তারুণ্যনির্ভর সামাজিক উদ্যোগ

তারুণ্যনির্ভর সামাজিক উদ্যোগ

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

যশোর সদরের মুজিব সড়ক ধরে কিছুদূর এগোলে গলির ভেতরে জয়তী সোসাইটির নিজস্ব ভবন। নিচতলায় একটি রেস্তোরাঁ, নাম জয়তী হেঁশেল। ওপর তলায় পর্যায়ক্রমে নারীদের ব্যায়ামাগার বা জিম, বিউটি পারলার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র সবই রয়েছে। ভবনের সামনেই ছোট্ট করে লেখা ‘এখানে বয়স্ক নারীদের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবা দেওয়া হয়’।

এ কেমন সংস্থা, যেখানে ব্যবসা ও বিনা মূল্যে সেবা—দুটোই দেওয়া হয়? জানতে চাই এর পরিচালক অর্পণা বিশ্বাসের কাছে। হেসে উত্তর দেন তিনি, এটি একটি সামাজিক ব্যবসায়িক উদ্যোগ। ২০ হাজার নারীর সঞ্চয় দিয়ে গড়ে ওঠা এই সংস্থার সাতটি ব্যবসায়িক ও তিনটি সামাজিক সেবামূলক উদ্যোগ রয়েছে। সমিতির সদস্যদের গড় বয়স ৩০। তাঁরা তাঁদের ব্যবসার মুনাফা দিয়ে বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে সেবা দেন।

শুধু জয়তী সোসাইটি নয়, সারা দেশে এখন এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায়িক উদ্যোগ গড়ে উঠছে। আর এসব উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণেরা। সমাজের প্রয়োজন মেটাতে তাঁরা ব্যবসা করেন, ব্যবসার মুনাফা নিজেরা না তুলে তা পুনর্বিনিয়োগ করেন। একটি অংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ব্যয় করেন।

এক হাজার সামাজিক উদ্যোগের ওপর পরিচালিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সামাজিক উদ্যোক্তাদের অধিকাংশের বয়স ৩৫-এর নিচে। ‘দ্য স্টেট অব সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ইন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও ঘানা’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক উদ্যোগ বাড়ছে। আর এসব উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে তারুণ্যের সমাগম বেশি বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেন, দেশের কৃষির নতুন খাত ও নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। সামাজিক ব্যবসায় তরুণ ও নারীদের অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। তবে এ ধরনের খাতে সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলে তা অনেক ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে।

দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশ ঘানার ওপর পরিচালিত জরিপে আরও দেখা গেছে, মূলধারার ব্যবসায়িক ও শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন বাংলাদেশে। এসব সামাজিক উদ্যোক্তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

যুক্তরাজ্য সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন কেন্দ্রের (ওডিআই) সহায়তায় এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে বাংলাদেশ অংশে জরিপটি করেছে বেসরকারি সংস্থা বেটারস্টোরিজ, ইউএন লি. ও সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ইউকে। ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানের এক হাজার সুবিধাভোগীর ওপর জরিপটি হয়েছে।

জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক, প্রধান নির্বাহী ও পরিচালকদের অধিকাংশই তরুণ। এসব উদ্যোক্তার ৭০ শতাংশেরই বয়স ৩৫ বছরের কম। ৯১ শতাংশের বয়স ৪৫ বছরের নিচে। সেখানে উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ হলেও এ ধরনের উদ্যোগে যাঁদের কর্মসংস্থান হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই নারী। অন্যদিকে ভারতের সামাজিক উদ্যোক্তাদের গড় বয়স ৪৪, পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশের বয়স ৩৫-এর নিচে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রকল্প পরিচালক রাহমান খান বলেন, কোনো সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য নেওয়া ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোকে সামাজিক উদ্যোগ বলা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগে উদ্যোক্তারা ব্যক্তিগত মুনাফা না নিয়ে প্রতিষ্ঠানে তা পুনর্বিনিয়োগ করেন এবং সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকেন। তরুণেরাই এ ধরনের উদ্যোগে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।

জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের শিক্ষা ও সেবা খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি। আর ভারত, পাকিস্তান ও ঘানায় কৃষি খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি।

বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক লেনদেন গড়ে ২১ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরে এর পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে। গত বছর বাংলাদেশে সামাজিক উদ্যোগে ৬ হাজার ৩৪৬ জনের স্থায়ী ও খণ্ডকালীন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগামী বছর তা বেড়ে ৬ হাজার ৬৭৯ জন হবে বলে আশা করা হয় প্রতিবেদনে।

অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা দেশের অন্যান্য স্থানে শাখা স্থাপন ও নতুন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণে বেশ এগিয়ে আছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর যেখানে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উদ্যোক্তা শাখা স্থাপন করার স্বপ্ন দেখছেন, সেখানে বাংলাদেশে দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের শাখা চালু করতে চায়।

জরিপে দেখা গেছে, দেশের সামাজিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই কাজ করে শিক্ষা খাতে। ৩২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই শিক্ষা খাতে কাজ করে। আর অন্যান্য সেবা খাতে কাজ করে ২৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা সহায়তা খাতে ২২ শতাংশ, জীবিকা ও কর্মসংস্থান খাতে ২১ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে ২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কাজ করে।

এ ব্যাপারে জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বেটারস্টোরিজের প্রধান মিনহাজ আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশের বেশ কিছু সামাজিক সমস্যার সাধারণ ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে সমাধান করা সম্ভব হবে না; যেমন গ্রামে উন্নতমানের চুলা সরবরাহ, সৌরবিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তরুণেরা এ ধরনের সমস্যা উপলব্ধি করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন। ওই পথেই এর সমাধান সম্ভব বলে তাঁরা প্রমাণ করছেন।

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment