বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে

বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। বর্তমানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। ১৯৬৭ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগদান করেন আর প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০০১ সালে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থ বিভাগের সচিব, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিবও ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। চীনা রাষ্ট্রপতি ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সফর, ঋণ, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, বিদেশী বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি বিতর্ক, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়।

চীনের রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক সফরকে আপনি কীভাবে দেখেন?

বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা সব খাতেই বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাই এবং চীন যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে রাজি হয়েছে, এটা আমাদের জন্য একটি সুসংবাদ। তবে মনে রাখতে হবে— বিদেশী বিনিয়োগ শুধু বাড়ালেই হবে না, একে যথাযথ খাতে ব্যবহার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আশির দশকে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে ডেট ক্রাইসিস বা ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছিল, সেটা আমাদের স্মরণ করা উচিত। তখন অর্থের অভাব ছিল না। সুতরাং ঋণ প্রচুর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ঋণ বিনিয়োগ করে তা থেকে যে লাভ করবে— সেটা আর সম্ভব হয়নি। এজন্য ঋণ পরিশোধে বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। চীনের সঙ্গে যেসব ঋণ চুক্তি সই হয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে সমীক্ষা করা হয়েছে কিনা, আমাদের সন্দেহ রয়েছে। প্রাক-সমীক্ষা ও সমীক্ষায় অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব (ভায়াবিলিটি) প্রতিষ্ঠিত না হলে ঋণ নেয়া যুক্তিযুক্ত কিনা, তা বিবেচনার প্রয়োজন আছে। চীনের সঙ্গে যেসব চুক্তি সই হয়েছে, আমার যতটুকু মনে পড়ে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ রেল খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশে রেল এখনো একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। এবং প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক না করে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হলে সে অর্থ সরকারকে ফেরত দিতে হবে। সুতরাং সেসব ঋণ সরকারের দায় হয়ে পড়বে। সেজন্য বাংলাদেশের যে বিদেশী বিনিয়োগ গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঋণ গ্রহণের আগে প্রতিটি প্রকল্পের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে— এ প্রকল্প আমাদের জন্য আর্থিক দিক থেকে লাভজনক কিনা। অলাভজনক বিনিয়োগ করলে তা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।

এ ঋণগুলো সাপ্লায়ারস ক্রেডিট। এতে শর্ত থাকে যে, কোনো টেন্ডার আহ্বান করা যাবে না। চীনা প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে… 

সাপ্লায়ারস ক্রেডিট সম্পর্কে আরো সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে যেহেতু কোনো প্রতিযোগিতা থাকে না, সেহেতু সেখানে সেবা কিংবা চুক্তির মূল্য অত্যন্ত বেশি ধরা হয়। ফলে এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাভজনক হয় না। ভারত কোনো সাপ্লায়ারস ক্রেডিট গ্রহণ করে না। বাংলাদেশেরও ভারতকে অনুসরণ করে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নেয়া একেবারে বন্ধ করা উচিত।

ঋণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে। সেখানে ব্যয় বাড়বে, বাড়ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ঋণ পাওয়া সম্ভব এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতেই আমাদের প্রকল্প বাছাই ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত। বিনা প্রতিযোগিতায় যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেখানে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে এবং অনুপার্জিত মুনাফার (রেন্ট) পরিমাণও অনেক বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। আগেই উল্লেখ করেছি, ভারত সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নেয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং এটি একটি ভালো উদাহরণ। বাংলাদেশের তা অনুসরণ করা উচিত।

সরকার কিছু প্রকল্প নিজের অর্থে করতে চাইছে। আপনার কি মনে হয় তা সম্ভব?

আসল ব্যাপার হলো সম্পদ অসীম নয়, সম্পদ সীমিত। বাংলাদেশের অর্থে কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু সব বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একটি তালিকা করতে হবে যে, আমাদের কোন কোন প্রকল্প প্রয়োজন। সে তালিকা থেকে যেগুলো সবচেয়ে বেশি লাভজনক, শুধু সেগুলোয় আমাদের দেশের অর্থায়ন করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, কেবল বড় প্রকল্প নয়; অন্যান্য খাতেও আমরা বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে চলেছি। কিন্তু সেগুলো তো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। তাই সেখানেও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে। আবার যেগুলো আমরা সরকারি খাতে করব, সেগুলোয়ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও বৈদেশিক ব্যয় কতটুকু বাড়বে— সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। প্রকল্পের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে এ ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া ভালো।

সরকারের ব্যয় বাড়ছে। লক্ষণীয়, সেখানে অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে বেশি। তা কমানোর কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

দেখুন, বাংলাদেশের সব জায়গায় ব্যয় হ্রাসের সুযোগ রয়েছে। তবে তার জন্য অনেক ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা মোটেই জনপ্রিয় হবে না। বেশির ভাগ সরকারই এ ধরনের কাজ করতে চায় না। কিন্তু যদি আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার না হয়, তাহলে আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে পারব না। কাজেই বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত যেখানে অপব্যয় হচ্ছে, তা রোধ করা। একটা অপব্যয়ের উদাহরণ দিতে পারি তা হলো, বাংলাদেশে যতসংখ্যক অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের পদ আছে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এতে  সরকারের আকার বড় হচ্ছে ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এজন্য সরকার সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সেসব দিক থেকে সব ব্যয়ই পর্যালোচনা করা দরকার।

অনেক দেশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কম। আমাদের বেশি। অনেকেই এটা কমিয়ে আনতে বলছেন। আপনার মত কী?

আসলে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমালে হয়তো কিছু ব্যয় কমতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে যেটা হয়েছে তা হলো— যেখানে পদ নেই সেখানে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এ পদোন্নতি দেয়ার ফলে যা হয়েছে, উপরের দিকে অনেক বেশি লোকের পদায়ন হচ্ছে এবং নিচের দিকে পদ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। যারা তৃণমূল কর্মী, তারাই কিন্তু আসল কাজটি করেন। ফলে এ প্রবণতার কারণে সরকারের দক্ষতা অনেক কমে যাচ্ছে। জনপ্রশাসনের যেসব নিয়মকানুন আছে, সেগুলো প্রয়োগের কোনো নিদর্শন আমরা দেখতে পারছি না। এগুলো না করলে সরকারের ব্যয় বাড়বে এবং সরকারের কার্যকারিতা কমবে।

সরকার দাবি করছে, বাংলাদেশে চলতি বছর ৭ দশমিক ১১ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অনেকে এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপনি কী মনে করেন?

বাংলাদেশে ৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে প্রবৃদ্ধি অবশ্যই হয়েছে। এখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে খুব একটা লাভ আছে বলে মনে হয় না। এটা হতেও পারে, না-ও হতে পারে। কিন্তু এ পর্যায়ে যদি আমাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে না। বিদেশী বিনিয়োগও বাড়ছে না এবং সরকারের ব্যয়িত অর্থ যে সবখানে উত্পাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে, তার নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির হার কত— এ নিয়ে যতটা চিন্তিত, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তিত ভবিষ্যতে এ হার ধরে রাখতে পারব কিনা। সেটা করতে হলে অবশ্যই বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।

বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা বলছেন কী কী কারণে তারা বিনিয়োগ করছেন না। এটা কীভাবে সমাধান করবে সরকার?

এটা দুই পর্যায়ে সমাধান করতে হবে। একটা হলো, সরকারকে বিনিয়োগকারীদের যেসব বড় সমস্যা রয়েছে, তা মোকাবেলার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন— বিদ্যুতের অভাব দূর করতে হবে। গ্যাসের অভাব দূর করতে হবে। সড়কের যানজট দূর করতে হবে। বন্দরে জাহাজের জট দূর করতে হবে। এ ধরনের অনেক সমস্যা বিনিয়োগকারীদের রয়েছে, যেগুলো তাত্ক্ষণিকভাবে সমাধান সম্ভব। কিন্তু এ তাত্ক্ষণিক সমাধানই যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় মামলা হলে তা ১০-২০ বছরেও সমাধান হয় না। অথচ সিঙ্গাপুরের মতো দেশে সেগুলো হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে সমাধান হয়ে যায়। সুতরাং সুশাসনের দিক থেকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের পেছনে পড়ে আছি আমরা। এতে এক স্থান উপরে বা নিচে গেলে কিছু হবে না। আসলে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য যে তত্ত্ব সবচেয়ে প্রয়োজন, তা হলো ‘হার্ড থিওরি’ বা ‘গরু-ছাগলের পালতত্ত্ব’। এর মানে হলো, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করতে যান না। তারা একসঙ্গে অল্প কিছু দেশে বিনিয়োগ করেন। গরু-ছাগলের পাল যেমন একদিকে যায়, তেমনি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মাত্র কয়েকটি দেশে সব বিনিয়োগ করেন। ৫ থেকে ১০টি উন্নয়নশীল দেশে তারা বিনিয়োগ করেন, যেখানে ১৩০টি দেশ তার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। এখন ওই ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি না হলে কোনোভাবেই বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাবে না। সেজন্য আমাদের দেশের সুশাসন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার একেবারেই উদাসীন। যেমন— রেগুলেটরি রিফর্মস, যেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চেষ্টা করা হয়েছিল, তা অব্যাহত রাখা হয়নি। আমি যখন পদত্যাগ করলাম, তখন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন— অত্যন্ত যোগ্য একজন দিয়ে রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন গঠন করবেন। গত আট বছরে কিছুই করেননি। তখন বিনিয়োগকারীদের যেসব সমস্যা ছিল, সেগুলো আরো প্রকট হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান না করা হলে আমাদের অর্থনীতি বিভিন্নভাবে হোঁচট খেতে পারে।

এখানে বিদেশী বিনিয়োগ না আসার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বারবার বলছেন অনেকে…  

শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়, দেশে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা যেত তাহলে এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ত।

এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

সবই চ্যালেঞ্জ। এখানে যে ব্যবসায়ীরা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে কাজ করে সাফল্য অর্জন করছেন, তাদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশে ব্যবসা করার পরিবেশ প্রায় অনুপস্থিত। এখানে অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। এখানে সরকারি অফিসে গেলে বছরের পর বছর কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না। আদালতে মামলা রুজু হলে বছরের পর বছর কোনো বিচার হয় না। এ অবস্থায়ও যে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেজন্য তারা অভিনন্দনের যোগ্য।

সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। আগে ইপিজেড করেছে। যে প্রক্রিয়ায় সরকার এগোচ্ছে, তাতে কি তারা সফল হবে?

ইপিজেড বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত সফল প্রকল্প। এখানে শিল্পের জন্য জমি ক্রয় করা একটি বড় সমস্যা। সরকার যদি সে সমস্যার সমাধান করে দেয়, তাহলে অনেক বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হবেন। কিন্তু শুধু ইপিজেড বা ইজেড করে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা যাবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ের পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। এটা করতে হলে অবশ্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য আমাদের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্রমে পরিবর্তন দরকার। এগুলো কোথাও তেমনভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না, যেটা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করবে।

সরকার একদিকে ১০ টাকার চাল বিতরণ করছে, অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে? 

জিনিসপত্র বিশেষ করে কৃষিপণ্যের দাম বাড়ার একটা মৌসুম আছে। যেহেতু বর্ষার পানি এখনো পুরোপুরি নামেনি, সেজন্য শাকসবজির দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। তবে ১০ টাকায় সরকার চাল দিচ্ছে দুটো কারণে। এক. সরকার গুদামে যে চাল রাখে তা বিক্রির তেমন সুযোগ নেই। সুতরাং সরকারকে এ চাল খালাস করার জন্য একটা উপায় বের করার প্রয়োজন রয়েছে। দুই. সরকার অবশ্যই আশা করে যে, এ ধরনের কম দামে চাল বিক্রি করলে তারা দরিদ্র মানুষের সমর্থন পাবে। সুতরাং রাজনৈতিক ও রাজস্বের যে বাধ্যবাধকতা— দুটো মিলে আলোচ্য কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। রাজস্বের বাধ্যবাধকতার সমস্যাটি আরো স্পষ্ট হবে। এটা শুধু আমাদের সমস্যা নয়। ভারতের গুদামে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য পড়ে আছে। কিন্তু তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। এ সমস্যার এখনো আমরা কোনো সমাধান খুঁজে পায়নি যে সরকার গুদামে বিপুল পরিমাণ চাল রাখবে, যাতে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হলে তা মোকাবেলা করা যায়। অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ সমস্যার জন্যই সরকারকে বাধ্য হয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও আমদানিকৃত পণ্যের (যেমন— চিনি, ভোজ্যতেল) দামও দেশে বাড়ছে। কেন?

এগুলো রোধ করার জন্য সরকার প্রতিযোগিতা আইন (কম্পিটিশন ’ল) পাস করেছে। কিন্তু তিন বছর হয়ে গেলেও কোনো কমিশন করেনি। অর্থাৎ আইনটিই পাস করেছে শুধু। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কাজেই এ সম্পর্কে সরকার আন্তরিক কিনা, সে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী (অলিগোপলি) চিনি ও ভোজ্যতেলের ব্যবসা করছেন। এ সমস্যা মোকাবেলা করার জন্যই কিন্তু প্রতিযোগিতা আইন করা হয়েছে। তিন বছর পার হলেও আইনটি বাস্তবায়নে কোনো কাজকর্ম করা হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট নিষ্ঠা আছে কিনা, সে প্রশ্ন তোলা যায়।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আসলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি বড় ধরনের পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কারণ এসব কর্মসূচির কারণে দরিদ্র মানুষের কী সুবিধা-অসুবিধা হয়, তা না দেখে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। তবে বিশ্বের সব দেশেই এ ধরনের কর্মসূচিকে নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ করা হয়। আমাদের এখানে পরিবীক্ষণ করে যেসব কর্মসূচি কম সফল, সেগুলো বাদ দিয়ে যেগুলো সফল সেখানে অধিকতর সম্পদের ব্যবস্থা করতে হবে।

এখনো আমাদের চার কোটি দরিদ্র লোক আছে। আগামীতে এটা কীভাবে মোকাবেলা করব?

বাংলাদেশের বড় সমস্যা কর্মসংস্থানের অভাব। কর্মসংস্থান না বাড়াতে পারলে আমরা টেকসই ভিত্তিতে দারিদ্র্য কমাতে পারব না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলে যে, আমাদের এখানে নাকি বেকারত্বের হার ৩ শতাংশ কিংবা তার কম। বেকারত্বের এ ধরনের হিসাব যেখানে করা হয়, সেখানে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। আমার হিসাবে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশের বেশি। এ হার মহামন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের যে হার ছিল, তার চেয়েও বেশি। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো,  কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। অনেক কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু আরো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রাধিকার ভিত্তিতে কোন বিষয়গুলোকে আগে রাখবেন?

সুশাসন অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন না হলে দেশী বা বিদেশী বিনিয়োগ কোনোটাই বাড়ানো সম্ভব নয়। সুশাসনের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে, তেমনি রয়েছে দৈনন্দিন প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ও। কারণ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত পেতে গেলে যে সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক কম সময় লাগে বিশ্বের অন্য উন্নত দেশে।

সূত্র : বণিক বার্তা favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment