অভিনব উদ্যোগ : পানিতে তরমুজ চাষ

অভিনব উদ্যোগ : পানিতে তরমুজ চাষ

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

ঘন সবুজ লতা। লাতার ফাঁকে ফাঁকে গাঢ় সবুজ রঙের তরমুজ। কাছে যেতেই প্রথমে আপনাকে হোঁচট খেতে হবে। কারণ গাছের নিচে মাটি নেই। ভাবছেন এটা আবার হয় নাকি! হয়। মাটি ছাড়া পানির ওপর অভিনব এই তরমুজ চাষ হয়েছে। পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পানিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। মাটিবিহীন পানিতে ফসল উৎপাদনের এই কৌশলকে কেতাবি ভাষায় বলে হাইড্রোপনিক, যা একটি অত্যাধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় সারা বছর কিংবা অমৌসুমেও সবজি, ফল, ফুল চাষাবাদ করা যায়।

পদ্ধতিটি মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় মাটিবাহিত ও কৃমিজনিত রোগ হয় না। কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিতে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। তাই অনায়াসে অর্গানিক ফসলের সম্ভার গড়ে তোলা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে ছোট-বড় উভয় পরিসরে স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়। এটি হোম-ফার্মিংয়ের জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি তাই এটি অধিক লাভজনক। পাশাপাশি অর্থকরী ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক ঘেঁষে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র। সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রের এক কোণে পরীক্ষামূলকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে তরমুজের আবাদ করা হয়েছে। ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থের এই তরমুজ বাগান। প্লাস্টিকের পাইপ ছিদ্র করে ১৪০টি তরমুজের চারা রোপণ করা হয়েছিল। এখন স্বাভাবিক নিয়মে ফলন এসে গাছে ঝুলে বড় হচ্ছে তরমুজ। এই বাগানে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০০টি তরমুজ বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি তরমুজের ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়েছে। সেই হিসেবে সুস্বাদু এ তরমুজ ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা আসবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ কে এম সেলিম রেজা মল্লিক ১৯৯৭ সালে জাপানে হাইড্রোপনিক প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই প্রযুক্তি প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। শুধু তরমুজ নয়, মাটি ছাড়াই জন্মাবে প্রিয় ফসল, ফুল, সবজি। মাটির পরিবর্তে পানিতেই জন্মাতে পারবেন টমেটো, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, ক্ষীরা, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, অ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমল্লিকাসহ আরো অনেক ফসল। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। এই চাষাবাদে কোনো কীটনাশক প্রয়োজন হবে না। এমনকি সার দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তাই অনায়াসে গড়ে তুলতে পারবেন অর্গানিক ফসলের সম্ভার।

চাষাবাদ পদ্ধতি : সাধারণত দুইভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। সঞ্চালন পদ্ধতি এবং সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি। সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানগুলো যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকে নেওয়া হয়। পরে পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অন্ততপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পাম্প এবং পাইপের আনুষঙ্গিক খরচ একটু বেশি হয়। পরবর্তী বছর থেকে শুধু রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এ পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজিং লোহার ট্রের ওপর কর্কশিটের মাঝে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে গর্ত করতে হয়। উপযুক্ত বয়সের চারা স্পঞ্জসহ ওই গর্তে স্থাপন করতে হয়। অপরদিকে, সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলো পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল চাষ করা হয়।

পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, এ বছর আগস্ট মাসে স্থানীয় বাজার থেকে হাইব্রিড তরমুজের বীজ কিনে চারা করা হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাগানের প্লাস্টিকের পাইপের ছিদ্রে চারা রোপণ করা হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি ফল আসতে থাকে। তিনি বলেন, চারা রোপণের পর প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান, যেমন পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট, পটাশিয়াম নাইট্রেট, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট, ইডিটিএ আয়রন, ম্যাংগানিজ সালফেট, বরিক এসিড, কপার সালফেট, অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ও জিংক সালফেট বিশুদ্ধ পানিতে মিশিয়ে ওই পাইপে নিয়মিত সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইফতেখার মাহমুদ বলেন, তরমুজের জীবনকাল আড়াই মাস। পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা তাঁদের এই বাগান থেকে তরমুজ উৎপাদন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শেষ হবে। জানুয়ারি মাসে আবার নতুন করে আরো বড় বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। খরচ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে খরচ একটু বেশি হয়। কারণ, প্লাস্টিকের পাইপ কিনে তা ছিদ্র করে চারা রোপণ করতে হয়। এরপর থেকে খরচ কমে যায়। এই বাগানে তাঁদের তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০০টি তরমুজ বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি তরমুজের ওজন এক থেকে দুই কেজি হবে। সুস্বাদু এ তরমুজ যদি ১০০ টাকা কেজি হয়, তাহলে ১০০টি তরমুজ কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা হবে। এ ছাড়া এখনো গাছে ৩০টির মতো তরমুজ বড় হচ্ছে।

কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বলেন, হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে এর আগে টমেটো, মরিচ, করলা ও মিষ্টি মরিচের আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য আসে। তবে তরমুজে সাফল্য এই প্রথম। এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না, অনাবাদি জমিও চাষের আওতায় আনা যায়। আলাদাভাবে সার ও সেচের প্রয়োজন নেই, মাটিবাহিত কিংবা কৃমিজনিত কোনো রোগ হয় না। তা ছাড়া নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চাষ হয় বিধায় কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম। ফলে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।

সূত্র: কালের কণ্ঠfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment