

ব্যবস্থাপনা: এই রোগের প্রতিকারের উপায় হল কম দূরত্বের বপন, সুষম সার ব্যবহার করা ও নিয়মিত সেচ প্রদান করা ।
ফসল তোলা:
মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে আলু তোলা ঠিক না। সকালের সময়ে আলু উঠানো ভাল। আলু সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ক হলে তুলতে হয়। আলু উঠানোর ৭-১০ দিন আগে গাছের গোড়া কেটে ফেলা দরকার। আলু তোলার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোদাল বা লাঙ্গলের আঘাতে আলু কেটে না যায়। সাধারণত বস্তায় আলু ভরার সময় প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা গামলা ব্যবহার করা উত্তম। আলু সংগ্রহ শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে নেয়া দরকার। যাদ কোন কারণে আলু ক্ষেতে রাখতে হয় তা হলে ছায়াযুক্ত জায়গায় বিছিয়ে পাতলা কাপড়/খড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। হিমাগার বা কেল্ড স্টোরেজে রাখতে হলে কাটা, ফাটা, রোগবালাইমুক্ত আলু বাছাই করে গ্রেডিং করে বরিক এসিড (৩%) দিয়ে বীজ শোধন করে বীজ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে হয়।

আলু বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি
উন্নত মানের আলুর বীজ উৎপাদনের জন্য নিম্নরূপ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
১. রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২. কার্তিক (মধ্য-অক্টোবর থেকে নভেম্বর) মাসের আগাম জাতের লাগাতে হয়।
৩. পাতা গজানোর পর থেকে আলু তোলার ১৫ দিন পূর্ব পর্যন্ত ৭-১০ দিন পর পর জাবপোকা দমনের জন্যঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। ডাইমেক্রন এবং অন্য অনুমোদিত ঔষধ প্রতি ১ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪. নিয়মিতভাবে ১ দিন পর পর রোগাক্রান্ত বা অস্বাভাবিক গাছ আলু সমেত তুলে ফেলতে হবে (রোগিং)।
৫. আলু তোলার ৭-১০ দিন পূর্বে মাটির উপরের গাছ উপরে বা কেটে ফেলতে হবে।
৬. আলু ৭০-৮০ দিন বয়স হলে তুলে পরিপক্কতা দেখা উচিত।
৭. মড়ক, জাব পোকা বা অন্য কোন রোগ দেখা দিলে আরো আগে আলু তুলে ফেলতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে প্রতি ১০০টি আলুর পাতায় যেন ২০টির বেশি ডানা বিহীন জাবপোকা না থাকে।
৮. জাব পোকার চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বেই গাছ কেটে ফেলতে হবে। অর্থাৎ মাঘ মাসে (জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ )।
৯. অন্যান্য আলু ফসল যেমন মরিচ, টমেটো, তামাক ইত্যাদি সোলানেসি গোত্রভূক্ত গাছ থেকে বীজ আলু ফসল অন্তত ৩০ মিটার দূরে লাগাতে হবে।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment