চাঁদপুরের সোলার ইউসুফ

চাঁদপুরের সোলার ইউসুফ

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

মোটরচালিত সাইকেল তো নতুন কিছু নয়। তবে এই মোটরসাইকেলগুলোর জ্বালানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তেল। তরুণ উদ্ভাবক মো. ইউসুফ সরদার সাইকেলটি বানিয়েছেন, সেটা চলে বিদ্যুতে, তবে তা সূর্যের তেজে। ২৪ বছর বয়সী ইউসুফ সৌরবিদ্যুচ্চালিত দ্বিচক্রযান বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নিজের এলাকায়। সাইকেলের হাতলে আছে সোলার প্যানেল।
শুধু এ সাইকেলেই ইউসুফের উদ্ভাবনী শক্তি আটকে নেই। অসুস্থ মায়ের জন্য সৌরবিদ্যুচ্চালিত একটি হুইলচেয়ারও বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। চাঁদপুর শহরের দক্ষিণ বিষ্ণুদী বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে মা-বাবা ও ভাইবোনের সঙ্গে থাকেন তিনি। অসচ্ছল পরিবার তাঁদের। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ইউসুফ অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এ বছর চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। অনটনের সংসারে অন্য ভাইয়েরা পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে তাঁর বোনেরা সামান্য কিছু লেখাপড়া করেছেন।ইউসুফের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তিনি বললেন, ‘সে সময়ে আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। একদিন স্কুলে যাবার পথে রিকশার সঙ্গে একটি ট্রাকের সংঘর্ষে আমার ডান হাত ভেঙে অচল হয়ে যায়।’ টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারেননি তখন। লেখাপড়া বন্ধ থাকে বেশ কয়েক বছর। ‘ওই সময় কিছুটা সুস্থ হয়ে ইলেকট্রনিকসের কাজ শেখা শুরু করি। ধীরে ধীরে লাইট-ফ্যান মেরামত করতে থাকি।’চাঁদপুরের সোলার ইউসুফ

যন্ত্রপাতি সারাইয়ের কাজ ভালোই পারতেন তিনি। এলাকায় নাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে পড়াশোনা করার মতো অবস্থা ছিল না। ইউসুফের বাবা খাজা আহমেদ শহরের চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় এখনো চায়ের দোকান চালান। বড় ভাই পুরান বাজারে পান বিক্রি করেন। দোকানদারি করেন। ইউসুফ তখন থেকেই তাঁর আয় দিয়ে পরিবারে সহযোগিতা করেন। আবার নিজের লেখাপড়ার খরচও চালিয়ে আসছেন।
বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কলেজে ক্লাস করতে যেতেন হেঁটে হেঁটে। সেটা ২০১৫ সালের কথা। হঠাৎ ইউসুফের মাথায় এল, ‘সৌরবিদ্যুচ্চালিত একটা বাইসাইকেল বানিয়ে ফেলি। দ্রুত কাজে আর কলেজে যেতে পারব।’ যেই চিন্তা সেই কাজ। দ্রুতই বানিয়ে ফেললেন সৌর সাইকেল। খবর চলে যায় চাঁদপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ লুৎফুর রহমানের কাছে। তিনি ইউসুফকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘আরও কিছু বানান, আমরা সহযোগিতা করব।’
এবার ইউসুফ ভাবলেন তাঁর মা মমতাজ বেগমের কথা। ‘আমার মাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কথা বলতে পারেন না, চলতে-ফিরতে পারেন না। মায়ের জন্য তো কিছু একটা করতে হবে।’ কয়েক দিনের মাথায় গত জানুয়ারিতে মায়ের জন্য সৌরবিদ্যুচ্চালিত হুইলচেয়ার বানিয়ে ফেলেন। সেই হুইলচেয়ারে করে ইউসুফের মা এদিক-সেদিক যেতে পারেন। ইউসুফের এই হুইলচেয়ার চাঁদপুরের ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা-২০১৬-তে প্রথম পুরস্কার পায়।
চাঁদপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সবুর মণ্ডল ইউসুফকে কয়েকজন প্রতিবন্ধীর জন্য দু-তিনটি সৌরচালিত হুইলচেয়ার বানাতে বলেন। খরচও দেন। ইউসুফ বানিয়ে ফেলেন আরও দুটি হুইলচেয়ার। জানালেন, একটা হুইলচেয়ার বানাতে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এরই মধ্যে ইউসুফ একই সৌরবিদ্যুচ্চালিত হুইলচেয়ার নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় হন। ইউসুফের সাফল্যকে দেখে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী, নাসার কর্মকর্তা ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অভিনন্দনপত্র ও শুভেচ্ছা জানানো হয়।
ইউসুফ বলতে থাকেন, ‘আজ আমার টাকা নেই। তেমন কোনো শিক্ষাও নেই। ফলে কিছুই করতে পারছি না।’ সহজাত এই উদ্ভাবকের নতুন পরিকল্পনা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনের অ্যাপ দিয়ে চালানো যায় এমন একটি সোলার হুইলচেয়ার বানানোর। সেটি বানাতে তাঁর খরচ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ইউসুফের হুইলচেয়ার পেয়েছেন চাঁদপুরের দুই প্রতিবন্ধী ভাই। চাঁদপুর সদরের দক্ষিণ বালিয়ার ইউনিয়নের রাজু দেওয়ান ও মিজান দেওয়ান চালান এই সোলার হুইলচেয়ার।
সহজাত উদ্ভাবক ইউসুফের স্বপ্ন আছে আরও অনেক। স্বপ্নের সিঁড়ির একেকটা ধাপ টপকে তিনি এগিয়ে যেতে চান। নিজের উদ্ভাবনে মানুষের মুখের হাসি দেখে আনন্দ আর প্রশান্তি আসে ইউসুফের তরুণ প্রাণে।

সূত্র: প্রথম আলো

favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment