বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামার পরিকল্পনা

বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামার পরিকল্পনা

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

আমাদের দেশে প্রাণীজ আমিষের অভাব খুবই প্রকট। আমিষের এ অভাব মেটাতে মুরগি পালনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান বিশেষ জরুরী। খুব অল্প সময়ে অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে সাম্প্রতিক সময়ে মুরগি পালন একটি লাভজনক ও সম্ভাবনাময় কৃষি শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক পরিকল্পনায় মুরগি খামার স্থাপনের মাধ্যমে মুরগি পালনকে লাভজনক করে তোলা যায়। মুরগি খামার দু’ধরনের হতে পারে। যেমন-পারিবারিক মুরগি খামার ও বাণিজ্যিক মুরগি খামার। পারিবারিক মুরগি খামারে অল্পসংখ্যক মুরগি পালন করে সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে বাণিজ্যিক মুরগি খামার গড়ে তোলা যায়। উৎপাদনের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে মুরগির খামার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। মাংস উৎপাদনের জন্য মুরগি পালন করলে একে বলা হয় ব্রয়লার খামার। আবার ডিম উৎপাদনের জন্য খামার করলে একে বলা হয় লেয়ার খামার। তবে যে খামারই স্থাপন করা হোক না কেন তা লাভজনক করতে চাইলে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা, বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিচালনা।

বাণিজ্যিক মুরগি খামারের জন্য স্থান নির্বাচন

মুরগির খামার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। খামার বলতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মুরগি প্রতিপালন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানকে বুঝায়। মুরগির খামার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন ডিম উৎপাদন খামার, মাংস উৎপাদন খামার, প্রজনন খামার, ব্রিডার খামার, বাচ্চা উৎপাদন খামার ইত্যাদি। যে ধরনের মুরগি খামারই স্থাপন করা হোক না কেন সাফল্যজনকভাবে খামার পরিচালনার জন্য এর স্থান নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কৌশল। খামারের জন্য স্থান নির্বাচনের সময় নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন-

  • খামারের স্থান উঁচু হওয়া উচিত। খামার এমন স্থানে গড়তে হবে যেখানে বন্যার পানি কখনও প্রবেশ করতে না পারে।
  • যে স্থানে খামার করা হবে সেখানকার মাটি বালু ও কাঁকর মিশ্রিত হতে হবে এবং মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা থাকতে হবে।
  • খামার স্থাপনের জন্য নির্বাচিত স্থানে পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • খামারের স্থানটি মানুষের বাড়িঘর থেকে দূরে কোলাহলমুক্ত জায়গায় হতে হবে।
  • যে স্থানে খামার করা হবে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে। মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত মূলপথ থেকে অন্তত আধা কিলোমিটার দুরে খামারের স্থান নির্বাচন করা উচিত।
  • যেখানে খামার করা হবে সেখানে বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • খামারের স্থান নির্বাচনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আশেপাশে সস্তায় ও সহজে মুরগির খাদ্য ক্রয় করার সুযোগ-সুবিধা থাকে।
  • খামারে উৎপাদিত পণ্য, যেমন-ডিম, মুরগি ইত্যাদি সহজে বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকতে হবে।
  • খামার স্থাপনের জন্য নির্বাচিত স্থানের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম কি না সেটাও বিবেচনা করতে হবে।

বাণিজ্যিক মুরগি খামার পরিকল্পনায় বিবেচ্য বিষয়সমূহ

যে কোন খামার বা শিল্পে বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভের জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাণিজ্যিক মুরগি খামার ব্যবস্থাপনায় তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়, যথা-

  • মুরগির খাদ্য
  • বাসস্থান ও
  • রোগ দমন। মুরগির খামার একটি বিশেষ ধরনের শিল্প।

তাই এ খামার প্রতিষ্ঠার জন্য মূল বিষয় ছাড়াও আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হয়। মুরগির খামার পরিকল্পনার সময় নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।

জমির পরিমাণ

বার্ষিক যত সংখ্যক ডিম/ব্রয়লার উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে তদনুযায়ী লেয়ার/ব্রয়লার প্রতিপালনের ঘর এবং অন্যান্য সুবিধা, যেমন- অফিস, শ্রমিক ঘর, খাদ্য গুদাম, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের ঘর, সংরক্ষণাগার ইত্যাদি তৈরির জন্য মোট জায়গার সঙ্গে আরও প্রায় ১.৫ গুণ ফাঁকা জায়গা যুক্ত করে খামারের মোট জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।

মুরগির বাসস্থান

নিরাপদ ও আরামে থাকার জায়গার নাম বাসস্থান। বাসস্থান নিরাপদ রাখতে হলে নির্বাচিত স্থানের উপযোগী দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে তা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ঝড়বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে সহজে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। বাসস্থানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, যেমন-পরিমাণমতো থাকার জায়গা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য ও পানির পাত্র, তাপ ও আলো এবং বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। পালনকারীর সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে ঘর পাকা, কাঁচা বা টিনের হতে পারে। প্রজাতি বা স্ট্রেইন অনুযায়ী যতগুলো মুরগি রাখা হবে এদের মোট জায়গার পরিমাণ হিসেব করে ঘর তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দুইটি ঘরের মাঝে ২৫-৩০ ফুট বা ততোধিক জায়গা আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবাহের জন্য খালি রাখা দরকার।

  • ঘর তৈরিঃ বাজারজাত করার বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য ১ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন। এভাবে হিসেব করে ব্রয়লার উৎপাদনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই ঘরের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। সাদা খোসার ডিম উৎপাদনকারী প্রতিটি মুরগির জন্য ৩ বর্গফুট জায়গা এবং বাদামি খোসার ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জন্য ৪ বর্গফুট জায়গা হিসেব করে থাকার ঘর তৈরি করতে হবে। এসব মুরগি খাঁচায়, মাচায় অথবা লিটার পদ্ধতিতে পালন করা যায়। পালন পদ্ধতির উপর নির্ভর করে ঘরের পরিমাণ ভিন্ন ধরনের হতে পারে। খাঁচা পদ্ধতিতে প্রতিটি উৎপাদনশীল মুরগির জন্য কেইজে ৬০-৭০ বর্গইঞ্চি জায়গা প্রয়োজন হবে। কাজেই এ হিসেবে খাঁচা তৈরি করা হয়। খাঁচার সারি লম্বালম্বিভাবে এক সারি বা একটার উপর আরেকটা রেখে ৩/৪ সারি করা যায়। আবার সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে উভয় পার্শ্বেও সারি করা যায়। প্রতিটি উৎপাদনশীল মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ মাচায় ১.২-১.৩ বর্গফুট এবং লিটারে ১.৫-১.৭৫ বর্গফুট। মুরগির দৈহিক ওজন এবং আবহাওয়াভেদে এই পরিমাপের পরিবর্তন হতে পারে। লিটার পদ্ধতিতে সাধারণত প্রতি ১০ বর্গফুট মেঝের জন্য ৫ কেজি লিটার প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতিতে পালন করতে মুরগির ঘরের মেঝে পাকা হলে ভালো হয়। কাঁচা মেঝের ক্ষেত্রে শক্ত এঁটেল মাটির মেঝে হলেও চলবে। তবে এ ধরনের মেঝে বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যেতে পারে। শুকনো বালির মেঝের ক্ষেত্রে বর্ষাকালে সমস্যা হতে পারে।
  • ঘরের চালা ও বেড়ার নমুনাঃ বাংলাদেশের পরিবেশে দোচালা বা গেবল টাইপ চালই মুরগির জন্য বেশি আরামদায়ক। লেয়ারের ঘরের বেড়ার উচ্চতার পুরোটাই তারজালি দিয়ে তৈরি করতে হবে। বেশি বাতাস বা বেশি শীত হতে মুরগিকে রক্ষা করার জন্য বেড়ার ফাঁকা অংশ প্রয়োজনে ঢেকে দেয়ার জন্য চটের পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রয়লার লালন-পালনের সুবিধার্থে প্রথম সপ্তাহে ৯৫০ ফা থেকে কমাতে কমাতে ষষ্ঠ সপ্তাহে ৭০০ ফা-এ নামিয়ে আনার জন্য বেড়ায় বেশি ফাঁকা জায়গা রাখা যাবে না। কিন্তু প্রয়োজনীয় বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এজন্য দেয়ালের উচ্চতার ৬০% তারজালি দিয়ে তৈরি করতে হয়। তবে শীতের দিনে তারজালির এ অংশটুকু চটের বস্তা দিয়ে ঢাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ডিম পাড়ার বাসাঃ মাচা অথবা লিটারে পালন পদ্ধতিতে প্রতি ৫টি মুরগির জন্য ১টি করে ডিম পাড়ার বাসা সরবরাহ করতে হয়। প্রতিটি বাসা দৈর্ঘ্যে ১ ফুট, প্রস্থে ১ ফুট ও গভীরতায় ১.৫ ফুট হওয়া প্রয়োজন। খাঁচা পদ্ধতিতে পালন করলে আলাদাভাবে ডিম পাড়ার বাসা বা বাক্স লাগে না। খাঁচাগুলো ঢালসহ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে মুরগি ডিম পাড়া মাত্রই ডিমগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে খাঁচার সামনে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরের বর্ধিত অংশ এসে জড়ো হতে পারে।
  • আলোকায়নঃ লেয়ারে দৈনিক (২৪ ঘন্টায়) আলোর প্রয়োজন হবে ১৬ ঘন্টা। কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা বছরের ছোট-বড় দিন অনুযায়ী দৈনিক ২.৫ ঘন্টা হতে ৪ ঘন্টা পর্যন্ত হবে। আলোর উৎস বৈদ্যুতিক বাল্ব। যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই সেখানে উজ্জ্বল হারিকেনের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্বের শক্তি হবে ৪০ ওয়াট, আলোর রং স্বাভাবিক, আলোর তীব্রতা মৃদু (২০ লাক্স) হবে। ১টি বাল্বের আলোকায়ন এলাকা ১০০০ বর্গ ফুট। বাল্ব স্থাপনের এক পয়েন্ট হতে আরেক পয়েন্টের দূরত্ব হবে ২০ফুট। প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে কোনো উৎস থেকেই ব্রয়লার গৃহে আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রথম সপ্তাহে ব্রয়লার গৃহে খাবার ও পানি দেখার জন্য সারারাত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে রাতের বেলায় মাঝে মাঝে আলো নিভিয়ে আবার জ্বালাতে হবে এবং এভাবে সারারাত মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। সাধারণত প্রতি ১০ বর্গফুটের জন্য ৫ ওয়াট পরিমাণ আলো প্রয়োজন।

মুরগির খাদ্য ব্যবস্থাপনা

খাদ্যের গুণগত মান, খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ, প্রতি কেজি খাদ্যের দাম, খাদ্য হজমের দক্ষতা প্রভৃতি খাদ্য ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। খাদ্য খরচ মোট উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ৬০-৭৫% এবং খাদ্যের গুনাগুণ ও মূল্যের ওপর লাভলোকসান নির্ভর করে। সেজন্য খামার ব্যবস্থাপনায় খাদ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু বাসস্থানের পরিবেশ অনুকূল ও আরামদায়ক না হলে শুধু খাদ্য দিয়ে তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তেমনি খামার রোগমুক্ত না হলেও তা লাভজনক হবে না। তাই খাদ্য সংগ্রহ করা সহজ কি না এবং খাদ্যের মূল্য ন্যায্য কি না তা বিবেচনা করে খামার স্থাপন করতে হবে।

লেয়ার মুরগির সংখ্যা অনুসারে প্রতিটি মুরগির জন্য দৈনিক ১১০-১২০ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হিসেবে কমপক্ষে ২ মাসের খাদ্য সংরক্ষণাগার তৈরি করতে হয়। প্রতিটি ব্রয়লার ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ৪ কেজি খাদ্য খাবে। তাই এ পরিমাণকে ব্রয়লারের মোট সংখ্যা দিয়ে গুণ করে যে ফল দাঁড়াবে সে পরিমাণ খাদ্য ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম তৈরি করতে হবে। বয়সভেদে ব্রয়লারের জন্য ২.৫-১০ সেন্টিমিটার লম্বা খাদ্যের পাত্র বা ফিড ট্রাফের প্রয়োজন। সাধারণত ৫০টি বাচ্চার জন্য একটি খাদ্যের লম্বা ট্রে বা পাত্র এবং তদনুযায়ী পানির পাত্র প্রতি ১০০টি বাচ্চার জন্য প্রবহমাণ পানির ১টি ড্রিংকার প্রয়োজন হয়।

মুলধনের অবস্থা কী? নিজের টাকা আছে না কি এসব হিসাব করে ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। মূলধনের উপর ভিত্তি করেই খামার স্থাপনের জমি, বাসস্থানের আকার ও সংখ্যা, প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ অনুসারে গুদামের ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানির পাত্র, ব্র“ডিং যন্ত্রপাতি, খামার পরিচালনার লোকজনের জন্য অফিসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।

খামার স্থাপন ও পরিচালনার হিসাব

খামার স্থাপন ও পরিচালনার খরচ দুইভাগে বিভক্ত। যথা-

ক) স্থায়ী খরচঃ স্থায়ী খরচের খাতওয়ারী হিসেব নিম্ন্নরূপ-

খামারভুক্ত জমির মূল্যঃ

এলাকা অনুযায়ী প্রতি বিঘা জমির মুল্য কমবেশি হয়ে থাকে।

মুরগির গৃহায়ণ ব্যবস্থা বাবদ খরচঃ ঘর তৈরির সাজসরঞ্জাম বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যথা-বাঁশ, টিন বা বিচালী, মাটির ঘর, ইট, সিমেন্ট বা পাকা দালান ঘর। ঘর তৈরির সাজসরঞ্জাম অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট ঘর তৈরির খরচ, তা যেভাবেই ঘর তৈরি করা হোক না কেন প্রতি বর্গফুট হিসেবে খরচ ধরে ঘরের মোট খরচ বের করতে হবে।

ম্যানেজারের অফিস, ডিম/মাংস সংরক্ষণাগার, খাদ্য গুদাম, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জিনিসপত্র রাখার স্থান, শ্রমিকদের বিশ্রাম ঘর, অসুস্থ ও মৃত মুরগি রাখার জায়গা নির্মানবাবদ খরচ।

আসবাবপত্র ক্রয় বা তৈরি ও যানবাহন ক্রয়বাবদ খরচ, খাবার ও পানির পাত্রের দাম, ডিম পাড়ার বাক্সের দাম ও ডিম রাখার ঝুড়ি কেনার জন্য খরচ।

খ) আবর্তক বা চলমান বা চলতি খরচঃ আবর্তক খরচের খাতওয়ারী হিসেব নিম্নরূপ-

মুরগি সংক্রান্ত খরচঃ ডিমের ব্যবহার অনুযায়ী ডিমপাড়া মুরগির খামার দু’প্রকার। যথা-নিষিক্ত বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদন খামার এবং অনিষিক্ত বা খাবার ডিম উৎপাদন খামার। খাবার সাদা বা বাদামি খোসার ডিম বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদনকারী মুরগি বা বাচ্চা কোথায় পাবেন, আপনি সেগুলো আনতে পারবেন কি না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে। নিষিক্ত ডিম বা ডিমের জন্য প্রজননক্ষম পুলেট ও ককরেলের মূল্য, অনিষিক্ত বা খাওয়ার ডিম উৎপাদনের জন্য উন্নতমানের হাইব্রিড পুলেটের মূল্য অথবা একদিন বয়সের ব্রয়লার বাচ্চা ক্রয়ের খরচ।

সুষম খাদ্যের মূল্যঃ

মাথাপিছু দৈনিক ১১০-১২০ গ্রাম হিসাবে।

লিটার কেনাবাবদ খরচ। খাঁচায় মুরগি পালন করলে মেঝে পাকা হলেই ভালো।

প্রতিষেধক টিকা এবং চিকিৎসায় ওষুধপত্রের মূল্য।

খামার পরিচালনায় জনবলের বেতনভাতা খরচ, ম্যানেজারের বার্ষিক বেতনভাতা, অফিস স্টাফের বার্ষিক বেতনভাতা ও শ্রমিকদের বার্ষিক বেতনভাতা।

পরিবহন ও যাতায়াত খরচ, বিভিন্ন কাজে ম্যানেজারের যাতায়াত খরচ এবং খাদ্য সংগ্রহ, ডিম বাজারজাতকরণ ও ডিমপাড়া শেষে মুরগি বিক্রির জন্য পরিবহন খরচ।

মুলধনের সুদঃ ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে মূলধনের উপর বার্ষিক সুদ।

ডিপ্রিসিয়েসন বা অপচয় খরচঃ জমিবাদে স্থায়ী খরচের অপচয়ের শতকরা হার ইত্যাদি যত খরচ হয় সব যোগ করে বার্ষিক খরচ/ মোট খরচের হিসেব রাখতে হবে।

  • মেরামত খরচ এবং বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাবদ
  • এডভারটাইজিং বা বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয়
  • নষ্ট বা বাদ যাওয়া ডিমের মূল্য, ডিম বাছাই ও ছাঁটাই খরচ, যতগুলো ডিম বিক্রির অনুপযুক্ত হলো তার মূল্য।
  • অসুস্থ বা মৃত মুরগির মূল্য
  • খামার হতে সম্ভাব্য বার্ষিক আয়

ডিম বিক্রিঃ

লেয়ার খামারের ক্ষেত্রে বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে উৎপাদন ধরে বর্তমান বাজার দরে ডিমের মোট মূল্য।

ডিম পাড়া শেষে মুরগির মূল্যঃ

  • শতকরা ৮৮টি মুরগি সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে এ হিসেবে ডিম পাড়া শেষে বাজার দরে মোট মূল্য।
  • ব্রয়লার খামারের ক্ষেত্রে গড়ে ৮ সপ্তাহ পর পর মাংসের জন্য মুরগি বিক্রি।
  • প্রতিটি মুরগি থেকে বছরে প্রায় ৩০ কেজি বিষ্ঠা পাওয়া যেতে পারে। এভাবে হিসেব করে বর্তমান বাজার দরে মোট বিষ্ঠা বা সারের মূল্য।
  • অকেজো আসবাবপত্র বিক্রিবাবদ মোট আয়।

খামার হতে বার্ষিক কত টাকা লাভ হতে পারে তা নির্ধারণ করতে হবে। অনুমেয় অর্থ মুনাফা করতে হলে খামারজাত পণ্য হতে শতকরা ১০-১২ হারে টাকা হারে লাভে মোট কত টাকা আয় হতে পারে তা হিসেব করতে হবে। বর্তমান বাজার দরে কতগুলো ডিম বিক্রি করলে এ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করা যায় তা হিসেব করতে হবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন-বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে খাবার ডিম বা অনিষিক্ত ডিম উৎপাদন এবং ৬০-৬৫% হারে বাচ্চা ফুটানো বা নিষিক্ত ডিম উৎপাদন ধরে, প্রতিটি ডিম গড়ে ২.৫০-৩.০০ টাকা হিসেবে বিক্রি করা গেলে এবং বছর শেষে ৮৮% মুরগি নীরোগ ও স্বাস্থ্যবান থাকলে আর অবশিষ্ট অনুৎপাদনশীল মুরগি বিক্রি করে ও উৎপাদন খরচ বাদে ১০-১২% লাভ থাকবে। এ জাতীয় হিসেব করে পরিকল্পনা করতে হবে। এভাবে মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত লাভ-লোকসান নির্ধারণ করতে হবে। উপরোক্ত বিষয়সমূহ ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করা উচিত।

কেস স্টাডি:

পোলট্রি ফার্মে মাহমুদার সংসারে সুখের হাসি

বাবামায়ের চার সন্তানের মধ্যে মেঝো মেয়ে মাহমুদা আক্তার। দিনমজুর বাবা কুদু মিয়ার আয়রোজগার দিয়ে অনেক কষ্টে চলত তাদের ছয় সদস্যের পরিবারটি। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার থানাধীন বালিয়াপাড়া গ্রামে তাদের বসবাস। পড়ালেখা করেছেন গাঁয়ের স্কুলে মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। কুদু মিয়া বড় দুই মেয়েকে সাদামাঠাভাবে বিয়ে দিতে পারলেও মেঝো মেয়ে মাহমুদা আক্তারকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। পিত্রালয় ও স্বামীগৃহ একই গ্রামে। লাল মিয়ার ছেলে মোবারকের সঙ্গে আট বছর আগে বিয়ে হয় মাহমুদার। দেখতে দেখতে চলে যায় বিয়ের আট বছর। অভাব যেন সংসারে আদাজল খেয়ে লেগে আছে। এরই মধ্যে সংসারে আসে ফারুক ও রিতা নামের দুটি সন্তান। এক বছর আগে মাহমুদার রিকশাচালক স্বামী মোবারক মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা যাওয়ায় তার সংসারে ঢুকে অভাবের দানব। স্বামীর মৃত্যুর পর মাঝিবিহীন নৌকার মতো হয়ে পড়ে তার সংসার। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া তো দূরের কথা, তিন বেলা খাবার দেয়া সম্ভব ছিল না।   আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছেন বহুদিন। লজ্জায় কারও কাছে কিছু বলতে পারেননি। কোনো উপায় না পেয়ে সন্তানদের নিয়ে ফিরে যায় বাবার বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের খাবার জোগাতে একপর্যায়ে উপজেলার ফকির বাড়িতে অবস্থিত ভাই ভাই স্পিনিং মিলে কাজ নেন তিনি। মাস কয়েক সেখানে কাজ করে রোজগার যা হতো তা দিয়েই কোনো মতে চলত তিন সদস্যের ছোট পরিবারটি।

পরে বেশ কয়েক মাস স্থানীয় সরকারের আওতায় একটি প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করেছেন। ছেলেমেয়ের অসুখবিসুখ হলে চিকিৎসা করাতে পারত না। হঠাৎ একদিন লোক মারফত জানতে পারে যুব উন্নয়ন অধিদফতরে হাঁসমুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দেয়াহচ্ছে। পরে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাঠ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি হাঁসমুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ নিয়েও পুঁজির অভাবে খামার চালু করতে পারছিল না সে। অবশেষে বাবার দেয়া কানের দুল বিক্রি করে ৯ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১১ সালে শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খামার। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত ছোট ঘরে প্রথমে তিনি একদিন বয়সের ২০০টি ব্রয়লার বাচ্চা তার খামারে তোলেন। প্রথমবার মুরগি বিক্রি করে লাভও হয় ভালো। দ্বিতীয় দফায় তার খামারে ৩০০টি বাচ্চা তোলেন। হঠাৎ মুরগির খামারটিতে মড়ক লেগে মুরগিগুলো মারা যায়। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে যান তিনি।  পরে তার খামারটি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথটিও।

নানাভাবে চেষ্টা করেও খামারটি পুনরায় চালু করতে পারছিলেন না। তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। পরে তিনি প্রশিকা (এনজিও) থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। সামান্য টাকায় খামারটি পুনরায় চালু করতে পারছিলেন না। তিনি যোগাযোগ করেন আড়াইহাজার সদর বাজারের রাফসান পোলট্রি ফিড নামে একটি খাবার বিক্রেতার সঙ্গে। ওই ব্যবসায়ী তাকে ব্যবসা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। খাবারের দোকানের মালিক মাহবুব মিয়া জানান, মাহমুদা একজন পরিশ্রমী নারী। তাকে আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করেছি। কঠোর পরিশ্রমই তাকে সফলতার মুখ দেখিয়েছে। অন্য আর ১০টি খামারি থেকে তিনি ভিন্ন। সফলতার দিক দিয়ে তিনি বেশ এগিয়েছেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি সবার কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। মনোবল আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে এগিয়ে দিয়েছে। পোলট্রি ব্যবসা করে তার দিন বদলেছে। মাহমুদা বলেন, বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে তিনি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিলেন। তিনি বলেন, ‘মুরগির খামার করে আমি আমার পোলামাইয়া লইয়া অহন অনেক সুখে আছি, আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।’ আমার দিন বদলে গেছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়াচ্ছি। তার চেয়ে সুখী ওই গাঁয়ে আর কেউ নেই বলে তিনি দাবি করেন। এ ছাড়াও তিনি বাড়ির পাশে একটি পুকুর ভাড়ায় নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করছেন। সেখানেও তার মোটা অঙ্কের টাকা লাভ হচ্ছে। এক সময় অন্যের ঘরে থাকলেও টাকা জমিয়ে থাকার জন্য পিঁড়া পাকা করে দোচালা একটি টিনের ঘর দিয়েছি। ছেলেমেয়েদের ভালো খেতে দিতে পারছি। এখন এলাকায় বিভিন্ন খামরি আমার কাছ থেকে মুরগি পালন বিষয়ে নানা পরামর্শ নিতে আসে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধের ব্যাপারে এলাকায় সচেতনমূলক কাজ করছেন। এ ব্যবসার পাশাপাশি তিনি এলাকায় সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে তার খামারে ব্রয়লার মুরগির সংখ্যা এক হাজার। ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি তিনি একটি লেয়ার খামার গড়ে তুলার চেষ্টা করছেন। তার সফলতা দেখে ওই গ্রামের অনেকেই পোলট্রি ব্যবসা করতে শুরু করছে।

মুরগির খামার বদলে দিল রাশিদার জীবন

নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের বাসিন্দা রাশিদা। বৈবাহিক জীবনে দুই সন্তানের জননী তিনি। কিন্তু রিকশাচালক স্বামী লুৎফর মিয়াকে তিন বেলা খাবার জোগান দিতে গিয়ে উন্নয়নের পথ থেকে অনেকটা ছিটকে পড়তে হয়। পাশের বাড়ির এক এনজিওকর্মীর পরামর্শে রাশিদা মুরগির ফার্ম দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। স্বামীর সহযোগিতা নিয়ে এলাকার এক স্বর্ণের দোকান থেকে মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি এ ফার্মের কাজ শুরু করেন। একে একে তিনি ৫টি শেডের মাধ্যমে মুরগি পালন করতে থাকেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের যে লাভ হতো তা দিয়ে তাদের সংসার বেশ ভালোভাবে চলছিল। নিজের নামে ব্র্যাক ব্যাংক টাকা সঞ্চয়ও করছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে তার স্বামী লুৎফর সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারান। এরপর স্বামীর সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন রাশিদা। দুই সন্তানস্বামীসহ চারজনের পরিবার একাই সামাল দিতে হয় রাশিদাকে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও জীবনের এত বড় বিপর্যয় রাশিদাকে তার লক্ষ্য থেকে পিছপা করেনি। কোমর বেঁধে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালান রাশিদা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আওতায় রাশিদা ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন, যা দিয়ে তার সংসারের অভাব ঘোচানোর স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেন। ওই টাকা দিয়ে তিনি ২৫০টি মুরগির বাচ্চা ও বাচ্চার খাবার এবং ওষুধ কেনেন। এরপর রাশিদাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সর্বশেষ তিনি ২০১২ সালের এপ্রিলে আশা থেকে বাইশ হাজার টাকা এবং তাদের জমানো টাকা দিয়ে খামারের পরিধি বাড়ান। এখন তার তিনটি শেডে বিভিন্ন সাইজের ১৬০০ মুরগি আছে। তাদের সংসারে এখন আর কোনো আভাব নেই। ছেলেমেয়ে, স্বামী নিয়ে তার সংসার এখন ভালোই চলছে। রাশিদার দেখাদেখি অনেকে ঋণ নিয়ে নার্সারি, হাঁসুরগি পালন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment