উদ্যোক্তার হাত ধরে এগিয়ে যাবে অর্থনীতি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এসব নবীন উদ্যোক্তাই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবেন। নবীন উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে যুবসমাজকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে; বিনিয়োগের জন্য অর্থায়নের সুযোগ করে দিতে হবে। এ ছাড়া অবকাঠামো, কর সুবিধাসহ অন্যান্য নতুন উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য তথ্যপ্রযুক্তি হলো সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি।
গতকাল শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘বাংলাদেশে উদ্যোক্তা উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এ সভা আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানির পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চাই। এ খাতে বিপুল উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। এ জন্য ২০১৮ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য তিন ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য “১০-১০-১০” পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বছরে ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করতে পারে এমন ১০টি প্রতিষ্ঠান; অন্তত এক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রপ্তানি করতে পারে এমন আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান এবং স্টার্টআপ বা নবীন সৃজনশীল ১০টি প্রতিষ্ঠানকে কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতা অর্জনের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে।”’ তিনি মনে করেন, ডিজিটাল অর্থনীতিতে পুঁজি নয়; সৃজনশীলতাই মুখ্য।
বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা তুলে ধরে জুনাইদ আহমেদ বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নবীন ও সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে ৪৩৬টি প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৫০টি বাছাই করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০টি উদ্যোক্তা প্রস্তাব বিশ্ব জয় করার মতো। আগামী কয়েক বছরে এই ১০টি উদ্যোগ বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
শিল্পসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, উদ্যোক্তা তৈরি করতে হলে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে। এ ছাড়া শিল্পকারখানায় গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি মনে করেন, ঋণ অনাদায়ি হয়ে যাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় অভিযুক্ত বহু ব্যাংকার। তাই ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া এখন নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তুলনামূলক কঠিন হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী মাস থেকে বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারি কমিশন একীভূত হয়ে কাজ করবে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সবুর খান বলেন, বাংলাদেশে সম্ভাবনা আছে বলেই এত উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উদ্যোক্তা তৈরির জন্য এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগ তৈরি করেনি। এ বিভাগ থেকে উদ্যোক্তার পাশাপাশি এন্ট্রাপ্রেনিউর তৈরি করা হচ্ছে। যাঁরা (এন্ট্রাপ্রেনিউর) যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পাশাপাশি সৃজনশীল উদ্যোগ তৈরি করবেন। ওই কোম্পানি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে; ওই এন্ট্রাপ্রেনিউরকে একটি নির্দিষ্ট অংশের মালিকানা দেবে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় এমন ১৫ জন এন্ট্রাপ্রেনিউর তৈরি করেছে, যারা যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যেকোনো কাজের জন্য উপযুক্ত।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন। এ সময় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উদ্যোক্তা তৈরিতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কী করছে, তার ওপর একটি উপস্থাপনা দেন এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মারুফ রেজা। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম মাহবুব-উল-হক মজুমদার।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেনের মতে, সৃজনশীল মেধা না থাকলে উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন। বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তা তৈরি না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি এত দূর আসত না। তিনি মনে করেন, অর্থনীতির চাহিদা অনুসারে মানবসম্পদ জোগানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। দেশে এখন বস্ত্র ও ইলেকট্রনিক খাতের প্রকৌশলী দরকার।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘আমরা এখনো বাঁশ-বেত, মানে কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তা তৈরির মধ্যেই আছি। কিন্তু পৃথিবী বদলে গেছে। কায়িক শ্রমের পরিবর্তে উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টি এখন মেধাভিত্তিক হয়েছে। কিন্তু এখনো মেধাভিত্তিক এসব খাতের জন্য শ্রম আইন তৈরি করতে পারিনি।’
উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়ার সমস্যা নিয়ে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘যাঁর মাথায় তেল বেশি, তাঁর মাথায় তেল দিতে চায় ব্যাংক। নবীন উদ্যোক্তারা ঋণ পান না। যাঁর টাকা আছে, ব্যাংক তাঁর পেছনে দৌড়ায়। আর যাঁদের টাকা নেই, তাঁরা ব্যাংকের পেছনে দৌড়ায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডের (ইইএফ) চিত্র তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক লীলা রশিদ বলেন, গত ১৬ বছরে ২ হাজার প্রকল্পে অর্থ মঞ্জুরি দেওয়া হয়েছে। ৮০০-র মতো প্রকল্পে এ অর্থ গেছে। তিনি মনে করেন, রাতারাতি উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ দিতে হবে।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি নুরুল ইসলামের মতে, দেশের বেকারদের তিন-চতুর্থাংশই তরুণ-তরুণী। তাঁদের কাজে না লাগালে অপচয় হবে। শুধু চাকরি নয়; কৈশোর থেকেই তাঁদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
দেশে উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করে বক্তব্য দেন ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি হুমায়ূন রশিদ। কারণগুলো হলো: অর্থায়নের সুযোগ কম; ব্যবসায় নিবন্ধনে জটিলতা, বিদ্যুতের সংকট; অবকাঠামো দুর্বলতা ও কর ব্যবস্থাপনা।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম মনে করেন, উদ্যোক্তা হওয়া সহজ নয়; এটা নিজের ভেতর থেকে আসতে হয়। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক এস এম শাহীন আনোয়ার বলেন, নতুন ব্যবসা যাঁরা শুরু করেন, এক বছরের মধ্যেই তাঁদের ৪৫-৫০ শতাংশ ঝরে পড়ে।
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য শাহানা জেফরীন মনে করেন, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় এ দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। উইমেন চেম্বারের পাঁচ হাজার সদস্যদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান ভালো চলছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সহসভাপতি ওয়াহিদ শরীফ বলেন, আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আছে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। প্রতিবছর ব্যবসায় নীতি পরিবর্তন করলে উদ্যোক্তা তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে বলে তিনি মনে করেন।
ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব স্মল বিজনেস সৈয়দ আবদুল মোমেনের মতে, ঝুঁকির কারণে ব্যাংকগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের টাকা দিতে উৎসাহিত হয় না।
সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের কর্মসূচি সমন্বয়ক মাজেদুল ইসলাম বলেন, দেশের ৪ হাজার ৫৪৭টি ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে একজন করে নারী ও পুরুষ কাজ করছেন। তাঁরা উদ্যোক্তা। স্কাইপি, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, জমির পর্চা—এসব সেবা সেন্টার থেকে পাওয়া যায়। এতে ওই উদ্যোক্তারা মাশুল পান।
বাংলাদেশের তরুণদের সম্ভাবনার উদাহরণ দিয়ে প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান বলেন, বিশ্বব্যাপী যে কয়টি নতুন উদ্যোগকে সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেগুলোর একটি বাংলাদেশিদের উদ্যোগ ব্যাকপ্যাক। এই প্রতিষ্ঠানটি বাহকের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মালামাল হস্তান্তরের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে।