ফেলনা জিনিসের উদ্যোক্তা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বর্তমান সময়ে পানি, পানীয় কিংবা ওষুধের বোতল তৈরি থেকে শুরু করে অন্যান্য আরও অনেক কাজে পলিইথাইলিন টেরেফথালেট বা পিইটি’র ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এসব বোতল সাধারণত একবার ব্যবহার শেষেই জায়গা করে নেয় ডাস্টবিনে। তবে রিসাইকেল পদ্ধতিতে এ থেকে নতুন পিইটি রেজিন তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণে ফেলনা বোতল বা অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করা হয় চীনে। সেখানে এগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় রেজিন যা থেকে আবার বোতলসহ অন্যান্য প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি হয়। তবে চীন থেকে পিইটি রেজিন আমদানি বেশ ব্যয়বহুল। তাই এসব ফেলনা বোতল ও অন্যান্য প্লাস্টিক সামগ্রী যদি বাংলাদেশেই রিসাইকেল করার মাধ্যমে রেজিন তৈরি করা যায়, সেক্ষেত্রে বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা যেমন সম্ভব, তেমনি পরিবেশ রক্ষায়ও এটি হতে পারে দারুণ এক উদ্যোগ। এমনই ভাবনা থেকে কাজ শুরু করেন খাদেম মাহমুদ ইউসুফ, প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি (বিপিসিএল)। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে খাদেম মাহমুদ জানান, ‘আমার ব্যাকগ্রাউন্ড মূলত ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। চাকরি শুরু করি চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এএমডিতে। পরবর্তীতে আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাই এবং সেখানে ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টরে কাজ করি। এরপর আমি বেশ কয়েকটি স্টার্টআপেও কাজ করেছিলাম। সর্বশেষ আমি কোওয়েভ নেটওয়ার্কস নামের একটি স্টার্টআপে কাজ করি যেটি মূলত ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করত।’
তবে এর কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসেন তিনি এবং এখানে নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এক বন্ধুর সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আলাপ কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ‘সে সময় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ব্যাংককে একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত করা, এই দিকটি নিয়েই আমরা মূলত তখন কাজ করেছিলাম। এরপর একে একে বিভিন্ন ব্যাংক আমাদের এই সেবাটি গ্রহণ করতে শুরু করেছিল।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু দেশে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলাম, তাই দেখা গেলো যে দুই দেশ মিলিয়ে পেরে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। সে সময় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে আসি, কিছুদিন থাকি। অবশ্য এরপর আমি একবারেই এখানে থেকে গেলাম।’
২০০৭ সালে অ্যাক্সেসটেল আলাপ কমিউনিকেশন কিনে নিয়েছিল, জানান খাদেম। ‘এরপর আমি বাংলাদেশে নকিয়ার সার্ভিসেস গ্রুপের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে নকিয়ার এই অংশটি সিমেন্সের সাথে একীভূত হওয়ার পর আমি নকিয়া সিমেন্স নেটওয়ার্কের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিলাম। ৫ বছর কাজ শেষে আমি চাকরিটি ছেড়ে দিই।’ আর এরপরই মূলত তিনি পিইটি নিয়ে কাজ করার জন্য পরিকল্পনা করেন। ‘নকিয়া সিমেন্স নেটওয়ার্কের চাকরি ছাড়ার পর আমি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের একটি প্রকল্পে কাজ করার সময় পিইটির বিষয়টি জানতে পারি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ পিইটি আমদানি করে। সে সময় পিইটি উৎপাদনের জন্য একটি প্লান্ট তৈরির কথা মাথায় এলেও প্রচুর বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ না থাকায় সে সময় আর কিছু করা হয়নি। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে ফেলে দেওয়া বোতল রিসাইকেল করার মাধ্যমেও পিইটি তৈরি করা যায় যা মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে।’ এ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে তাই তিনি ছুটলেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং ইতালিতে। সেখানে বিভিন্ন প্লান্ট পরিদর্শন শেষে অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে ২০১২ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসেন। ‘এসব দেশে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা এসব বোতলের চাহিদাও বেশ ভালো এবং মানুষ বেশ আগ্রহ নিয়েই এসব বোতল কিনে থাকে।’ জানান খাদেম।
দেশে ফিরে একটি রিসাইক্লিং প্লান্ট তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। ‘২০১৩ সালে একটি ব্যাংক এবং কয়েকজনের ব্যক্তিগত বিনিয়োগে একই বছরের মার্চে আমি দেশের প্রথম বোতল রিসাইক্লিং প্লান্ট চালু করি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা এখান থেকে ফুড গ্রেড পিইটি রেজিন তৈরি করবো।’ বোতল রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পিইটি রেজিন তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ কয়েকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ‘আমাদের দেশে প্রতি বছর পিইটির চাহিদা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টন। গত ৮ বছরে এই বাজার ২০ শতাংশ বেড়েছে। আর পিইটি বোতলের চাহিদা বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সব মিলিয়ে বর্তমানে এই বাজারের আকার প্রায় ২২৫ মিলিয়ন ডলারের। মূলত চীন থেকে বাংলাদেশে পিইটি আমদানি করা হয়ে থাকে যা বেশ ব্যয়বহুল। কিন্তু দেশেই যদি বোতল পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পিইটি রেজিন তৈরি করা যায়, তাহলে অনেক অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। পরিবেশ রক্ষায়ও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি বোতল সম্পূর্ণরূপে মাটির সাথে মিশে যেতে প্রায় ১০০ বছর সময় লাগে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ। কিন্তু পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকেও রক্ষা করা যাবে। এর পাশাপাশি আমাদের এই প্রকল্পে জাইকা এবং ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে।’, বলেন খাদেম। তিনি জানান, বর্তমানে রূপগঞ্জে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মাসে ৪০০ টন উত্পাদনে সক্ষম প্লান্ট। তবে একে ৮০০ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি। বর্তমানে ফেলনা বোতল চীনে রপ্তানীর ক্ষেত্রে সরকারের ১০ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রণোদনার পরিমাণ কমিয়ে দিলে দেশের এই রিসাইক্লিং শিল্পের জন্য সেটি সহায়ক হবে বলেও মনে করেন খাদেম মাহমুদ।
উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে কোন কারণগুলো প্রভাবিত করেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে খাদেম মাহমুদ ইউসুফ বলেন, ‘আসলে চাকরি করলে কিছু সুবিধা রয়েছে, মাস শেষে একটি আয়ের নিশ্চয়তা থাকে। কিন্তু দিনশেষে বলার মতো তেমন কিছুই থাকে না। অন্যদিকে উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে সমাজে নিজের একটি আলাদা জায়গা তৈরি করা নেওয়া সম্ভব। এখানে অনেক বাধা বিপত্তি থাকে। কিন্তু আমার মাধ্যমে যখন বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, তখন সেটিই নিজের অর্জন বলে মনে হয়। এর মাধ্যমে দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য অবদান রাখা যায়। এই বিষয়টি মূলত উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে আমাকে প্রভাবিত করেছে।’
নতুন উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা চমৎকার কিছু আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাদের এই আইডিয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা খুব একটা দক্ষ না। এ ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে যে দক্ষতা প্রয়োজন হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সেটি না থাকায় অনেক স্টার্টআপই সফল হচ্ছে না। আরেকটি ব্যাপার হলো একটি স্টার্টআপের পরিণত অবস্থায় পৌঁছাতে ৩-৪ বছর সময় লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ৬ মাস বা এক বছর নিজের টাকায় প্রতিষ্ঠান চালিয়ে পরে বন্ধ করে দিতে হয়। এই জায়গায় অনেকেই ব্যর্থ হয়। আরেকটি বড় কারণ হলো এখানে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে স্টার্টআপগুলো বিনিয়োগ পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ স্টার্টআপের শুরুর দিকে অনেকেই নিজেদের মধ্যে কোনো লিখিত চুক্তি ছাড়াই কাজ শুরু করে দেয় যার কারণে পরবর্তীতে বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। তাই শুরুতেই একটি লিখিত চুক্তি করে নেওয়ার উপরও জোর দেন তিনি।