‘অন্যান্য অভিজ্ঞতাও জরুরি’
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
এস এম আরাফাতুর রহমান। বর্তমানে প্রাণ আরএফএল প্ল্যাস্টিকের হেড অফ মার্কেটিং হিসেবে কর্মরত আছেন। নিজ যোগ্যতায় নিজেকে নিয়ে এসেছেন এতোদূর। কিন্তু থেমে থাকা নয়। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে। আরাফাত মনে করেন, কর্মনিষ্ঠার সাথে চাই প্রতিষ্ঠানের অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেকে নিয়মিত তৈরি রাখার চেষ্টা। এ সবকিছুর সমন্বয়ই পৌঁছে দিতে পারে অভিষ্ট লক্ষ্যে।
বর্তমান সময়ে কর্পোরেট জগতের চ্যালেঞ্জ, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য তরুণদের কীভাবে প্রস্তুত হওয়া উচিত এসব নিয়েই একটি আড্ডা হয় আরাফাতুর রহমানের। আড্ডার শুরুতেই আমরা জেনে আসি আরাফাতুর রহমানের দেয়া জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টাভিউয়ের গল্পটি।
আরাফাতুর রহমান প্রথম যে চাকরির ইন্টারভিউয়ের ডাক পান সেটি ছিলো একটি ফোন কোম্পানির ইন্টারভিউ। আসলে একটি লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য তাকে ডাকা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন এটা ইন্টারভিউ মানে মৌখিক স্বাক্ষাতকার নেয়া হবে। সাথে কলম নিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। ইন্টাভিউ স্থানে গিয়ে দেখেন, সেখানে কয়েক হাজার ছেলে মেয়ে উপস্থিত। লিখিত পরীক্ষা হবে। তাই একটি কলম কিনে আরাফাতুর রহমান চাকরির পরীক্ষায় বসেন।
এই গল্পের বাকি অংশটুকু আরাফাত রহমানের মুখে শোনা বর্ণনা থেকেই তুলে ধরছি- আমি তখন অনেকটা নির্ভার হয়েই পরীক্ষা দেই। যা হওয়ার হবে। টেনশন করার কি আছে। পরীক্ষার ১০/১২ দিন পর ডাক পেলাম ভাইবা বোর্ডের। অর্থ্যাৎ রিটেনে টিকে এবার সত্যিই ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম। তো ইন্টারভিউ বোর্ডেও আমি স্বাভাবিক ছিলাম। বাড়তি চাপ নেইনি। সেখানে কথা বার্তা হলো। তারা তখন এক পর্যায়ে আমার কাছে একটি কৌতুক শুনতে চায়। আমি তখন তাদের একটি কৌতুক শোনাই। কৌতুকটি ছিলো এরকম- এক লোক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বলতেছে পনেরো… পনেরো… পনেরো…। তখন এক লোক এসে বলে কি গুনতেছেন ভাই? ওই প্রশ্নকর্তাকে ধাক্কা মেরে সামনের খোলা ম্যানহোলের ভেতর ফেলে দিয়ে লোকটি বলা শুরু করে ষোল… ষোল… ষোল…। অর্থ্যাৎ সে খোলা ম্যানহোলে মানুষ ফেলতেছিলো আর তা গুনতেছিলো।
তা আমার কৌতুক শেষ হতেই তারা জানিয়ে দিলো চাকরিটা আমার হয়েছে। আমাকে জয়েনিংয়ের বিষয়েও সরাসরি বলা হলো ইন্টারভিউ বোর্ডে। যা সাধারনত করা হয় না। সেই প্রথম ইন্টারভিউতেই আমার চাকরি হয়।
আরাফাতুর রহমান এরপর তার কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে উঠে এসেছে এ পর্যন্ত। আরাফাতুর রহমানের সাথে স্বাক্ষাতকার মূলক এই আড্ডার একটি অংশ তুলে ধরা হলো।
: কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষপদে বড় একটি অংশ দখল করে আছে বিদেশী কর্মীরা। এর কারণ কী নিজেদের দক্ষ জনশক্তির অভাব নাকি অন্য কিছু?
আরাফাতুর রহমান: আসলে এইখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। আমাদের কর্মী যোগ্য না বললে ভুল হবে। যোগ্যতা আছে বলেই আজ দেশের অনেক কোম্পানি ভালোভাবে চলছে। কিছু কিছু জায়গায় দেশের বাইরের লোকজন আছে। বাইরের লোকজন থাকার পিছনে প্রধান যে কারণটা আমার মনে হয় আমাদের দেশীয় কোম্পানি তা তো আছেই বাইরের কোম্পানিগুলোও মনে করে বাইরের কেউ যদি এসে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে হয়তো ভালো করবে প্রতিষ্ঠানটি। আমি মনে করি এ ধারনাটা একেবারেই ভুল। আমাদের দেশেও দক্ষ শ্রমিক দক্ষ জনবল সে সঙ্গে যোগ্যতাসম্পূর্ণ লিডার আছে। যাদের মাধ্যমে আমাদের দেশীয় অনেকগুলো কোম্পানি খুব ভালোভাবেই চলছে। আমি উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই- আমাদের প্রাণ আরএফএল কোম্পানির কথা বাংলাদেশে কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি। এই প্রতিষ্ঠানে বাইরের লোক নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় লোকবল দিয়ে সুনামের সঙ্গে মার্কেটে একটা জায়গা করে নিয়েছে।
শুধু তাই নয় বিদেশে যেসব জাযগায় আমাদের কোম্পানির অপারেশন আছে সেখানে বেশিরভাগ কর্মকর্তা আমাদের দেশ থেকে গিয়েছে। তারাই পরিচালনা করছে। কিন্তু সেখানকার সম্পর্কে ধারনা নিতে কিছু লোকাল লোকও নিয়োগ দিতে হয়।
আমি মনে করি কোম্পানির মালিকপক্ষ বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মেন্টালিটি পরিবর্তন করা উচিত। যেমন অনেকক্ষেত্রে প্রাইভেট এবং পাবলিক ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে অনেকের ভ্রান্তধারনা আছে। তারা ভাবে পাবলিক ইউনিভার্সিটি এখনো ভালো। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে গিয়ে দেখলে বুঝা যায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরাই বিভিন্ন কোম্পানিতে ভালো ভালো পোস্টে কাজ করছে। আমি মনে করি সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন আসবে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে আমাদের এক সাথে মিলে মিশে কাজ করতে হবে এবং আমাদের মাথায় রাখতে হবে আমরাও পারি।
: কর্পোরেট মার্কেটে চাকরির বাজার নিজেদের কর্মীদ্বারা নিয়ন্ত্রণ রাখতে কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার?
আরাফাতুর রহমান: আমাদের চাকরির বাজার যদি আমাদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তবে প্রথমে নিজেকে তৈরি করতে হবে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের নিজেকে তৈরি হতে হবে। এক্ষেত্রে একটা স্টুডেন্ট আমাদের এখানে কতটুকু গাইড পায় এটাও একটা বিষয়। আমাদের অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট কিছু ফরম্যাটের বাইরে যেতে চান না। যেমন আমাদের দেশে একটা হোটেলের জন্য দেশের বাইরের লোক নিয়োগ দিতে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে মেশিন সেটআপ করতেও বাইরের লোক আনতে হয়। এর কারণ আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা বা নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় ছাড়া আমরা খুব একটা মনযোগী না। এর জন্য আমাদের সমাজ অনেকটাই দায়ী। আমরা অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের শিক্ষাকে তুচ্ছভাবে দেখি। যারা আসলে কারিগরি শিক্ষা বা নির্দিষ্ট বিষয়ের বাইরে পড়াশুনা করছে তাদের জন্য চাকরির বাজার ভালো।
: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরির বাজারের সুবিধা বেশি?
আরাফাতুর রহমান: ঢাকা এসেই আমরা বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী বিবিএ পড়তে চাই। বিবিএর জন্য তো আর কোটি কোটি পোস্ট নেই। একটা প্রতিষ্ঠানে অনেকগুলো ডিপার্টমেন্টের অনেকগুলো পোস্ট। এখন একটা ডিপার্টমেন্টের জন্য বা একটা পোস্টের জন্য যদি সবাই আসে তা হলে আপনি চাকরি দিবেন কীভাবে? আর বাকি পোস্টের লোক কই পাবেন? তাই আমাদের মেধা অনুযায়ী আমাদের বিষয় নির্ধারন করা উচিত। আমাদের ছোট বেলা থেকে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে জানা উচিত। এক কথায় আমাদের নির্দিষ্ট ফরম্যাটের বাইরে বের হতে হবে।
: বর্তমান সময়ে তরুণদের জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার প্রধান চ্যালেঞ্জ কি বলে মনে করেন?
আরাফাতুর রহমান: তরুণদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ আমি মনে করি নিজেকে প্রমাণ করা। তরুণদের প্রমাণ করতে হবে তাকে দিয়েও সম্ভব। যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মত সে সক্ষমতা ও সৎ সাহস থাকতে হবে। শুধু পড়াশুনাই নয় নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এর পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকাটা জরুরি।
আমাদের দেশে তরুণরা অনেকেই চাকরির শুরুটাই করতে চায় বড় কোনো পদ দিয়ে। যেটা আসলে আমাদের দেশের তরুণদের পিছিয়ে যাওয়ার প্রথম কারণ। আরেকটা কারণ হচ্ছে আমরা পড়াশুনার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট বিষয়ের বাইরে যেতে চাইনা। আমাদের স্বপ্নই থাকে মূলত তিনটা- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা বড় ব্যবসায়ী। তরুণদের উচিত যে পদেই হোক আগে কাজ শুরু করা। এরপর অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে প্রমাণ করে যোগ্যতা দিয়ে উপরের দিকে যাওয়া।
: একজন তরুণ কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে কোন কোন বিষয়ে নজর রাখা উচিত?
আরাফাতুর রহমান: ইন্টার্ভিউ দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন নিয়মনীতি নেই। ইন্টার্ভিউ দিতে যাওয়ার আগে শুধু প্রস্তুতি নিয়ে গেলে ইন্টার্ভিউ ভালো হবে এটা কখনোই সম্ভব না। আপনার অতীত অভিজ্ঞতা, আপনি ছোটবেলা থেকে যা শিখেছেন, শুধু পড়াশুনাই নয় এর পাশাপাশি আপনি খেলাধুলা, অন্যান্য ক্ষেত্রে কতটুকু পারদর্শী এ সবকিছুর যোগফলই আপনার ইন্টার্ভিউ সফল করবে।
: আপনার দৃষ্টিতে স্মার্টকর্মী কেমন হওয়া উচিত?
আরাফাতুর রহমান: স্মার্টকর্মী বলতে আমি বুঝি একজন কর্মী তার দায়িত্ব কতটুকু সঠিকভাবে পালন করতে পারছে। আমি মনে করি এটাই স্মার্ট হওয়ার প্রথম শর্ত। পোশাক দিয়ে কখনো স্মার্ট হওয়া যায়না। আপনাকে আপনার কাজ দিয়ে স্মার্টের পরিচয় দিতে হবে।
: আপনার শৈশবে আপনি কি হতে চেয়েছিলেন?
আরাফাতুর রহমান: আমার শৈশব কেটেছে কক্সবাজারে। পরিবারের পক্ষ থেকে সবাই চেয়েছিলো বড় হয়ে ডাক্তার হই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করি। আমি কর্পোরেট জগতের চাকুরি জীবনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।