দেশীয় গরু : আসুক স্বনির্ভরতা

দেশীয় গরু : আসুক স্বনির্ভরতা

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

দেশে সারা বছরই গরুর বাজার থাকে সরগরম। মুসলিম দেশ হিসেবে গরুর মাংসের প্রতি বাংলাদেশী জনগণের বাড়তি আকর্ষণের অন্যতম কারণ। তবে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কুরবানির ঈদে চাঙ্গা হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠে পশুর বাজার। একসময় দেশে গরুর মাংসের এবং কুরবানির চাহিদা পূরণে ভারতীয় গরুর নির্ভরতা ছিল বহুলাংশে। আশার খবর হচ্ছে- সেই দিন এখন আর নেই। গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরে গরু, মহিষ, ছাগল পালন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে কমে এসেছে ভারতীয় গরুর চাহিদা। কুরবানিসহ সারাদেশে এখন গরুর মাসের চাহিদা পূরণে দেশীয় গরু পালনে স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।কোরবানির ঈদে ৬০ হাজার কোটি

টাকার পশুর বাজার

সারা বছর গরুর মাংসের চাহিদা থাকলেও কোরবানির ঈদে বেড়ে যায় গরুর চাহিদা। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- শুধু কুরবানির ঈদকে উপলক্ষ্য করে কোরবানির পশু, পশুর চামড়াসহ অন্য খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর ৬০ শতাংশই হয় কুরবানির ঈদে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বর্তমানে দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা চার কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে গরু ও মহিষ দুই কোটি ৩৫ লাখ এবং ছাগল ও ভেড়া দুই কোটি ৫৫ লাখ। এ বছর কোরবানির উপযোগী এক কোটি ৫ লাখ পশু রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ লাখ গরু ও মহিষ এবং ৭২ লাখ ছাগল ও ভেড়া। ঈদুল আজহায় কি পরিমাণ পশু কোরবানি হয় তার সুনির্দিষ্ট হিস্যা না থাকলেও বাণিজ্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশে ৪০ লাখ গরুসহ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ পশু কোরবানি হয়ে থাকে। এরমধ্যে ৩৬ লাখ গরু কোরবানি হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর কুরবানির গরুর চাহিদা তৈরি হয় কমবেশি ৪০ লাখের মতো। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ নিজস্ব উৎপাদন থেকে আসছে। তবে কুরবানির সময় মোট চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঘাটতি থাকে। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় গরুতে তা পূরণ হয়ে আসছে।

আশা জাগাচ্ছে দেশীয় খামার

ভারত হঠাৎ গরু রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে ২০১৪ সালে বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয় বাংলাদেশকে। অবশ্য এই সঙ্কটই সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে বাংলাদেশকে। দেশে যে হারে জনসংখ্যা এবং গরুর মাংসের চাহিদা বাড়ছে তা পূরণ করার জন্য ভারতীয় গরু ও মহিষের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশীয়ভাবে গরু, মহিষ ও ছাগল পালনে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিলে বিরাট সুফল পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে দুই বছর আগেও কোরবানি ঈদ সামনে রেখে ভারতীয় গরু আসত প্রতিদিন গড়ে পাঁচ-সাত হাজার। গরু রফতানিতে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে চলতি বছর তা অস্বাভাবিক কমেছে। আশার খবর হচ্ছেÑ ভারতীয় গরু আমদানিতে সীমান্তবর্তী রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩১টি করিডোরের ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এখন কোন কোন করিডোর দিয়ে ভারতীয় গরু আমদানি নেই বললেই চলে। দেশে উৎপাদিত গরুর পর্যাপ্ত সরবরাহের পাশাপাশি সীমান্তের কড়া পাহাড়ার কারণেই ভারতীয় গরু আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৮ লাখ পরিবার সরাসরি গবাদি পশু পালনের সঙ্গে জড়িত। দেশে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৩৬ লাখ এবং মহিষের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এর মধ্যে গাভী ও বকনা বাছুর রয়েছে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৫৫ লাখ। মোট গরুর ৬০ শতাংশই পালন করা হয় কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়। বিভিন্ন তথ্যের আলোকে দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে গরু আমদানি বাবদ প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় অথচ গরু-মহিষ লালন পালনের কাজে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে দেশের চাহিদা পূরণ করে মাংস ও পশুর বর্জ্য রফতানি করে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানো যায়। কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গরুর খামার সরকারের সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আশার আরেকটি খবর হলোÑ মাংসের সঙ্কট মেটানোর জন্য খুলনা ও বাগেরহাটের চার উপজেলার ২৮টি গ্রামে আমেরিকার ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদন শুরু হয়েছে। খামারিদের মতানুযায়ী দেশীয় জাতের গরুর প্রতিদিনের দৈহিক ওজন ২০০-৩০০ গ্রাম বৃদ্ধি পায়। আর ব্রাহমা জাতের গরুর প্রতিদিনের দৈহিক ওজন ১ হাজার থেকে ১৫শ গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়। উৎপাদিত এ জাতের গাভী প্রতিদিন ১৮ কেজি করে দুধ দেয় আর পূর্ণ বয়স্ক একটি ষাঁড় থেকে ১৫ মণ মাংস পাওয়া সম্ভব বলে জানা গেছে। যা আগামী তিন বছরের মধ্যে কুরবানির পশু ও দৈনন্দিন মাংসের চাহিদা পূরণে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ২৮টি গ্রাম হচ্ছে মহানগরীর লবণচরা, পশ্চিম বানিয়া খামার, বাগমারা, গল্লামারী, খুলনার রূপসা উপজেলার আইচগাতি, রাজাপুর ও বাধাল, ফুলতলা উপজেলার ধোপাখোলা, মশিয়ালি, দক্ষিণডিহি, উত্তরডিহি, শিরোমণি, যুগ্নীপাশা, গাবতলা, বুড়িরডাঙ্গা, আলকা, দামোদর ও ডাকাতিয়া এবং বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী, বুড়িগাংনী, রাজপাট, গাওলা, মাদারতলী, নতুন ঘোষগাতি, ঘাটভিলা, সুড়িগাতি, সারুলিয়া ও মেঝের গাওলা। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় ব্রাহমা জাতের সিমেন দিয়ে ৩৩৪টি গাভীর প্রজনন শুরু হয়েছে। খামারিদের মধ্যে এ নতুন জাত নিয়ে সাড়া পড়েছে। এর ফলে খামারিরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমিষের চাহিদা পূরণ হবে।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment